কবি ও কোমল পানীয় বয়কটিং ট্রেন্ড

কবি ও কোমল পানীয় বয়কটিং ট্রেন্ড

শেয়ার করুন:

 

পরিত্যাগকরণের একটা সাড়ম্বর সংস্কৃতি বিরাজ করে এই দেশে বারোমাস। ঘোষণা দিয়া আড়ম্বর করে নির্বিচারে অস্বীকারকরণ। নয়া জামানার সমাজমাধ্যমে এই চর্চা আরও বেশি করে নজরে পড়ে আগের যে-কোনো সময়ের তুলনায়। ডিক্লেয়ারপূর্বক হৈ হৈ চিৎকারে আনফ্রেন্ড করা, আনফলো, ব্লক ইত্যাদি বিচিত্র পরিত্যাগপদ্ধতি ইস্তেমাল করা হয়ে থাকে দেখতে পাই। ঠিক কী কারণে এই নিষ্ঠুর অভিমান ও তৎসঞ্জাত বীতরাগ তা সম্যক বোঝা না-গেলেও পরিত্যাগকারীর পক্ষ থেকে রীতিমতো নীতি ক্লিয়ার করা হয় অবন্ধুকরণ অভিযান শুরুর কয়দিন আগে থেকে। এরা রবীন্দ্রনাথকেও অস্বীকার করেন যখনতখন, নজরুল জীবন তো করেনই, দূরে ঠেলে দেন দুনিয়ার যে-কাউরেই। অস্তিত্ব অস্বীকার করেন অমায়িক সকলের, শুধু নিজেরে কেন্দ্রে রেখে এরা জানেন দুনিয়া বিহার করে যেতে। এদের কাছে কবি ও কোমল পানীয় উভয়েই সমান পরিত্যাজ্য, যখনতখন, বয়কটযোগ্য।

কুটুম্বিতা বজায় রেখে বেঁচে-থাকা এই জামানায় সহজ কাজ নয়, সাশ্রয়ী তো নয়ই, ঢের খর্চাপাতি আছে। যেমন ধরুন, ঐতিহ্য অনুসারে আমাদের ভূখণ্ডে ইষ্টিকুটুমের বাড়ি বেড়াতে গেলে একটা-কিছু তোফা নিয়া যাওয়া হইল রুসম। সাধারণত সেইটা খাদ্যদ্রব্য। ধরুন, সবচেয়ে লোয়ার গ্রেডের মিষ্টি নিয়া যাইলেও কমের পক্ষে দেড়শ-সোয়াদুইশ তনখা! কাজেই ইষ্টিকুটুম অস্বীকারকরণ হইতে পারে একটা কার্যকর জান বাঁচাইবার উপায়। জান বাঁচাইয়া কোনোমতে ভুজুংভাজুং দিয়া বাঁচিয়া যাওয়াটাই তো ফরজ কর্ম।

তো, কুটুম্বিতা ত্যাগের নগদ কিছু মুনাফা আছে নিশ্চয়, কিন্তু লং-রান বিপদটাও কম নয়।  কেননা নিজেরেই ঋদ্ধ করতে কুটুমখেশটা লাগে। এখন রবীন্দ্রনাথ বা আরও প্রমুখদের সঙ্গে ভাব বজায় রেখে যাইতে হইলে মিনিমাম যেটুকু পড়াশোনা রিকোয়ার্ড, তা তো আমার সাধ্যির বাইরে। এত পরিশ্রম, মগজ খাটানো, সম্ভব হইলেও সময়সাপেক্ষ ও হাইলি এক্সপেন্সিভ। আমার দরকার শর্টকাটে ক্রোড়পতি বনা।  দ্যাট ইজ টু স্যে, শেয়ার কেলেঙ্কারি, সিন্ডিকেইটেড অথবা সলো কম্যার্শিয়াল পার্ফর্ম্যান্স। বিসাইডস্, মুই হনু স্বয়ং গবুচন্দ্র মহারাজা। আমারে স্বীকৃতি দিতেই মহাকাল ময়রার দোকানে বেঞ্চিতে বসে আছে, আমি আবার কারে স্বীকার করমু! অলরেডি স্বীকৃত আমি, লিলুয়া বাতাসী মাসিক পত্রিকা আর বজ্রপাতী ব্যাংক আমারে শ্রেষ্ঠ কবি স্বীকৃতিশিরোপা দিসে, এখন আমি আল্লার রহমতে স্বীকৃত-স্বনির্ভর। কেউ আমার কবিতা পড়ল কি পড়ল না, তা দিয়া আমার কচুটা-ঘেঁচুটা হয়, আমি জানি আর আমার পত্রিকা ও ব্যাংক জানে আমি দি বেস্ট।

গোপন কথাটা, মানে আমার সেলেব্রিটিত্বের গোপন রহস্য, বলেই ফেলি এইবার। ব্যাপারটা হলো এ-ই যে, আমি নিজে তো বিশেষ পড়ি-টড়ি না আজকাল আর, এইসব কোথাকার কোন রবীন্দ্র-নজরুল-জীবন-সুধীনদের কথা আড্ডায় উঠলেই ‘নিপাত যাক’ ধ্বনি তুলিয়া সেইফ সাইডে থাকি। কেউ তখন আর জিগাইতে যায় না সাহস করে আমারে, যে, আব্বুসোনা, চান্দু আমার, রবীন্দ্রনাথের ‘জুতা আবিষ্কার’ বা ‘হিং টিং ছট’ প্রভৃতি পড়েছ নাকি? পড়িয়া থাকলে আটলাইন মুখস্থ কহ তো! পরিস্থিতি যাতে ওইদিকে না-যায়, তাই তো আমি বিলাই পয়লাই ফিইক্কা মারি তিনশ কিলোমিটার দূর দিয়া। যদিও জানি যে টেক্নিক হিশেবে এইটা আদ্দিকালিক, আই মিন কৃত্তিবাসী আমলের, তবু এর একটা ফায়দা যদ্দিন পাওয়া যাচ্ছে এস্তেমাল করিয়া যাইতে মন্দের কিছু তো দেখি না। ভালোই তো, গুরুদেব জীবিতাবস্থায় যেমন চেলাচামুণ্ডাবেষ্টিত রইতেন, সমানসংখ্যক বা কাছাকাছি সংখ্যার চেলাচামুণ্ডা আমারও তো হইসে মাশাল্লা, যদিও আমার দশকও হয় নাই উমর, তা গুরুদেবের সনে লেখায় কুলিয়ে উঠতে না-পারি, চেলাচামুণ্ডায় আমিই-বা কম কিসে!

চেলাচামুণ্ডাও আমার এহেন অস্বীকারকৌশলে মুগ্ধ, গুরু-গুরু আওয়াজে অজ্ঞান, যেহেতু ওদেরও পড়াশোনার মতো ভুয়া কারবারে দিনাতিপাত না-করিয়া পাট্টায়-গেলাশে সৃজনশীল শমশেরবাজ হইয়া আমোদে পাণ্ডারাজ কায়েম করা সম্ভব হইতেসে। এবং কথাটা আলগোছে বলি, যে, এইগুলার একটা খান্দান বা সিলসিলা তো লাগে। আমি ট্র্যাডিশন ও ইন্ডিভিজুয়্যাল ট্যালেন্টের কথা বলতেসি, এলিয়টের কথা বলতেসি, এখন আপনি যদি মুফতে-পেয়ে-যাওয়া ব্যাংকস্বীকৃত কবিসিংহ হন, তো আপনার নিজের মুখেই নিজের বংশ ঘোষণা করিতে হইব, স্বকপোলকল্পিত কুলাঙ্গার বংশেরে দিতে হইব প্রয়োজনীয় পত্তনি-প্রতিষ্ঠা। কাজেই একটু গতরজোর, মুস্কমোটা নাপারগ বলদগিরি, এইগুলো দরকার তো। লোকে বাপদাদার নাম জিগাইলে তো মুশকিল, থাকলে তো বলবেন, যদি উপরন্তু ফ্যামিলিট্রি জিগায়া বসে তাইলে তো ভরা মজলিশে জিপার অবমুক্ত-উদোম হইয়া যাইবার লজ্জায় পড়া ছাড়া উপায়ান্তর থাকবে না। কাজেই রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ অস্বীকারের উপর দিয়া জান বাঁচানো। লজ্জা নিবারণ। পণ্ডিতি। নিরাপত্তাহীনতার বোধ ছাড়া এইসব আর কিচ্ছু না তো। পুঁজিপাত্তিহীন ব্যবসা, আমদানী তো কমও নয়, এখন সময়ও নাই নিজের চুরিচামারি-নিকাম্মা কাব্যকর্তৃত্ব বজায় রাখিতে যেয়ে ফের নতুন করে ট্রেইনিং-পড়ালেখার ভিতর দিয়া যাওয়ার। তো চলুক।

ছোটবেলায় যে-জিনিশ পড়ার কথা, ধরুন সুকুমার রায় বা ধরুন হুমায়ূন ভ্রাতৃদ্বয়, তা যদি না-হয় তখন যে-একটা বিকলাঙ্গ বিকাশ হইবার কথা, তা-ই হইতেসে আমাদের এইসব কবিতাব্যবসায়, এইসব শাহবাগে কণ্টকারণ্যে ফেসবুকে ও সিলেটে ও শান্তাহারে ও সমাজে-সোসাইটিতে। এইসব কিসিম-কিসিম বিপ্লবীদের আধাইঞ্চি মুরদের আটষট্টিইঞ্চি বিচি তো অনেক দেখসেন আপনি, আমিও তো কম দেখি নাই। কিন্তু অডিসি নামে এক মহাকাব্য অলরেডি বিরাজ করতেসে যেহেতু, মুই আর না-লিখিনু নুতন করিয়া। আর দোয়া রাখবেন, আল্লা যেন আমাদিগেরে কাব্যগলাবাজির ভিতর দিয়া পার করাইয়া দেন সহিসালামতে মহাকালসমুদ্র ও সমূহ সৃজনসিন্ধু। দোয়া বাদ অট্টহাস্য।

জাহেদ আহমদ


এই সিরিজের অন্যান্য রচনা

শেয়ার করুন:

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you