কবিতায় বক্তব্যময়তার উল্টোপিঠে যেইটা থাকে বলে শুনেছি, — ইঙ্গিতময়তা, ইশারাধার্মিকতা, ব্যঞ্জনাঋদ্ধতা, দ্যোতনাবৈভব — ইত্যাদি জিনিশগুলো নিয়া আমিও পুরাকালে ব্যাপক দুশ্চিন্তাভাবিত হয়েছিলাম। বর্তমানে একটু কম দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। প্রসঙ্গত আমার পজিশন হলো, বক্তব্যও আমাকে যেমন একাধিক/শতেক ইঙ্গিতের দিকে নিয়া যায়, ইঙ্গিতও বক্তব্যের দিকে বা বক্তব্য গড়ার দিকে ধাবিত হতে প্ররোচিত করে বৈকি। ইঙ্গিত চায় বক্তব্য হতে শেষমেশ, যেমন বক্তব্য চায় ইঙ্গিত বিকিরণ করিবারে। এই মামলা আমি নোটিস করেছি ওভারঅল আমার কবিতাপাঠের স্বল্পদৈর্ঘ্য অতীতকালে। ব্যক্তিগত স্মৃতি-সত্তা-ভবিষ্যৎ আর অন্তর্গত/বহিরস্থিত ইতিহাসের ওপর ভর করে এই খেলাটা, বক্তব্যময়তা আর ইঙ্গিতময়তা হরিহরআত্মার এই খেলা, কবিতার নন্দনগত নিয়ামক বলেই মনে হয়। কিন্তু প্রচলিত কবিতালোচনায় একপেশে ইঙ্গিতের জয়ঢাক বাজানো হয় ফিরেঘুরে বারেবারে এবং করা হয় বক্তব্যের নিকুচি। মনে করা হয় যেন বক্তব্য খর্ব করে কবিতার কবিতাত্ব। মনে হয় না বা আমার মন মানে না ব্যাপারটা আদৌ পুরো সত্য বলে। কেন, বলব, ক্রমশ।
বক্তব্য কবিতার টেক্নিক হতে পারে, হয়, হতে এবং দিব্যি উৎরাতে দেখেছি ব্যক্তিগত কবিতাপাঠের স্বল্পকালীন অভিজ্ঞতায়। এ-মুহূর্তে সেসব শেয়ার করার তৌফিক নাই। যে-কোনো কবিতায় একটা লাইন, পুরা লাইনও নয় বরং বলা ভালো লাইনাংশ হাতে নিলে দেখা যাবে, আরে, এই জায়গাটা তো বক্তব্য ও ইঙ্গিত দুইটাই মনে করা যায়! একটা ইতিহাস তো হুড়মুড়িয়ে এসে যায় এইখানে, যে-কবিতায় সাপোজ ক্যাপচার করা কাপ্তাই হ্রদ আর আমাদের বিদ্যুৎসভ্যতা বানাবার সকরুণ ইতিহাস; আমি নিজে এই ইতিহাসের করুণ দিকটা নিয়া খানিক জানিশুনি আর সংহতি প্রকাশ মনে মনে হলেও করি বলেই উদাহৃত লাইনাংশটা আমার কাছে একশপাতা আর্টিকেলের চেয়েও বক্তব্যদ্যোতনাব্যঞ্জনাবহ; কবিতারই তো অন্যতম দায়িত্ব এইটা, একশপাতার বেদ ও বেদনা পাঁচশব্দে পুরে ফেলা; কাজেই, বক্তব্য ও ইঙ্গিত সদা সাংঘর্ষিক নয়; কেবল ভাষণ/প্রভাষণা/বাগ্মিতা না-হলেই হলো।
ফট করে মনে পড়ে গেল বলে একজন কবির নাম শুধু উচ্চারিয়া যাই, যাকে আমরা সকলেই পড়েছি ‘দেশে ফেরার খাতা’ নামের একটা বইয়ের সুবাদে, অ্যাইমে স্যেজেয়ার সেই কবির নাম, স্যেজেয়ারের কবিতায় বা আরও বহুল পঠিত পাবলো নেরুদার কবিতায় ব্যবহৃত পঙক্তির বক্তব্য ও ইঙ্গিত আলগ করা বা ফারাক করে দেখা কি ডিফিকাল্ট হয়ে যায় না? বা আমাদের বাল্যশিক্ষার জীবনানন্দ থেকেও আমি অসংখ্য-অজস্র জায়গা পাই যেখানে বক্তব্য-অব্যক্ত অঙ্গাঅঙ্গী; বক্তব্য দ্যুতিঠিকরানো, ইঙ্গিত ফলত সহনীয় প্রহসনহীন ও সুপ্রবেশ্য হতে পেরেছে; এইটা আমার, নিতান্তই একান্ত, মনগড়া বানোয়াটি বীক্ষণ হয়তো। তো, হোয়াটেভার, কবিতাপাঠক, রসভঙ্গ ঘটালাম না তো? কবিতাপাঠ চলাকালে চোখ-কান-মন সজাগ রেখে সো-ফার বকবকানির বাহন মুখবিবরযন্ত্র অফ করিয়া রাখাটাই তো বাঞ্ছনীয়; কে যেন বলেছিলেন, প্রোব্যাব্লি বিনয়, কবিতা পড়ার পরবর্তী কিছুকাল নিদ্রিত রইতে পারলেই শ্রেয়।
কথাটা তাহলে এ-ই যে, অন অ্যা সিরিয়াস নোট, কবিতার বক্তব্যময়তা নিয়া আমি নিজেও খুব যে সাচ্ছন্দ্য বোধ করি, ব্যাপার মোটেও তেমন নয়। আবার, এইটাও সবসময় ভাবি যে আমাদের কবিতা একটা ম্যাসিভ কানেক্টিভিটির খোয়াবে একদমই ডিসকানেক্টেড থেকে যায়, ডিসকানেকশনের ময়দানে সলিটারি হয়া থাকা আখাম্বা তালগাছ একটার নাম বোধহয় আধুনিক কবিতা, বা সাধের অধুনান্ত/উত্তরাধুনিক, মনে হয়। এইখানে একটা মাঝভাগ বা মিডল গ্রাউন্ড আছে কি না, ভাবতে চাই। কিংবা আল্টিমেইটলি কবিতার যেই নেইল ডাউন করার শক্তি থাকে সেইটা আরও এফিশিয়েন্টলি কীভাবে প্র্যাক্টিস করা যায়, সেইটা ভাবি।
মিডল গ্রাউন্ড খোঁজার যে-কোনো অভিযানে এই অ্যানশিয়েন্ট কবিতাপাঠকের স্যলিডারিটি থাকল। ফলে এই চির্কুটে এক-দুইছত্র। সবিশদ নিবন্ধনোটে এই কাজটা, মাঝভাগ/মধ্যভূম খননতল্লাশকর্ম, আরম্ভ করতে পারলে বেহতর হতো। সহসা না-হোক শুভক্ষণ দেখে দরকার শুরু করে দেয়া। আল্লা ভরসা।
- আত্মহন্তার অন্তরাত্মা - June 25, 2025
- আমার জয়দেব - June 19, 2025
- অজিত পান্ডে রেমিনিসেন্স - June 15, 2025
COMMENTS