দৈনিক পত্রিকা পড়ার অভ্যাস কোনোদিনই গড়ে উঠল না আর। বলছি নিজের কথাই, বলা বাহুল্য। কোনো কোনো লোকের, দেখতে পাই, রোজকার সংবাদ সংগ্রহের একপ্রকার অদম্য নেশা বা আসক্তি রয়েছে। বেশিরভাগ লোকেরই, আমার চারপাশের, এই অভ্যাস রয়েছে। দেশ-বিদেশের হালফিল খবরাখবর, রাজনীতি-অর্থনীতি ছাড়াও চারপাশের যাপন ও জীবনচিত্র জানবার জন্য মুখিয়ে থাকেন আজকের যুগের জনগণ। আমার নিজের ভেতরে সে-রকম কোনো তাগিদ আমি দেখতে পাই না বাইরেকার জগৎ জানার। জানতে পেলে ভালো, জানতে চাইও, তবে জানার জন্য উন্মুখ হই না। জ্ঞান জিনিশটার প্রতি আমার এক্সট্রিম না-হলেও ভালোই বিতৃষ্ণা আছে, যা মারাত্মক আত্মবিধ্বংসী এবং অতীব দুঃখজনক স্বীকার করি, এখানে-ওখানে নানাবিধ মাপ ও ধাপের জ্ঞানী দেখে আমি তো দস্তুরমতো ভূকম্পন বোধ করি হৃদপিণ্ডে। এবং জ্ঞানীদেরকে আমি ভল্লুকের মতো সমীহ করি, বিভীষিকাময় টাইফুন-টর্নেডোর ন্যায় জ্ঞানীদেরকে দেখামাত্র নিরাপদ অজ্ঞানস্থল খুঁজতে থাকি, জ্ঞানী দেখলেই আমি সভয় পালিয়ে আসি অকুস্থল ছেড়ে। এর বাইরে যারা, মানে যারা জ্ঞানী নন ওই অর্থে, এদের বেশিরভাগের সঙ্গে মোলাকাত মাত্রই আমি আজকাল চুরিচুরি-চুপকেচুপকে পিছু হটে আসি। এরা জ্ঞানী নন হয়তো, তবে এরচেয়েও অধিক কিছু, এরা পত্রিকাজ্ঞানী। এদের দৌরাত্ম্যে কেহেরমান দৈত্যও ভড়কে যাবে নির্ঘাৎ। যাকগে, এই দুই দলের বাইরে আর বাকি রইল কারা? আমি ও আমার দল, অর্থাৎ যারা দিনান্ধ। যদি দিনকালের সঙ্গে তাল মিলায়ে চলতে চাও, তো ওই দুই দলের কোনো একটার সভ্য হও। নয়তো মরেছ। সভ্য হওয়া হলো না আর ইহকালে। এবং হলো না কাগজের কলাম পড়ে দুনিয়ার সমস্ত কায়কারবার নিয়া কলকণ্ঠ হওয়া।
সেসব থাক। কথা হলো, জগৎ জানা বা বোঝার একটা পথ খবরের কাগজ, অন্তর্ভুক্ত অন্যান্য উৎস যেমন দৃশ্যমাধ্যম বা সামাজিক প্রাযুক্তিক পরিসর তথা ফেসবুক-ব্লগ প্রভৃতি, কিন্তু এইসবই একমাত্র নয় নিশ্চয়। এর বাইরে থেকে কেমন করে জানা যাবে দুনিয়া? আছে কোনো অন্যধারা জ্ঞানমাধ্যম, জানার চ্যানেল? পির-ফকির? গুরুমুর্শিদমুখি শিখনপড়নচর্চা? জানি না। যা-কিছু আমি জানি না তা-কিছু দুনিয়ায় নিরস্তিত্ব বলেও মনে করি না।
আর তাছাড়া, বাইরের পৃথিবী জানার চেয়েও ভেতরের পৃথিবী তথা ভেতরজগৎ জানার দিকেই ব্যক্তিগত ঝোঁক আমার। সে-যা-হোক, আজকাল অবশ্য অন্যরকমও মনে হয়, এই তরিকার বহির্জ্ঞান আহরণ ও অনুশীলনের বহর ও হিড়িক দেখে। মনে হয়, পৃথিবীটা যেন অতিমাত্রায় মিডিয়াবাধিত/পত্রিকাশাসিত হয়ে পড়ছে। পত্রিকামারফতে/মিডিয়ান্তরে জানা বা দেখা পৃথিবীর পর্যুদস্ত অবস্থা অবলোকন করে, কই, কোথাও কারোর মধ্যে বিকার তো দেখি না! কত নির্বিকার আর নির্বিরোধ হতে যে শিখেছে মানুষ! এইটুকু — এই নির্বিকারিতা-নির্বিরোধিতা জানতে-বুঝতে গেলে যেটুকু কমনসেন্স/কাণ্ডজ্ঞান দরকার পড়ে, সেইটুকু এখনও রয়েছে আমার। তবু সংবাদপত্র পড়লে অনেক বেশি পৃথিবীর সঙ্গে লিপ্ত থাকা যায়, একধরনের উপরিতলের সক্রিয়তার বোধও জন্মায় তাতে, এইটুকু বুঝি। কিন্তু এত বুঝেও অভ্যাসটা ঠিক গড়ে উঠল না আজতক। যদি উঠত, পত্রিকাপাঠাভ্যাস গড়ে উঠত, মহাজ্ঞানী হিসেবে মর্ত্যধামে অমর্ত্যবৃন্দের তর্কচক্রে চেয়ার পাইতে পারতাম। আহা রে! এই প্যানপ্যানানি নিয়া আমি কী উপায়ে জিন্দেগি গুজারিব! মরিলেও মূর্খ রহিয়া যাইব, মরিবার আগে যদি দৈনিক সকালবিকাল সংবাদোন্মাদ হইয়া না-উঠিবার পারি …
প্রচ্ছদ / সত্যজিৎ রাজন ।। লেখা / জাহেদ আহমদ ২০১৩
… …
- আত্মহন্তার অন্তরাত্মা - June 25, 2025
- আমার জয়দেব - June 19, 2025
- অজিত পান্ডে রেমিনিসেন্স - June 15, 2025
COMMENTS