নয়নপুর আদৌ কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলের নাম নয়, এইটা হাওরসংলগ্ন যে-কোনো একটা গ্রামের নাম হতে পারে, এই গ্রামটা নাসরীন জাহানের ‘উড়ে যায় নিশিপক্ষী’ উপন্যাসের আখ্যান সংঘটনার জলবায়ুডাঙা।
বাংলাদেশের আর-দশটা হাওরলাগোয়া গ্রামের মতো নয়নপুরের মানুষ ও ভূগোলমানচিত্র। সুখ, দুঃখ, শঠতা, লাম্পট্য, সফেন ঝঞ্জা ও শান্তির জীবন। লোকালয় আচ্ছন্ন হয়ে আছে ধর্মের অহেতু দৌরাত্ম্য, কুসংস্কার, দোররার শাস্তি, প্রভাবশালী মানুষের ক্ষমতামদমত্ততা আর নানাবিধ ছদ্মনৈতিকতার শাসন-নিপীড়নে। এই নিরাশাপ্লাবিত জনপদের কাহিনি নিয়াই নিশিপক্ষীর উড্ডয়ন।
বছরের অর্ধেকটা পানিভাসা আর বাকি অর্ধেক রুখাশুখা হাওরের নিসর্গ নয়নাভিরাম। পথঘাট অমাবস্যায় ঘুটঘুটা আন্ধাইর, পূর্ণিমায় জ্যোৎস্নালোকিত। ওসমান এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র। বলা যায় নায়ক। ধু ধু জ্যোৎস্নাভাসা গ্রামপথ ধরে বহু বহু বছর বাদে গাঁয়ে ফেরে ওসমান। তিরিশ বছর আগে সে এই ভিটামাটি ফেলে এখান থেকে পালিয়ে গেছিল কোনো-এক অনাকাঙ্ক্ষিত হত্যাকাণ্ডের জের ধরে। ফেরে তিরিশ বছরের পরে সে, এবং উপন্যাস শুরু হয়।
পূর্ণিমায় হাওরের পানিতে ভেসে ওঠে মাঝিপুত্র কুতুবুদ্দিনের দেহ। গুম, খুন, ষড়যন্ত্র।
অত লম্বা টাইম শহরে কাটিয়েও শহরের কিছুই স্পর্শ করে না ওসমানকে, কেননা তার অস্তিত্ব জুড়ে কেবল নয়নপুর। জন্মভূমিটান। শহরের শানদারি, বিজুলি-উজল আলো, কিছুই ওসমানকে পেড়ে ফেলতে পারে নাই। ফিরে আসে সে। ফেরে ঠিকই, ফিরে সে কি করে? সেসব দেখতে হলে চাই নিশিপক্ষীর ডানায় ভর করে নয়নপুরে একচক্কর ঘুরে আসা।
ঝাঁক ঝাঁক শীতপাখি এসে বসে ওসমানের বুকে। আজন্মসাথিরা তার কাছে একবার চেনা মনে হলেও পরক্ষণে ঘটনার ফেরে হয়ে ওঠে একেকজন অচেনা। পাখি তবু ঘরে ফেরে। এসে বসে বুকে। সেই চন্দ্রস্নিগ্ধ বহুবর্ণা পাখিদের ডানাভাঁজে আটকায় ওসমানের রাত্রিচর চক্ষু।
তন্দ্রা আর আধোজাগরণের অদ্ভুত কুয়াশাকুহকঘেরা বাংলা গদ্যে নাসরীন জাহান বুনে গেছেন উপন্যাসের বিস্তৃত চরাচর। উপন্যাসটা হাতে নিলেই অবগাহন করতে চাইবেন চিরকালের পাঠকেরা।
প্রতিবেদন / তানজিলা কাদের
… …
- ভিক্টোরিয়া অ্যামেলিনা ও যুদ্ধদিনের ইউক্রেনীয় কবিতা || জয়দেব কর - February 17, 2025
- মাসুম পারভেজ : কবি, কাব্যগ্রন্থহীন || সরোজ মোস্তফা - February 7, 2025
- ছত্তার পাগলার সন্ধানে আহমেদ স্বপন মাহমুদ ও সরোজ মোস্তফা - January 28, 2025
COMMENTS