অভূমিকা
আমি পাইলাম, ইহাকে পাইলাম। অনেক প্রতীক্ষার পর ‘নির্বাসিত’ (Nirbashito) ম্যুভি দেখা হলো। নেটে সার্চ করতে করতে ক’দিন বাদই দিয়েছিলাম। রাজীবদা সেদিন জিগাইলেন, পাইছি কি না? পাইনি। পরে ক্যাটডটসিআরে ক্লিক করতেই দেখি আপলোড করেছে। ব্যাস, সোজা নামাইয়া দেখতে বসলাম।
ছবিতে সামান্যই আছে তসলিমার ঘটনাবহুল জীবনের। তবে চূর্ণীকে জাস্ট অসাধারণ লাগছে। আর শাশ্বত ইজ দ্য বেস্ট। যদিও বাঘিনী এই ছবির মূল চরিত্র, কিন্তু বাঘিনীর মা — মানে লেখক তসলিমাও আছেন তার ঘটনাপরিক্রমায়, পেন তাকে সুইডেনে নিয়ে গেলে গল্পে দেখি বাঘিনীর জন্য তার অপার মমতা। বাঘিনী একটি বন্যবিড়াল।
এতদিন চূর্ণীর অভিনয়ে মুগ্ধ ছিলাম, এবার ডিরেকশনেও হলাম। য়্যু আর দ্য বেস্ট ফর দিজ ম্যুভি। আর কেউ এটা পারতই না। নো। ভাঙা গলায় কথা বলা, ঋদ্ধ ভাব, অমিত সাহস আর নিজের প্রতি একঝোলা বিশ্বাস।
লেখক তসলিমাকেও ছাড়িয়ে গেছে কখনো কখনো। উই আর প্রাউড টু বি অ্যা পার্ট অব দিজ ম্যুভি। অস্কারেও গিয়েছিল এই ম্যুভি। রেজাল্ট জানি না। এই ছবির পরতে পরতে বাংলাদেশ।
কৌশিক গাঙ্গুলির পরে এবার সফল ডিরেক্টর তার স্ত্রী চূর্ণী গাঙ্গুলিও।
ফোকাসড অন
আমরা কথা বলছিলাম ছায়াছবি ‘নির্বাসিত’ নিয়ে। ডিরেকশানে চূর্ণী গাঙ্গুলি। আর অভিনয়ে সব বাঘাবাঘিনী অভিনেতা এবং একটা সত্যিকারের বিড়াল বাঘিনী। পরিচালকের মতে, এইটা কোনো বায়োপিক নয় মোটেও তসলিমার উপরে। জাস্ট তসলিমার জীবনের একটা খণ্ডিত অংশের সিনেম্যাটিক উপস্থাপনমাত্র।
বাঘিনী একটা বিড়াল, বন্য এবং গল্পে তসলিমার কন্যা যিনি অন্য কাউকেই সমীহ তো করেনই না অধিকন্তু খামচিটা দিয়ে বসেন কখনো কখনো এবং কাঁচা মাছ তার অধিক প্রিয় খাদ্য গুঁড়ো দুধ অপেক্ষা।
তসলিমার নির্বাসন নিয়ে আমরা সক্কলেই জানি অল্পবিস্তর। এই ছবিতে তার পুরো জীবন নেই। কলকাতার হিন্দু উগ্রবাদীরা আন্দোলন করে দেশছাড়া করলে সুইডেনের পেন (পিইএন) তাকে ঐদেশে নিয়ে যায়, আর কলকাতার প্রশাসন একটা অহেতুক ঝামেলা থেকে বেঁচে যায় যদিও তার বাঘিনী সে-ঝামেলাটাকে আরো দীর্ঘায়িত করে সিনেমায়। শুরু হয় একঘরে জীবন আর বাঘিনীর জন্য পক্ষান্তরে দেশের জন্য তার দীর্ঘ হাহাকার। একটা দ্বীপে তাকে রাখা হয় সিকিউরিটির জন্য, এবং কোনো ধরণের যোগাযোগ না রেখে। এমনকি তাকে ইন্টার্নেটের দুনিয়ায়ও ডিস্কানেক্টেড করে রাখা হয়। একা একা তসলিমা হাঁপিয়ে ওঠেন কথা বলার মানুষ না পেয়ে। সিকিউরিটির লোকেরা বাংলা তো বোঝেই না, ইংলিশও না। বিরক্ত হয়ে তসলিমা তার বাঘিনী, দেশ আর উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে কাতর হয়ে ওঠেন আর লিখতে বসেন। ঐ সময়ই তিনি লেখেন তার জীবনীগ্রন্থ ‘আমি ভালো নেই, তুমি ভালো থেকো প্রিয় দেশ’, ‘নারীর কোনো দেশ নেই’ সহ আর বেশকিছু লেখা।
নারীর প্রতি পুরুষতন্ত্রের যে আচারিক বৈষম্য, চরম দৃষ্টিভঙ্গি, ভিন্ন সত্তার মেয়েমানুষ এইসব নিয়ে পুরুষদের অহংবোধ এবং পরাক্রমশালিতা যেন তসলিমাকে উস্কে দেয়। আর এইসব নিয়ে মাথা তুলে বুক টানটান করে কথা বললেই আঘাত লাগে খোদ পুরুষেশ্বরের আরশে-কুরশিতে। তাই দমন করে রাখতে চায় তারা আমৃত্যু নারীর নিজস্ব সত্তাকেই। বিজ্ঞান যেখানে স্বীকৃতি দিয়েছে পুরো মানুষিক প্রক্রিয়াতে নারী মানুষ সেখানে ধর্মগ্রন্থের গোঁজামিল জাবেদা-খতিয়ান দিয়ে পুরুষের পাঁজর থেকে অপূর্ণ সত্ত্বাধিকারী করে রাখা যেন পুরুষের আরেকটা যুদ্ধ। আর এই যুদ্ধে নারী আর দুর্বল মনে করে না নিজেকে। তাই তসলিমার উত্থানে কেঁপে ওঠে পুরুষবিশ্বের ত্রাতারা। দেশছাড়া নির্বাসন তাই নিয়তি হয়ে দাঁড়ায়।
নির্বাসন তসলিমা আর তার কন্যাকে নিয়ে হলেও এইসব বিষয় পরস্পরের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে এগোতে থাকে। দেশপ্রেম, মানবপ্রেম, জীবে প্রেম তাই আরো উদ্ভাসিত এখানে। আর বাঘিনীকে কন্যাস্নেহে দেখিয়ে মূলত আমাদের এইটা বোঝানো হয়, ভালোবাসার ক্ষেত্রে যে-কোনোকিছুই অমূল্য।
অবশেষে
শেষ হয় না এইসমস্ত সিনেমার। জীবনেরও। পালিয়ে যাওয়া নয় মাথা তুলে লড়াই করেই জিততে হয় যুদ্ধের ময়দানে। সাহসীরা জেতে। জিতবেই। হেরে গেলেও ক্ষতি নেই। এই দৃষ্টান্ত আমাদের পরের প্রজন্মে বাহিত হবে। বাহিত হবে এই প্রজন্মের নির্বাসিতদের রক্তেও। মূলত আমরা সকলেই একেকজন নির্বাসিত এই বিশ্বগ্রামে। আর আমাদের এইসব তিক্ত অভিজ্ঞতা, ঔদ্ধত্য, মাথা তোলা অন্যায়ের বিরুদ্ধে, মার খেয়েও থেমে-না-যাওয়ার লড়াই, আমরা সাবকনশাস মনে গেঁথে দিয়ে যাচ্ছি প্রজন্মান্তরে।
Film Title: Nirbashito।। Released Year: 2014 ।। Genre: Biography, Drama, News ।। Duration: 1h 48min ।। IMDb Score: 7.1/10 ।। Director: Churni Ganguly ।। Stars: Lars Bethke, Lia Boysen, Saswata Chatterjee, Churni Ganguly, Joakim Granberg, Raima Sen, Martin Wallström ।। Music Score: Raja Narayan Deb
- নির্বাসিত : প্রতিকূলে পাল তোলার গল্প || বাবুল হোসেইন - November 30, 2017
- ফিনিক্স পাখির গল্পেরা || বাবুল হোসেইন - November 22, 2017
COMMENTS