নভেম্বর হাহাকার || শামস শামীম

নভেম্বর হাহাকার || শামস শামীম

সঞ্জীব চৌধুরী। সঞ্জীবদা। তিনি গায়ক, সুরকার, কবি, গল্পকার, সাংবাদিক, অ্যাক্টিভিস্ট। যখন যে পেশায় থেকেছেন, সেই পেশায় সেরা কাজই করেছেন। দলছুট  করে ভিন্নধারার গানে তরুণদের মাতিয়ে রাখেন। দেশ-বিদেশে বিপুল ভক্তগোষ্ঠী তার। এখনো তারা তার নামে দেওয়ানা — সঞ্জীবস্মরণ করে তারা চিরঞ্জীব সঞ্জীবদাকে নিয়ে।

অনেকের কাছে তিনি গুরু, নমস্যজন। তার মাধ্যমেই আমার সাংবাদিকতার যাত্রা শুরু। মফস্বলে সাংবাদিক বানানোর আমার গুরু — আমাদের গুরু — তিনি।

২০০৫ সনে ঢাকায় গিয়েছিলাম ছাত্র ইউনিয়নের সম্মেলনে। তখন যায়যায়দিন  দৈনিক হিসেবে বাজারে আসার প্রস্তুতি শেষ করেছে। সঞ্জীবদা ফিচার-সম্পাদক। ধ্রুবদা (আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আর্টিস্ট) সঞ্জীবদাকে ফোন করে আমাকে যাযাদির সুনামগঞ্জপ্রতিনিধি নেবার কথা জানালেন। ধ্রুবদা আমাকে ফোন করে সঞ্জীবদার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, কলিআপাও — আবিদা নাসরিন কলি — সঞ্জীবদাকে আমার কথা বলেছিলেন।

ছাত্র ইউনিয়নের সম্মেলন শেষ করে পরদিন আমি আর খলিলভাই (Khalil Rahman) তেজগাঁও লাভ রোডে যাযাদিঅফিসে দাদার লগে দেখা করি। ফিচার-সম্পাদকের কাচঘেরা একটি কক্ষে দাদা কম্পিউটারে বসা। আদাব জানিয়ে ঢুকে পড়ি। ধ্রুবদার রেফারেন্সে দেখা করে যাযাদির প্রতিনিধি হওয়ার আগ্রহের কথা বলি। দৈনিক সংবাদ-এ টুকটাক লিখি সেটাও জানাই। দাদা টপাটপ সিগারেট টানছেন।

দাদা যাযাদির মফস্বল-সস্পাদক রমেন বিশ্বাসদাকে ডেকে আমার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে বললেন। বাংলাদেশের বিখ্যাত তারকা শিল্পী সাংবাদিকের সামনে বসে আমরা কথা বলছি। দাদা কাজ করছেন, কথাও বলছেন। আমরা সমীহ করে, মেপে মেপে কথা বলছি। কী তীর্যক আর মায়াময় তার চাহনি।

এর পরদিন আমার ইন্টারভিউ নেয়া হয়। ইন্টারভিউয়ে সঞ্জীবদা ও ধ্রুবদার রেফারেন্স থাকায় সবাই আমাকে আলাদাভাবে দেখছিলেন।

ফিরে আসার ১৫-২০ দিন পরেই সুন্দরবন কুরিয়ারে আমার নিয়োগপত্র আসে। খাম খুলেই দাদার অ্যাকটেল নম্বরে ফোন দিয়ে কৃতজ্ঞতা জানাই।

এভাবে প্রায়ই দাদার সঙ্গে ফোনে কথা হতো। তুই করে বলতেন। আমি তার স্নেহে ভিজতাম। দাদার সঙ্গে ফোনে কথা বলা শেষ হলে গাইতাম — “শহরে এসেছে এক নতুন পাগল / ধরো তারে ধরে ফেলো এখনই সময়” …

সুনামগঞ্জে হাসন লোক-উৎসব বিষয়ে পৌরকলেজে বৈঠক হয়। সেই সভায় মউজদীনভাই (মমিনুল মউজদীন) নানা পরিকল্পনা নেন। উৎসবে সঞ্জীবদার নেতৃত্বে শিল্পীদের আনতে দাদার সঙ্গে কথা বলতে আমাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন। আমি কথাও বলেছিলাম। নভেম্বরে মউজদীনভাইও মারা যান, সঞ্জীবদাও। একটি বড় অতৃপ্তি রয়ে যায়। নভেম্বর আমার কাছে এক-আকাশ হাহাকারের নাম। আমি থমকে থাকি। এই দু-জনকে নিয়ে কিছু লিখতে গেলে হাত কাঁপে। পরানে রেখাপাত করে।

সঞ্জীবদা মারা যাবার তিন চারদিন আগেও কথা হয়েছিল। হাওরে আসার কথা বলেছিলেন। দাদার আর হাওরে আসা হয়নি। তার গানের তরীতে শেষ ভ্রমণ হয়নি। শাদাছেঁড়া রঙিলা পালে আর লাগেনি হাওরের বাউরি বতাসের কাঁপন।

অতল শ্রদ্ধা দাদা। আপনি আপনার সৃষ্টিতে বেঁচে থাকবেন, অনন্তকাল। আপনার লক্ষ লক্ষ ভক্ত এই দিনে এখনো নীরবে চোখ ভেজায়।

কী যে একা দীর্ঘ রাত … আমি হেঁটে গেছি বিরান পথে …

শামস শামীম রচনারাশি

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you