বাংলার বাউল পদকর্তা আর ওদিকে উত্তর ভারত (*বিশেষ করে পাঞ্জাব প্রদেশ) আর অধুনা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত সিন্ধু প্রদেশের সুফি কবিগণ রচিত কালামের তুলনামূলক পাঠবিশ্লেষণ ওরফে ব্যবচ্ছেদকে একত্রে জুড়ে মারকাটারি কাজ কি নামানো সম্ভব? যেমন ধরেন, বুল্লে শাহ ও লালনের জীবনজার্নির মধ্যে প্রচুর মিল চোখে পড়ে। সিপাহী বিদ্রোহের বছরে বুল্লে শাহ ইন্তেকাল ফরমান। অনধিক বছর কুড়ির মধ্যে লালন দেখা দিলেন। সমাজ কর্তৃক দাগানো আত্মপরিচয়ের সমস্যায় জেরবার সন্ত কবীরের সঙ্গে বুল্লে ও লালনের ভাগ্য প্রায় অভিন্ন মানতে হয়। অকথ্য অপমান আর ঘৃণার হুতাশনে তাঁরা দগ্ধ হইসিলেন সেই সময়। প্রায় অভিন্ন সময়তরঙ্গে দেখা দেওয়া বুল্লে ও লালনের আত্মউপলব্ধির মধ্যে যে-কারণে অপার সাদৃশ্য দেখতে পাই। ভাষা, গায়নপ্রণালি ও সাধনতরিকার বিচারে দুজনের পথ যদিও আলাদা বাঁক নিয়াছিল সেই সময়। সাধনমার্গটা সেখানে পৃথক কিন্তু অন্তরে গুঞ্জরিত জীবনযাতনা, সামাজিক অনাচার ও ধর্মীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে তির্যক উপমায় গাঁথা গানের কলি তাঁদের আত্মিক বন্ধনকে একসূত্রে গিল্টি করেছিল। বাংলা ও পাঞ্জাবের মরমি গানের মিল-বেমিল সন্ধানের ছলে সময়, সমাজ ও জীবনবেদকে যদি ক্রোড়পত্রের মোড়কে হাজির করা যায় তাহলে টাকরায় চমৎকার স্বাদ পাওয়া যাইতে পারে।
সঙ্গে যোগ করি, কবীর প্রজেক্ট-র আওতায় শবনম ভিরমানি বিরচিত হাদ আনহাদ : জার্নিস উইথ রাম অ্যান্ড কবীর এবং কবীর খাড়া বাজার মে : জার্নিস উইথ সেক্রেড অ্যান্ড সেকুলার কবীর নামক দুইখানা ডকুমেন্টারিকে ক্রোড়পত্রে প্রাসঙ্গিক করা সম্ভব। ভারত উপমহাদেশে সন্ত কবীরের জীবনবেদ চর্চার হালত শবনম ক্যামেরায় ধারণ করেছেন। কবীর নামের মানুটা সত্যি কে ছিলেন আর বর্তমান সমাজ তাঁকে কোন পথে বিচরায় ইত্যাদির ব্যবচ্ছেদে তাঁকে কামিয়াব মানতে হয়। কবীরকে ঘিরে তৈরি হওয়া মেকি মুগ্ধতা, তাঁর গানের উদ্দেশ্যমূলক ব্যবহার, সেইসঙ্গে কবীরচর্চায় বহমান আয়রনি ক্যামেরায় তুলে ধরতে সফলকাম হইছেন।
করাচি শহরে বংশ পরম্পরায় প্রায় সাতশো বছর ধরে কাওয়াল গানের ধারক-বাহক ফরিদ আয়াজের কবীরবীক্ষণকে শবনম ক্যামেরায় তুলে আনছিলেন। মুখে পানের খিল্লি ঠেসে আয়াজের পাঞ্জাবি-ফার্সি-উর্দু বা হিন্দি ভাষায় বিরচিত কালাম জপের দৃশ্য কাওয়ালরসিক শ্রোতা-দর্শকের অজানা নহে। এহেন জীবনরসিক কাওয়ালের মুখে রাম-রহিমের দ্বন্দ্বে জেরবার ভূবর্ষে হাদ ও আনহাদ বা জগৎ জুড়ে বিরাজিত ধরা ও অধরার তালাশমগ্ন কবীরকে উন্মোচিত হইতে দেখার ক্ষণে লালনের কথা বারবার মনে পড়ে। কবীরের সঙ্গে তাঁর মিলন ও বিচ্ছেদ থাকলেও সমাজ সংস্কারের জায়গায় তাঁরা হরিহর আত্মা। শবনমের অনুসন্ধানে মূর্ত কবীরচর্চার হালত অন্যভাবে বাংলাদেশের আখড়া ও তার বাইরে লালনচর্চার খবর নিতে ও পাঠব্যবচ্ছেদে মনকে উতলা করায়।
বাংলাদেশে ফরহাদ মজহার, সলিমুল্লাহ খানরা লালনের এক প্রকার পাঠব্যবচ্ছেদ করেছেন। শক্তিনাথ ঝাঁ বা সুধীর চক্রবর্তী পৃথক দৃষ্টিকোণ হইতে ব্যবচ্ছেদটা সেরেছিলেন। সাইমন জাকারিয়া, আবদেল মান্নানরা খানিক কাজ করেছেন জানি। আরো থাকতে পারেন এ-রকম। সকলের ভাবনা ও ব্যবচ্ছেদ বিবেচনায় রেখে আখড়ায় সাক্ষাৎ বাউলসঙ্গ যারা করছেন তাদের লালনবীক্ষণকে এইবার পাখির চোখ করা যাইতে পারে। আখড়ার বাইরে আমজনতার লালনচর্চার প্রবণতাও সেখানে বিবেচ্য হবে। সকল কিছু গড় করে নিজের জায়গা থেকে বক্তব্য রাখতে পারেন এমন কাউকে বিছড়ানো গেলে মনে রাখার মতো একটা কাজের জন্য ওই পত্রিকা পাঠকের সাধুবাদ পাইবেক।
তাৎক্ষণিকামালা
আহমদ মিনহাজ রচনারাশি
- মুহাম্মদ শাহজাহান : অগ্রন্থিত প্রস্থান - March 15, 2023
- বইয়ের খবর লেখকের জবানে / মুমূর্ষু খয়েরি রাত ও শিবু কুমার শীল - February 28, 2023
- মাসানোবু ফুকুওকা : এক তৃণখণ্ডের প্রতিরোধ || আহমদ মিনহাজ - February 28, 2023
COMMENTS