পথের পাঁচালী : বাঙালি সম্পর্কের এক ধ্রুপদী উপস্থাপন || কাজী ইব্রাহিম পিয়াস

পথের পাঁচালী : বাঙালি সম্পর্কের এক ধ্রুপদী উপস্থাপন || কাজী ইব্রাহিম পিয়াস

একটি গ্রামীণ পরিবারের সম্পর্ক নিয়ে বিভূতিভূষণের অন্যতম ক্ল্যাসিক উপন্যাস ‘পথের পাঁচালী’-কে প্রথম সিনেমার গল্প হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন চলচ্চিত্রস্রষ্টা সত্যজিৎ রায়। জ্যঁ রেনোয়া, বিশেষ করে ইতালির নিউ ওয়েভ দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবিত সত্যজিৎ, বিভূতিভূষণের মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রীর কাছ থেকে সিনেমাটি নির্মাণ করার স্বত্ব নিয়ে আসেন তিনি। আজকের ‘পথের পাঁচালী’ এই জয়জয়কার হবার পেছনে বিভূতির উপন্যাসের বুনন মূল ভূমিকা পালন করলেও সত্যজিতের সুনির্মাণ একে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে সেরা ক্ল্যাসিকের মর্যাদা দিয়েছে। তাই চলচ্চিত্র ‘পথের পাঁচালী’ কিছু জায়গায় উপন্যাস ‘পথের পাঁচালী’-কেও ছাড়িয়ে গেছে বললে অত্যুক্তি হবে না।


যা-ই হোক, ভারতীয় সিনেমার সময় বিবেচনায় ‘পথের পাঁচালী’-র নির্মাণ সিনেমাটিকে এক উন্নতর মাত্রা দান করেছে যার কারণে আজও ‘পথের পাঁচালী’ বাংলা সিনেমায় রাজকীয় স্থান দখল করে আছে। কন্টেন্টের দিক থেকে খাঁটি দেশীয় হয়েও গোটা সিনেমা-ইতিহাসে ‘পথের পাঁচালী’ কোয়ালিটির দিক থেকে পুরোপুরিভাবেই আন্তর্জাতিক সিনেমা; যে-কারণে আজও ‘পথের পাঁচালী’ সারাবিশ্বে এতটা আলোচিত ও এতটা প্রাসঙ্গিক! চিত্রগ্রহণে, শব্দে, সংগীতে, সীমিত ডায়লগে, মন্তাজের ব্যবহারে, চিত্রনাট্য ও অন্য অনেক দিক থেকেই ছবিটি অসাধারণ! আনকোরা অভিনেতাদের কাছ থেকে দারুণ অভিনয় বের করাটাও ছিল প্রথম পরিচালনায় সত্যজিতের মুন্সিয়ানার পরিচয়।


সত্যজিৎ রায় ‘আম আঁটির ভেপু’-র স্কেচ থেকেই প্রতিটি দৃশ্যের কম্পোজিশনগুলো মাথায় রেখেছিলেন। তখনকার একটি গ্রামীণ পরিবারের গল্পের সাথে প্রাসঙ্গিকভাবে যোগ দিয়েছে ফকির বাউল, মণ্ডামিঠাইওয়ালা, বায়োস্কোপ, যাত্রাপালা তবে আলগা চাপিয়ে নয় বরং সবই এসেছে প্রাসঙ্গিকভাবে।


কাশফুলের মাঠ পেরিয়ে অপুর প্রথম ট্রেন দেখা, অপু-দুর্গার বৃষ্টিতে ভেজা, গাঁয়ের সকল বাচ্চা মিলে চড়ুইভাতির আয়োজন, হরিহরের চিঠি পেয়ে সর্বজয়ার মনের স্বস্তি, পানিপোকাদের দৃশ্যে সর্বজয়ার আনন্দ যেন প্রকৃতির মাঝেও ছড়িয়ে যাওয়া, দুর্গার মৃত্যু, দুর্গার চুরি-করা মালা অপুর খুঁজে পাওয়া এবং পাশের ডোবায় নিক্ষেপ করার পর তা আবার কুচুরিপানায় মিলিয়ে যাওয়া।


সিনেমায় আমরা আরো দেখতে পাই সুন্দর সব সম্পর্ক। এ সম্পর্ক যেন গ্রামে-বড়-হওয়া আমাদের ভাইবোনের পরিচিত সম্পর্কগুলো। দুর্গা-অপু দুই ভাইবোনের তেমনি নির্মল সম্পর্ক, ভাইজি-ফুপুর দুষ্টূমি আর আদরের সম্পর্ক, স্বামী-স্ত্রীর নিখাদ সম্পর্ক, কষ্টের সংসারে ইন্দির ঠাকরুণ ও সর্বজয়ার তিক্ততার সম্পর্ক, দুর্গার সাথে বিড়ালের ও পরিবারের সাথে অন্য প্রাণীদের সম্পর্ক।


সিনেমায় আমরা দেখি সংসারের বেহাল অবস্থায় সর্বজয়া ছেঁড়া শাড়ি পরেও দৃঢ়তার সাথে চালিয়ে নেবার সংগ্রাম, প্রতিবেশীর মালা চুরির অভিযোগে ও অপমানে মা সর্বজয়ার হাতে দুর্গার মার খাওয়া, এক প্রতিবেশীর তিরস্কার অন্যদিকে কঠিন সময়ে আরেকজনের এগিয়ে আসা যেন বিশ্বসংসারের করুণ বাস্তবতা, বৃদ্ধা ইন্দির ঠাকরুণের চেয়ে-আনা শখের ‘সাড়ে নয় আনার চাদর’ আর আরেকজনের এই উপহার যেন সর্বজয়ার দরিদ্র সংসারে কাঁটার মতো লাগে আর তাতে আত্মসম্মানে লাগা, বৃদ্ধ ইন্দির ঠাকরুণের ‘পার করো আমায়’ গুনগুনিয়ে বসে গান গাওয়া আর তার ঠিক পরের দৃশ্যেই বাঁশতলায় তাঁর মরে পড়ে থাকা, বড়বোন দুর্গা মারা যাবার পর অপু বাজারে যাবার আগে আকাশের মেঘ দেখে আবার ঘরে ঢুকে ছাতা নিয়ে রওনা হওয়া যেন সমাজসংসারে অপুর বয়সের একটা ছেলের হঠাৎ অনেক দায়িত্ববান হয়ে যাওয়া ইত্যাদি নানান আঙ্গিকে সত্যজিৎ শটের পর শট গেঁথে অনেক শক্তিশালী ইমেজ সৃষ্টি করে গেছেন।


সিনেমা জুড়ে বাঁশির করুণ সুর সাথে বীণা-সরোদের তারের ঝঙ্কারে রবিশঙ্কর মনকে কখনো উদাসী করেছেন, কখনো বিষাদগ্রস্ত করেছেন আর কখনো ফিরিয়ে নিয়ে গেছেন ছোটবেলার উচ্ছ্বাসে।


নিউ ওয়েভের সিনেমার ভাষা গ্রহণ করলেও ‘পথের পাঁচালী’ বাঙালির বুদ্ধিবৃত্তিকে জাগিয়েছিল, উল্টোস্রোতে বুক ফুলিয়ে দাঁড়াবার সাহস জুগিয়েছিল। অর্থাভাবে ৩ বছরে শেষ করা এবং তথাকথিত বাণিজ্যিক সাফল্য লাভও করেনি তবুও সময়-পরিক্রমায় আজও টিকে আছে ‘পথের পাঁচালী’। তাত্ত্বিকেরা এও বলে থাকেন যে, সত্যজিৎ নিজেই তার পরবর্তী সিনেমাগুলোতে টেক্নিক্যালি অনেক ডেভেলপ করলেও ‘পথের পাঁচালী’-কে অতিক্রম করতে পারেননি।


সত্যজিতের ‘অপুত্রয়ী’ নামে আমরা ‘পথের পাঁচালী’, ‘অপরাজিত’ এবং ‘অপুর সংসার’ এই তিনটি সিনেমাকে চিনলেও ‘পথের পাঁচালী’ অপুর চেয়ে অনেক বেশি দুর্গার ও অনেক বেশি ইন্দির ঠাকরুণের। সমানতালে প্রাধান্য পেয়েছে তৎকালীন বাঙালি গ্রামীণ সমাজ, সমাজের নানান উপাদান। বিভূতি তাঁর উপন্যাসে অনেকগুলো মানব চরিত্রের, প্রাণ-প্রকৃতির সম্পর্কের নানান আঙ্গিকের বয়ান করলেও সত্যজিৎ রায় অনেক কাব্যিক দৃশ্য সৃজন করে মানুষের আরো কাছাকাছি নিয়ে গেছেন ‘পথের পাঁচালী’-কে।

ঢাকা। ৩১ আগস্ট ২০২০

কাজী ইব্রাহিম পিয়াস রচনারাশি

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you