ওপেন এ্যায়ার কন্সার্টের রাগী ঘোড়া || উপল বড়ুয়া

ওপেন এ্যায়ার কন্সার্টের রাগী ঘোড়া || উপল বড়ুয়া

আমার প্রথম গান শোনাটা শুরু হয় জেমসকে দিয়ে। তখন গ্রামে থাকি। স্কুল থেকে ফেরার পর বড়ভাই বাজিয়ে দিতেন ‘দুঃখিনী দুঃখ করো না’ কিংবা “সবাই বলে ঐ আকাশে লুকিয়ে আছে / খুঁজে দেখো পাবে দূর নক্ষত্র মাঝে।” আমি সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট, পায়ে দুই ফিতা স্যান্ডেল পরে স্কুলে যাওয়ার সময় একেকবার গলা একটু মোটা করে চিৎকার দিতাম — ‘ফুল নেবে না অশ্রু নেবে বন্ধু।’

তখন কেবল জেমসের নাম জানি। হাসান বা আইয়ুব বাচ্চুকে যেমন চিনি তেমন। প্রমিথিউসের বিপ্লবকেও অল্প চিনতাম। তারপর একদিন শুনলাম, রামু উপজেলায় জেমসের কন্সার্ট। আমি তখন ক্লাস ফোর। আমি প্রথম স্কুল পালালাম। কিন্তু পালিয়ে দেখি আশা বিফল। জেমস আসে নাই। জেমসের গান গেয়ে স্টেজ মাতাচ্ছিল আরেকজন। আমাদের প্রসূন মামা। তাদেরও এ্যাসেন্স নামে একটা লাইনআপ ছিল। গান করত জেমসের। মাকসুদকেও কাভার করত মাঝেমধ্যে।

এসবের বহু বছর পর জেমস এলেন কক্সবাজারের হোটেল সিগালে। চারশ টাকা করে এ্যান্ট্রি ফি ছিল সম্ভবত তখন। দুইহাজার কি দুইহাজার-এক সালের দিকে হবে। দর্শকও ছিল নির্দিষ্ট। যেতে পারিনি। পরে থার্টিফার্স্ট নাইটে প্রথম জেমস দর্শন। জেমস তো ওপেন এ্যায়ার কন্সার্টের রাজা; যিনি গান শুরুর আগে গিটার হাতে স্টেজে উঠলেই শ্রোতাদের ভেতর শুরু হয়ে যায় উন্মাদনা। জেমস এমনই উন্মাদনার নাম।

অনেক পরে জেনেছি রকস্টারদের হতে হয় জেমসের মতো। জেমস একেকটি বিষণ্ন সন্ধ্যায় গিটার হাতে শ্রোতাদের পাগল করে দিতেন। দেখা যেত — শার্টের বোতাম খুলে বা শার্ট উপরে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পাগল শ্রোতারা জেমসের সাথে গলা মিলাচ্ছে। অথবা লাফ দিয়ে দিয়ে গাইতেছে — ‘দিওয়ানা দিওয়ানা, আমি তোমার দিওয়ানা’ বা “লিখতে পারি না কোনো গান আজ তুমি ছাড়া / ভাবতে পারি না কোনোকিছু আজ তুমি ছাড়া / কী যে যন্ত্রণা, এই পথচলা / বিরহস্মৃতি তোমাকে ঘিরে / তুমি জানো না।”

Faruk Mahfuz Anam James

সেসব জেমসীয় ঘোরের দিনগুলির ভেতর একদিন খবর ছড়িয়ে পড়ল, জেমস কারাগারে! জেমস বন্দী! আমরা কিশোর তখন। মাথার ভেতর খালি কিলবিল করে “দিনরাত এখানে থমকে গেছে / কন্ডেম সেলের পাথরদেয়ালে / প্রতি নিঃশ্বাসে মৃ্ত্যুর দিন আমি গুনছি / শোনো, জেল থেকে আমি বলছি।”  আমাদের মধ্যে জেমসের জন্য যন্ত্রণা হয়। ভাবি ঘর পালিয়ে যাব। জেমস কোথাও-একটা তীব্র যন্ত্রণা গেঁথে দিয়ে গেছেন আমাদের। আজও সেই দুঃখকে খুঁজে ফিরি। শৈশবে যেভাবে জেমসকে শুনেছি এখনও একই অ্যাপিল নিয়ে আছেন জেমস। এখনও আনমনে বেজে ওঠে — “কিসের এত দুঃখ তোমার সারাক্ষণ বসে বসে ভাবছো / পৃথিবীতে বলো বাঁচবে কয়দিন / সময়টা বড়ই অল্প … হতেও পারে এই দেখা শেষ দেখা/ হতেও পারে এই গান শেষ গান।”  

ফিলিংস  থেকে বের হয়ে জেমস যেন একটু ঝিমিয়ে পড়লেন্। সেই স্টেশন রোড, অনন্যা, জেল থেকে বলছি, পালাবি কোথায় অ্যালবাম-সবের কথায় এখনও নাইন্টিজেজের লোকজন স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন। তারপর জেমসের ‘নগরবাউল’ হলো। কিন্তু কোথাও একটা ধাক্কা আছে। স্টেজশো কমে এল ক্রমে। টিভিশো নির্ভর হয়ে পড়লেন তিনি। এসব কেবল জেমসের ক্ষেত্রে নয়। পুরো বাংলার রকমিউজিকে এল এই দুর্দিন। হ্যাডব্যাঙ্গারদের কষ্ট বাড়ল। কন্সার্ট যেভাবে উন্মাদিত করতে পারে, শিল্পীরা শ্রোতাদের সাথে কম্যুনিকেট করতে পারে তা তো টিভিশো পারে না। রকমিউজিক যে শ্রোতাদের বেঁচে থাকার, নতুন চিন্তার ও আনন্দের অনুপ্রেরণা যোগায় সেখানটাতে যেন ভাটা পড়ল।

রকমিউজিকের বড় প্লেসই হচ্ছে স্টেজ পারফর্মেন্স। টিভিশোগুলো মিউজিককে আর মিউজিকের ধারায় রাখল না; শিল্প ও শিল্পীকে পণ্য ও অসুস্থ বানিয়ে ছেড়ে দিলো। ফারুক মাহফুজ আনাম জেমসও ধীরে ধীরে স্টেজ পারফর্মেন্স কমিয়ে দিলেন। আর কন্সার্টে এলেও পুরনো সেই একই গানগুলো। সেই দ্রুত রিদমের — বিজলী, বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না, পাগলা হাওয়া, দিওয়ানা, গুরু ঘর বানাইলা কি দিয়া, বাংলাদেশ, দুষ্ট ছেলের দল, কানামাছি ভোঁ-ভোঁ, ঝাকানাকা দেহ দোলা না, কিংবা অতি জোর মা। কিন্তু আমরা তো জেমসকে চিনি তাঁর তবে বন্ধু নৌকা ভিড়াও, সুন্দরীতমা আমার, আরও কিছুক্ষণ কি রবে বন্ধু, জঙ্গলে ভালোবাসা, চিরহরিৎ, আমি ও আঁধার, পদ্মপাতার জল, যত দূরে যাও বন্ধু আমার, কিছু ভুল ছিল আমার, যে পথে পথিক নেই, স্টেশন রোডে ঘুম আসে না, অনন্যা, সমাধি, চিরটাকাল, কথা নয় মুখে মুখে, লেইস ফিতা লেইস, সারথী, লুটপাট হয়ে যাবে, আমি তোর মনের মতো হতে পারলাম না রে, বাবা, তুমি যাকে অশ্রু বলো, যেদিন বন্ধু চলে যাব, মান্না্ন মিঞার তিতাস মলম — এই-রকম কত কত অজস্র গান জেমস করেন না কন্সার্টে। এইসব অভিযোগ-অনুযোগ নিয়েও আমরা ভালোবাসি জেমসকে। কেননা  বাঙালিকে স্কুলপালানো যদি শিখিয়ে থাকেন কবি রবীন্দ্রনাথ তবে বাঙালিকে ঘরপালানো শিখিয়েছেন গুরু জেমস। নিজে ঘরপলাতক। গানপাগল। চিরকালের আউলা।

নাইন্টিজের উত্তেজনা ছিল রকমিউজিককে ঘিরে। তার অধিকাংশ উত্তেজনা ঘিরে ছিল জেমস। তাঁর বোতামখোলা শার্ট, লম্বা পাঞ্জাবি, ব্লু জিন্স, লম্বা-ঝাকড়া চুল, দরাজ কণ্ঠ, রাগী গিটার — সবটা জুড়েই ছিল জেমস। জেমস দিয়ে গেছেন ফ্যাশন। বাংলার প্রথম সাইকেডেলিক রকগুরু।

তখন আমি চট্টগ্রাম আগ্রাবাদের গুলবাগ আবাসিকে থাকি। একদিন পাঠানটুলী রোডে আমি ও আমার বন্ধু সবুজ হাঁটতেছি এলোমেলো। হঠাৎ আমাদের সামনে পড়ে গেল সেই বিখ্যাত ‘আজিজ বোর্ডি।’ পুরনো একটা বিল্ডিং। মাথায় ঝুলতেছে একটা সাইনবোর্ড। জেমসের পাঞ্জাবিপরা গিটার হাতের একটা ছবি আর তার নিচে লেখা আজিজ বোর্ডিং। সেই আজিজ বোর্ডিং দেখা আর সামনে জেমসকে দেখার অনুভূতি পেয়েছিলাম সেদিন। আজিজ বোর্ডিং যেন জেমসভক্তদের জাদুঘর/তীর্থস্থান। “সেই আশির দশকের মাঝামাঝির কথা, গানের টানে, প্রাণের টানে, চট্টগ্রামে।” তখন উপরে উঠে খুব দেখতে ইচ্ছে হয়েছিল রুম নম্বর ৩৬। প্রিয় আজিজ বোর্ডিং। তারপর চেরাগী পাহাড়ে কতবার ‘স্টেশন রোড’-এর গীতিকার ও কবি আবু মুসা চৌধুরীর সাথে সাক্ষাৎ হয়েছে, আড্ডা হয়েছে। এইসব আড্ডা-আলোচনা ছিল কেবল জেমসকেই আরেকটু জানার প্রচেষ্টা।

Faruk Mahfuz Anam James

বাংলা সংগীতের সবচেয়ে বড় জায়গাটা মূলত ‘লোকসংগীতের।’ জেমস এখানেই সমন্বয় এনেছিলেন। নিজের দরাজ কণ্ঠ, প্রচণ্ড মিউজিক সেন্স আর একজন তুমুল গিটারিস্ট জেমস নিজেকে ও নিজের গানকে তুলে ধরলেন বিশ্বমঞ্চে। সাথে দেহলভী, প্রিন্স মাহমুদ, লতিফুল ইসলাম শিবলী, আনন্দ, মারজুক রাসেলের দুর্দান্ত লিরিক। পারকাশনে ফান্টি, স্বপন, পাবলো। রকমিউজিকের সাথে অল্প সমন্বয় ঘটালেন বাংলার আপামর জনসাধারণের গান লোকসংগীতের। ছাত্রাবস্থায় একজন যখন ‘প্রিয় আকাশী’ শুনছে তখন একজন সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষটাও শুনছে — “আসবার কালে আসলাম একা / যাবার কালে যাব একা’ … কিন্তু জেমসের এই দুই ঘরানার গান তাঁর জন্য কোনোকালে ‘কাল’ হয়ে দাঁড়াতে পারেনি।

জেমসের প্রতিটি গান এত কালোত্তীর্ণ যে, তাঁর সাথে অন্য গায়কের তুলনা খুবই বেমানান। জেমসের তুলনা কেবল জেমস। যতই জিম মরিসন, মার্ক নফলারকে টানা হোক না কেন।  যতই এরিক ক্ল্যাপটনের সাথে তাঁর তুলনা হোক না কেন। যতই আনা হোক লিওনার্দ কোহেনের নাম। একসময় জেমস বিভিন্ন হোটেলে, কন্সার্টে, সংগীতায়োজনে মরিসন-মার্লে কাভার দিতেন। শেষ পর্যন্ত কিন্তু জেমস তাঁর অতুলনীয় গায়কিতে ও দরাজ গলাতে স্বকীয়। এমন বৈশ্বিক কণ্ঠ খুব কম গায়েকরই হয়। একসময় জেমস ভারতে গেলেন। মুভ্যিতে গান করলেন। ভারত জয় করলেন। পিঙ্ক ফ্লয়েড, য়্যু ট্যু বা ওয়ান্ডারফুল টুনাইট যখন কাভার দেন কিংবা নিজের করা ‘গ্লাস বিট’, ‘এ্যাভার সিন্স য়্যু’ গানে ছিঁটেফোঁটাও মনে হয় না খুঁত আছে। তিনি এমনই ভার্সেটাইল। যে-দেশে জন্ম নিতেন সেই দেশেরই হয়ে উঠতেন সফল ও প্রধানতম রকস্টার। পৃথিবীতে ফারুক মাহফুজ আনাম জেমসের মতো রকস্টার খুব কম এসেছেন যারা জেনারেশনের পর জেনারেশন টিকে থাকেন।

আশির মধ্যদুপুর ও নাইন্টিজের পর থেকে আজও তিনি অসামান্য। হয়তো এখনও কোনো মাতাল দুপুরে কোনো উঠতি তরুণ হাঁটতে হাঁটতে চিৎকার দিয়ে ওঠেন “এবার বৈশাখী ঝড়ে সেই রুমাল উড়িয়ে দিও / বৈশাখী শুভেচ্ছা নিও”, বা ‘হুমায়রার নিঃশ্বাস চুরি হয়ে গেছে’, অথবা “বাইজেনটাইন সম্রাজ্ঞীর মতো তোমাকে ঘিরে থাক পৃথিবীর সমস্ত সুখ / তুমি সুন্দরী হয়ে ওঠো / সুন্দর / তুমি ভালো থেকো …”

… … 

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you