গতকাল অপেনহেইমার দেখে নানাবিধ অনুভূতি হচ্ছে। প্রথমেই স্বীকার করে নেই তিন ঘণ্টার এমন গুরুতর বিজ্ঞাননির্ভর চলচ্চিত্রের ননস্টপ ডায়ালগ সবসময় ফলো করতে পারিনি। এই ছবি দেখার আগে একটা ন্যূনতম হোমওয়ার্ক থাকা দরকার যা আমার ছিল না। এমনিতে নোলান নন-লিনিয়ার ভঙ্গিতে গল্প বলেন। টাইমফ্রেম ভেঙে দেন ইউজুয়ালি। মেমেন্তো থেকেই দেখে আসছি ফলে এর উপর যুক্ত হলো বিষয়ের জটিলতা। শেষ কবে তিন ঘণ্টা থিয়েটারে একটানা বসেছিলাম মনে নেই। আজকের ওটিটির যুগে এমন দীর্ঘ সময় একনাগাড়ে বসে থাকার প্রাকটিস কারো নেই বললেই চলে। নোলান এসব মাথায় রেখে ছবি বানাননি। ভয়ঙ্কর এক্সেন্ট্রিক নির্মাতা তিনি। যেমন তার সিনেমায় এমন একটা জায়গা পাওয়া কঠিন হবে যেখানে সংলাপ নেই। নো ফাকিং ব্রিদিং স্পেস। ছবি দেখার সময় কখনো কখনো মনে হয়েছে আমি বিজ্ঞানের ছাত্র। একটা গুরুত্বপূর্ণ ক্লাসে অ্যাটেন্ড করেছি। এমন সিরিয়াস একটা অবস্থা। পুরো সিনেমায় সিনেমাটিক প্রচলিত ফরম্যাটকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে পুরো হলটাকেই তিনি বানিয়ে তুলেছেন একুশ শতকের কলোজিয়াম। যেখানে সব অভিজ্ঞানপ্রাপ্তরা মুখোমুখি। পৃথিবীর নিয়তি ঠিক করছেন সবাই। সেই অভিজ্ঞানপ্রাপ্তদের মাঝে অপেনহেইমারকে আমার খুব নিসঙ্গ আর একাকী মনে হয়েছে। এমনকি মমতাও তৈরি হয়েছে তার জন্য। আমার পাশের বন্ধু আমাকে বললেন অপেনহেইমারের প্রতি তার পজিটিভ ফিলিং হচ্ছে এটা কি ঠিক? তাই তো! আমিও ভাবছিলাম। এদিকে আমার হোমওয়ার্ক কম, কি বলব বুঝতেছি না। নোলান তার এই ছবিতে সংলাপকে ব্যবহার করেছেন বন্দুকের গুলির মতো। কারো কথাই যেন মাটিতে পড়ছে না। প্রত্যেকটা কথার ভেতরে নোলানের ক্ষিপ্রতা বোঝা যাচ্ছিল। তিন ঘণ্টার ছবিতে কোনো জাপানিজ মানুষের বা হিরোশিমা নাগাসাকির কোনো ইমেজ দেখিনি। একদম দেখাতেও চাননি নোলান। হিরোশিমায় পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের পর একটা ইনডোর প্রজেকশনের মতো জায়গায় সামান্য কিছু তথ্য দিয়েছেন নোলান। তার এই এক্সেন্ট্রিজম অদ্ভুত লেগেছে। মনে হয়েছে বিরাট ক্ষ্যাপা কেউ-একজন কেবল একপাশের গল্পটাই বলবে। অপর পাশের গল্পটা না বলেই এই ঘটনার বিভৎসতাকে সে তুলে ধরবে। ছবিতে সাউন্ড আর ব্যাকগ্রাউন্ডস্কোর আরেকটা ভয়াবহ মাত্রা যুক্ত করেছে কারণ লুদভিগ গোরানসনের মিউজিকের লাউডনেস অনেক সময় সংলাপকে ঢেকে দিয়েছে যা ইচ্ছাকৃত। ফলে তার স্কোর ইটসেল্ফ আরেকটা ল্যাঙ্গুয়েজ নিয়ে হাজির হয়েছে। একদিকে টানটান সংলাপ সেই তালে যুক্ত হচ্ছে শব্দের ডেস্টর্শন আর আরেকদিকে খুরের মতো ধারালো স্ট্রিংস মাথার ভেতরে যন্ত্রণা বাড়িয়ে দেয়। এই সিনেমায় প্যারালাল কাটে কয়েকটা সময়কে দেখতে পেয়েছি এমনকি কোনোটা রঙিন কোনোটা সাদাকালো। এত এত চরিত্র ডিল করেছেন নোলান এবং কাউকেই অপ্রাসঙ্গিক হতে দেননি। রবার্ট অপেনহেইমারের চরিত্রে কিলিয়ান মারফি তার জীবনের সেরা অভিনয় করেছেন বলে মনে হয়েছে। ছবির শেষের অংশ আর প্রথম অংশের মধ্যে অদ্ভুত একটা ফারাক রেখেছেন নোলান। একজন বিন্দু বিন্দু করে তার গবেষণা আর নিষ্ঠা দিয়ে নায়ক হয়ে উঠলেন। যাকে বলে জাতীয় নায়ক। এরপর শুরু হলো তার কমিউনিস্ট পরিচয় আর রাশান অ্যাজেন্ট হিসেবে তাকে ট্রায়ালে বসানো। মর্মান্তিকভাবে তিনি জাতীয় বেইমানে পরিণত হন যেন। কিন্তু কী অদ্ভুত, দর্শকের তখন অপেনহেইমারের দুর্ভাগ্যের জন্য মায়া লাগতে থাকে। আমরা হলের দর্শকরা রবার্ট অপেনহেইমারের পক্ষ নিয়ে নেই যেন। এটি আমাকে বেশ ভাবিয়েছে। এ ছবির ভয়াবহ মূহূর্তটি আর বর্ণনা করলাম না সেটি হলে গিয়েই দেখুন। নিউক্লিয়ার এক্সপ্লোশোনের প্রথম সফল এক্সপেরিমেন্ট যখন হচ্ছে সেই মুহূর্তটা এই সিনেমার ক্লাসিক মুহূর্ত। এবং এই চলচ্চিত্রভাষা নোলানকে একদম আলাদা করে দেয় একুশ শতকের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে। হলিউড দিনশেষে নায়কের গল্পগুলো আমাদের মাঝে তুলে ধরতে চায়। সে র্যাম্বো বা কমান্ডো বা এভাটার কিংবা টারজান। কিন্তু এই রবার্ট আসলে কে সেকি এই আধুনিক সময়ের জোকার? মর্ষকামী কোনো কেউ? এ ছবি বিজ্ঞানকে প্রশ্ন করতে শেখায় বটে কিন্তু মার্কিন আর রাশান রাজনৈতিক পাকেচক্করে কোথায় যেন অপেনহেইমার হয়ে ওঠেন এক নিষ্পাপ হন্তারক। তার এই সিক্রেট রেসিপি যে পৃথিবীর ইতিহাস বদলে দিলো সেখানে নোলানের নির্মিত জে রবার্ট অপেনহেইমার এক বিরাট শিশু হয়ে রইল যে খেলিছে পারমাণবিক বোমা লয়ে।
- ছত্তার পাগলার সন্ধানে আহমেদ স্বপন মাহমুদ ও সরোজ মোস্তফা - January 28, 2025
- সপ্তপদীর দুপুরবেলায় সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় || ইলিয়াস কমল - January 27, 2025
- স্বরচিত কবিতার অন্তর্গত অনুপ্রেরণা || হাসান শাহরিয়ার - January 24, 2025
COMMENTS