নিখোঁজ নথের গল্প ও কথাসাহিত্যিক নূরুননবী শান্ত || সরোজ মোস্তফা

নিখোঁজ নথের গল্প ও কথাসাহিত্যিক নূরুননবী শান্ত || সরোজ মোস্তফা

শেয়ার করুন:

কুরিয়ারে কথাশিল্পী নূরুননবী শান্ত বিরচিত ‘খিদমতুল মউত’ গ্রন্থটি পেলাম। ২০২৫ সালে প্রকাশিত গল্পগ্রন্থটি গতকাল থেকে একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে শেষ করেছি। গল্পের শক্তিতেই একটা গল্পগ্রন্থ ভালো লাগে। গল্প বলার সরলতায়, অভিনবত্বে, গল্পের টানটান কাহিনি ও মৌলিকত্বেই একটা গ্রন্থ আকর্ষণ করে। যে-কোনো গ্রন্থ টানা পড়ার একটা শান্তি আছে। এতে লেখকের মনোজগৎ এবং কল্পনার জগতকেও প্রায় টের পাওয়া যায়। এই গ্রন্থটায় সময় ও সমাজের প্রবহমান জীবনের রূপ উপস্থাপিত হয়েছে। সময়ের ভেতরে বসবাসরত মানুষের বিচিত্রতর জীবনানুভবই ‘খিদমতুল মউত’।

‘খিদমতুল মউত’ মানে মৃত্যুরত মানুষের সেবা করা। মানুষের কত রকমের ব্যবসাবাণিজ্য যে হতে পারে—ইচ্ছামৃত্যুর আয়োজন করাও এমন একটি ব্যবসা। বোঝাই যাচ্ছে লেখক গল্প বলতে বলতে বর্তমান থেকে অতিবর্তমানে প্রবেশ করেছেন। একটি মানুষ কেন ইচ্ছামৃত্যুর পথে হাঁটে? পাওলো কোয়েলহোর উপন্যাসে দেখি ‘যখন কেউ স্বপ্ন দেখতে শুরু করে তখন তাবৎ পৃথিবী সেই মানুষটির স্বপ্ন পূরণে সহায়তা করে’। কিন্তু ‘খিদমতুল মউত’ গ্রন্থের নামগল্পে আমরা উলটো চিত্র দেখি। দেখি পঁচিশ বছর তেত্রিশ দিন অতিক্রম করে গল্পকথক খিদমত আলমউতের রেজিস্ট্রেশন করেছে। ইচ্ছামৃত্যুরও কারণ থাকে। গল্পকথক যার বিভাগে প্রথম হওয়ার কথা, ফ্যাকাল্টিমেম্বার হওয়ার কথা, সেখানে সবার চক্রান্তে সে ‘রিপোর্টেড’ হয়েছে। বোর্ড চেয়ারম্যান, ইনভিজিলেটর, সহপাঠী সবাই তাকে রিপোর্টেড করে দিয়েছে। সবাই তাকে নিয়ে হাসাহাসি করছে। যার বর্তমান মরে যায় তার কোনো ভবিষ্যৎ থাকে না। তাই সে চড়া মূল্যে খিদমতুল মউতে রেজিস্ট্রেশন করে। কারণ সে বলে : ‘আমার অতীত মুছে গেছে অতীতবিস্মরণের তোড়ে। এবার ভবিষ্যৎ থামিয়ে দিতে হবে।’

আমাদের সমাজে একটা কথা প্রচলিত আছে, ‘স্যার-ম্যামদের আনুকূল্য ছাড়া টপার হওয়া সম্ভব না।’ কিন্তু যারা পড়ালেখার ভেতরে থাকে, যারা মেধা এবং অধ্যয়ন দিয়ে টপার হতে চায় তারা কি করবে? গল্পকথকের কথাই ধরুন। তার মা বলেছে : “মানুষ কেবল সফলই হবে, ব্যর্থদের জন্য কোথাও কিছু থাকে না। আমি সারাদিন সারারাত জেগে মেহেনত করেছি বলেই নাকি আমি ডিপার্টমেন্টের টপার। আমার টপ পজিশন কেউ অতিক্রম করতে পারেনি। ‘তাই করি নাকি?’, আমি মাকে বলি, ‘তাই করেছি আমি?’ মা বলে যে, ‘এখনও তাই করতেছিস। না ঘুমায়া তুই স্টিকি পেপারে নোট লিখতেছিস, বইপত্র আউলায়া বসে থাকতেছিস…।”

কিন্তু শেষ রক্ষা কি হয়? হয় না। বর্তমানের ভার বহন করতে না পারলে কারো ভবিষ্যতও থাকে না। পুরো গল্পটার ভেতরে বাস্তবতার ভিতরেও একটা অতিবাস্তবতার রঙতুলি আছে। একটা ইচ্ছামৃত্যুর ভেতরে কত রকম সত্য যে থাকে তার একটা আয়োজন আছে। “এই প্রেক্ষাপটে নিজের মৃত্যু নিশ্চিত করার সিদ্ধান্ত সমাজ ও নগর কর্তৃপক্ষ সবার জন্য স্বস্তিদায়ক। মা মিস করবে আমাকে। তবে একসময় সয়ে যাবে। কিন্তু অন্ধকার ও অপমানে বিপর্যস্ত এক সম্ভাবনাময় সন্তানের সন্ত্রস্ত রূপ মায়ের সহ্য হবে না। অভিভাবকত্ব-দায়ের চাপে উল্টো আমাকেই দায়ী করবে। বলবে, ‘জীবন সবাইকে উপহাস করে না তো! তোর কেন এত সমস্যা? সবাই মিলে তোকেই কেন থামিয়ে দিতে চায়? আর কাউকে নয় কেন? তুই না টপার! তবু! নিশ্চয় তোর দোষ আছে! তোর আচরণগত সমস্যা আছে। এই সত্যি করে বল তো, তুই নাকি ডিরেক্টরের রুমে…’ সুতরাং, মায়ের জন্য কিছুদিন বিষম বিলাপের পর স্বাভাবিক জীবন শুরু করাটা সম্মানজনক হবে। ভবিষ্যতে মা বলবে, ‘এ দেশ ওকে ধরে রাখতে পারল না!’…”

কথাশিল্পী নূরুননবী শান্ত নিজেও সহজিয়া মানুষ। সহজিয়ারা সহজ দৃষ্টিতে মানুষের ভেতরকে পড়তে পারেন। আমরা যতই বস্তুবাদের তাঁবুতে থাকি না কেন, প্রকৃত বস্তুবাদকেও সহজিয়া জ্ঞানে স্পর্শ করা লাগে। তাই এই বইয়ের ভাষাও সহজ। পড়তে ভালো লাগে। জগৎ জীবনের নিগূঢ় সত্যকে ও রূপরূপান্তরকেই লেখক আন্তরিক ভাষায় উপস্থিত করেছেন। সহজ ভাষায় সময় ও আগামীর চিরায়ত সত্যরূপকেই তুলে ধরেছেন এই গ্রন্থে।

এই গ্রন্থে গল্প শুধু গল্প নয়। জীবন ও সময়ের ইঙ্গিত। জীবনের রূপ-রূপান্তর ও দর্শন। নয়টি গল্পেই বহুরূপে আমাদের সমাজবাস্তবতাই চিত্রিত হয়েছে। ‘হারিয়ে যাওয়া নথ’ গল্পটা শুধু বুড়িমার নথ হারানোর গল্প নয়। এক নিঃসঙ্গ অমাবস্যার রাতে বুড়িমার মরে যাওয়ার সাথে সাথে তাদের পরিবারের প্রাচীন রূপ ও শৃঙ্খলাও হারিয়ে যায়। মৃতের নাকের নথ কে চুরি করবে? গল্পের প্রবাহে আমরা বুড়িমার বেঁচে থাকার ঐশ্বর্যময় অতীতকেই দেখতে পারি। সেই অতীত নিয়েই বুড়িমা চলে গেছেন। তার নথও হারিয়ে গেছে। গল্পে নথ শুধু নথ নয়। নথ একটা বন্ধন। নথ একটা সৌন্দর্য। আবহমান বাংলার চিরায়ত সৌন্দর্য। সেই সৌন্দর্য যে হারিয়ে গেছে তারই ইঙ্গিত এই গল্প।

আমাদের আসরের গায়কেরা যেভাবে সহজ ভঙ্গিতে সুর নামাতে থাকেন এই গ্রন্থে কথাশিল্পী নূরুননবী শান্ত সেভাবেই গল্পগুলো নামিয়েছেন। কাঠিন্য নেই, কথন-বয়ানের নিজস্ব সরলতাই এই গল্পগুলোর শক্তি।


সরোজ মোস্তফা রচনারাশি
গানপার বইরিভিয়্যু

শেয়ার করুন:

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you