ওই সখি হে, ওরে
আমের পাতা ঝিলমিল ঝিলমিল
বাঁশের পাতা সরু
ইছিয়া বিছিয়া ভাতার ধরু
যাহার কোমর সরু
এই গানের লাইন-ক’টি খুঁটে নিলাম যে-বইটি থেকে, সেই বইটির নাম ‘পালাটিয়া’। লেখক পাপড়ি রহমান, বাংলাদেশের। পাপড়ি রহমানের লেখালেখির সঙ্গে ইতিপূর্বে আমার কোনো পরিচয় ছিল না। তাঁর নামও আমার অশ্রুত ছিল। পাপড়ি কেন, বাংলাদেশের অধিকাংশ লেখক এবং তাদের সাহিত্যকৃতির সঙ্গে আমার পরিচয় সীমাবদ্ধ। হতে পারে এ আমার অক্ষমতা। ওপার বাংলাকে বাংলাদেশ বলে যেভাবে দেগে দিচ্ছি তাতে এপার বাংলার মানুষ মূল বাংলা থেকে ততটাই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছি না? আমাদের ভাষা-সংস্কৃতি কি এতে বিপন্ন হয়ে পড়ছে না? হয়তো পড়ছে, তবু আমরা মুখরক্ষার জন্য বলতে পারি আমাদের বাঙালিদের জন্য বাংলা নামক একটা দেশ আছে। ‘আমরা একভাষাতে মাকে ডাকি একসুরে গান গাই’।
এই ভাষার দৌলতে আমরা এপার-ওপারের ভেদরেখা মুছে ফেলে একাত্ম হয়ে যেতে পারি। একই ভাষা ভাবনা সাহিত্যপাঠে আমরা পরস্পরকে ভীষণভাবে আত্মীয়তার টানে ছুঁয়ে ফেলতে পারি। সেই আত্মিক টানেই পড়ে ফেলি পাপড়ি রহমানের ‘পালাটিয়া’ উপন্যাসটি। এটি তাঁর তৃতীয় উপন্যাস। প্রকাশকাল ২০১১।
কেমন এই উপন্যাস? কি এর আশয়-বিষয়? পাঠান্তে এসব নিয়ে দু-কথা বলতেই হয়। এই বলাটা অনিবার্যভাবে আমার নিজস্ব অনুভূতির প্রকাশ। পাঠকভেদে ভিন্নতর উপলব্ধি হতেই পারে। পাপড়ি রহমানকে নিয়ে তাঁর নিজস্ব পাঠক-পরিমণ্ডলের সঙ্গে আমার নিজস্ব পাঠপ্রতিক্রিয়া খাব খাবে কি, আমি জানি না; তবে বাংলা সাহিত্যের পাঠক হিসাবে আমাদের এপার-ওপারের ভেদরেখা অনিবার্য মুছে যাবে এ-কথা বলতেই পারি। কারণ একই ভাষা এবং সাহিত্যে কোনো ভেদরেখা থাকে না। থাকা উচিতও নয়।
‘পালাটিয়া’ উপন্যাস রচিত হয়েছে দিনাজপুরের ভাষারীতিকে আশ্রয় করে। এই ভাষারীতি আশ্রয় করে লেখা হয়েছে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’।
উপন্যাস ‘পালাটিয়া’ শুরু হয়েছে গ্রীষ্মের দাবদাহ দিয়ে। রাঢ় বাংলার লালচে ভূমিরূপের মধ্যে খীয়ারের অবস্থিতি। রুখুশুখু মাটি খীয়ারের যেখানে কোদালের বিশ কোপ মারলে একটা চাঙড় তোলাও সম্ভব নয়। এমন এলাকার মানুষের জীবনসংগ্রাম যে খুব কঠিন তা আর আলাদা করে বলার অপেক্ষা থাকে না। অথচ বর্ষাকালে খীয়ারের মাঠ মাটি অন্য কথা বলে। কেমন ‘নরম তুলতুলে! যেনবা উর্বরা নারীর যোনিকন্দর। বীজ ফেলা মাত্রই ধাই ধাই করে বেড়ে উঠবে শতেক জীবন। বেশুমার আউশের ধানি সবুজে ছেয়ে যাবে বিস্তীর্ণ ভূমি’।
উপন্যাসের প্রারম্ভে সামান্য একটিমাত্র ছত্র পড়েই আমাকে নড়েচড়ে বসতে হলো। মাঠ মাটিকে এমনভাবে কী ব্যাখ্যা করা যায়! এরপর পাতার পর পাতা যত এগিয়েছি ততই দেখেছি খীয়ারের রুখুশুখু মাটির মতোই এখানকার মানুষের জীবনযাপনের সাদৃশ্য, বর্ষাসিক্ত মাটির মতোই মানুষের মনের কোমলতা।
এই কোমলতার প্রকাশ ঘটেছে তামাম উপন্যাস জুড়ে। এসেছে নানান চরিত্র। প্রায় সমস্ত চরিত্রে সমাজের নিম্নবর্গীয় মানুষের উপস্থিতি। তাদের দারিদ্র্য ছাপিয়ে হৃদয়ের গভীর প্রদেশ থেকে উৎসারিত হয়েছে মেধা মনন আর ভালোবাসার উপস্থিতি। অবশ্য এতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছে ঢেপা, তুলাই, পুনর্ভবা বা খরখরিয়া নদীসমূহ।
নদীকেন্দ্রিক মানুষের যাপনকাহিনি অনেক উপন্যাসের বিষয় হয়ে বাংলা সাহিত্যে ধরা দিয়েছে। তাতে সেই অঞ্চলের মনুষ্যজীবনের অনেক লোকায়ত ধারাকে পুষ্ট করেছে। উঠে এসেছে মানুষের জীবন জীবিকা সংস্কৃতি ভাষা, কথকতা প্রবাদ প্রবচন, বেঁচে থাকার অনুপুঙ্খ বর্ণনা। কোনো উপন্যাস কোনো-একটি ভৌগোলিক এলাকানির্ভর কাহিনির বিন্যাস হলেও আসলে তা সামগ্রিক সাহিত্যেরই প্রতিনিধিত্ব করে। ‘পালাটিয়া’ উপন্যাস দিনাজপুর সন্নিহিত এলাকার মানুষের জীবনযাপন সংস্কৃতিকে উদযাপিত করে। পাপড়ি রহমান লিখেছেন,
“জমিন আর মানুষের ভেলকিবাজির মতো ইখানের মানুষের মনেও চলে ভেলকিবাজি। ইখানে জেবন হইল ভেলকির। যৌবন ভেলকির। ইখানে রাইত আর দিনও আসে ভেলকির বদৌলতে। ইখানে খীয়ার ভিন্ন। হাওয়া ভিন্ন। মানু-মরদের মতিগতিও ভিন্ন।”
শ্রুতিমধুর আঞ্চলিক ভাষায় রচিত এই মহৎ উপন্যাসটির পাত্র-পাত্রী বিষয়আশয় সম্পূর্ণ ভিন্ন জগতের সন্ধান দেয়। গভীর জীবনসন্ধানী বান্ধানী গীতের বন্ধনে পাঠক বাঁধা পড়ে যায়; যখন শুনি এমনই এক বান্ধানী গীত
আইসো কুটুম বইসো কাছত
হাত না-দেন ডালিম গাছত
ডালিম গাছে ভোমরার বাসা
ঘেষ্টা দিলে সর্বনাশা।
কিংবা
কুনবা দেশত আইনু দাদা
কুনবা দেশত যাও
মধ্য পথত সব হারাইনু
পথ খুঁজি না পাও।
‘বান্ধানী গীত’ হলো যে-গীত বাঁধা হয়। কারা বাঁধে এই গীত? না, খীয়ার অঞ্চলের মানুষেরা বাঁধে। তারাই সুর দেয়, গায়। মানুষের মধ্যে এই সৃষ্টিশীলতার স্বাভাবিক প্রকাশ দেখা যায় ‘পালাটিয়া’ উপন্যাসে। পালাটিয়ার পালা বা যাত্রাপালা রচনা করে এই এলাকার সাধারণ মানুষ। হাজার অভাব-অনটন ক্ষুধা-দারিদ্র্যের মধ্য থেকে বেরিয়ে এসে তারা তাদের মহৎ সৃষ্টির প্রকাশ ঘটিয়ে বেঁচে থাকতে চায়। এমনই একজন পালাকার হচ্ছে মঙ্গলচন্দ্র রায়। বয়স ‘তিন কুড়ি’ পার। এই সংখ্যা-এককের মাধ্যমে বুঝতে পারা যায় তাদের শিক্ষাদীক্ষার সীমাবদ্ধতা। বউ ননীবালা সংসার সামাল দিতে যোগালির কাজ করে। পটের বিবি সেজে ঘরে বসে থাকলে চলে না কইনগরের মেয়ে-বউদের। ঘরগেরস্তালি আর সন্তান প্রতিপালনের বাইরেও আরো অনেক গুরুদায়িত্ব পালন করতে হয়। মঙ্গলচন্দ্র এমনই স্বল্পশিক্ষিত মানুষ যে তার নামটা ঠিকমতো লিখতে পারে না। সেই মানুষই পালাগান রচনা করে। অথচ লিখবার মতো বর্ণজ্ঞান তার নেই। সে-কারণে সে তার স্বর্গীয় পিতামাতাকে শাপশাপান্ত করে,
‘মোর জীবনত এংনাই মঙ্গল নাই, আর মোর নাম থুইচে মঙ্গল।’
এ-নামও একদিন মুছে যায়, যখন সে হয়ে ওঠে মাস্টার বা মাশ্টর। বাহারি বাবরি চুলের মঙ্গলচন্দ্রের হাতে-খড়ি হয় অনাবী সরকারের কাছে। অনাবী সরকার তাই মঙ্গলচন্দ্রের ওস্তাদ। যাত্রাপালায় ওস্তাদ বা মাশ্টরের আলাদা মর্যাদা সর্বত্র। শুধু পালা রচনা করলেই হয় না, অভিনয়ের মাধ্যমে চরিত্রগুলিকে চিত্রায়িত করাও অন্যতম বড় কাজ পালাকারের। ‘সাতভাতারী সাতেশ্বরী’ আর ‘নিঃসন্তান রাজা’ রচনার পর একজন প্রায়-নিরক্ষর মানুষ মঙ্গলচন্দ্র রায় ‘মাশ্টর’ উপাধি পেয়ে যান। এই প্রাপ্তি গ্রামীণ রুখুশুখু মানুষের কাছে অনেক বড় পাওয়া। এতে বউ ননীবালাও তব্দা মেরে যেত। তার স্বগতোক্তি, ‘ওক কি মুইও মাশ্টর কহিবা পারিম?’
মঙ্গলচন্দ্রের উপাধি যে কতখানি সার্থক তা ননীবালার এই উক্তিতেই পরিস্ফুট হয়। মনমেজাজ ভালো থাকলে স্বামীর চুলে বিলি কাটতে কাটতে অভিব্যক্তি প্রকাশ করে, ‘আহা! কত চুলই-না আছিল মিনসের!’
ননীবালার স্বামীর চুলের প্রতি আক্ষেপের ধরতাই খুঁজে পাওয়া যায় মঙ্গলচন্দ্রের যৌবনের দিনগুলোতে, যখন ননীবালা সখেদে বলে উঠত, ‘ওর মনে হচে ছিনমের হিরো! মুই ছুয়ালাক না-খাই থুইচু আর ওয় গাওপাড়াত ছিনমের অভিনয় করি বেড়াচ্চে!’
মঙ্গলচন্দ্রও তো বলেছে, ‘মুই যে কী কৃষ্ণ সাজিনু! মোর এ্যাখান দেখেছু রাধা সামুলানিয়ায় দায় হই পইছে।’
সম্পর্কের এই টানাপোড়েন তামাম উপন্যাস জুড়ে চিত্রিত হয়েছে। সমাজের অবতল শ্রেণির এই-সমস্ত মানুষের জীবনযাপন অন্যরকমে প্রকাশ পায় বিভিন্ন পালাগানের মাধ্যমে। এ এমন এক আকর্ষণ যার টানে পালাকার ঘর ছাড়ে, বাড়ি ছাড়ে, স্ত্রী-পুত্র ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে। সেখানে সে নতুনভাবে নিজেকে স্থাপন করে।
মঙ্গলচন্দ্র একা নয়, এই কাজে আছে বিশুরামও। সে প্রায়শঃ ঘরসংসার ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে দূর দূর গাঁয়ের ঠিকানায়। বাড়িতে বৃদ্ধা মা। যমজ রাম-লক্ষণ আর সীতা-সাবিত্রী। স্ত্রী চঞ্চলার দুঃখের সাগরে ভেসে বেড়ানোর অবস্থা। গোরুবাছুর হাঁসমুর্গি ছাগলভেড়া। কে এসবের দেখভাল করে! স্ত্রী চঞ্চলাকে যার দেখভালের কথা, ভাতকাপড়ের দায়িত্ব পালন করার কথা, সেই বিশুরামের ‘ক্ষেতিখামারিতে মন নাই। সে চুলে রঙ্গের টেরি কাটে। আর ধোপদুরস্ত কাপড় পরে ঘুরে বেড়ায়। রাতভর রিহার্সাল তো আছেই।’ নতুন পালা ‘মাটিকাঁপা দেওনীয়া’-তে জীবনবাবুর পাট করবে ‘হিরো’ বিশুরাম। সে গাইতে থাকে,
যত খাওয়া খিলাও তুমি
তোমার মনে এতই হারামি
কি করিলে তোমার আশা
আমি বুঝেছি আমি হব দুষী।
যে-কোনো যাত্রাপার্টি বা যাত্রাদল কেবল দুই-একজনকে নিয়ে গড়ে ওঠে না। দরকার নানান চরিত্র, নানান বাজনদার। তামাম সমাজসংসার একটা পালাদলের মধ্যে নিহিত থাকে। পালাগানের অবস্থা অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন ভাবে প্রকাশ ঘটে। তেমনই এক চরিত্র হচ্ছে আন্ধারু। সে হারমোনিয়াম বাজায়। দেবেন কর্নেট বাজায়। তবলা-ডুগিতে নগেন্দ্র আর বাঁশিয়াল ধুরেশ। আছে মনোরঞ্জন আর জয়হরি নামের নবীন দুই অভিনেতা। জয়হরি নারী চরিত্রে অভিনয় করে। যাত্রাপালার প্রথম ভাগে নারী চরিত্রে পুরুষেরাই অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছে। সেই পরম্পরাতে দেখতে পাই হরেন্দ্র আর পাতানুকে। হরেন্দ্র বেঢপ মোটা বলেই ‘তাকে আর এখন মাগের পাট কেন মরদের পাটও দেওয়া যাবে না। ফলে তার জায়গায় জয়হরি।’
এখানে কত সহজে ‘মাগ’ কথাটা উচ্চারিত হয়েছে! পাপড়ি রহমানকে ধন্যবাদ এখানেই যে তথাকথিত ইতর ভাষা প্রসাদগুণে ইতর থাকেনি। কত লাগসই হয়ে চরিত্রের সঙ্গে একাত্ম হয়েছে! আসলে সাহিত্যে অশ্লীলতা বলে কোনোকিছু হয় না, যদি তার সঠিক প্রয়োগপদ্ধতি জানা থাকে। এ-উপন্যাসে সেটাই বিভিন্ন জায়গায় প্রমাণিত। লেখকের কলম অকর্ষিত জনজীবনের প্রান্তরেখায় পৌঁছে তাঁর লিপিকুশলতায় অজানা-অচেনা জীবনবাস্তবতার সন্ধান দিয়েছেন। বরং ইতর শব্দ বলে যদি এই ধরনের অন্ত্যজ শব্দসমষ্টিকে পরিহার করা হতো তাহলে ‘পালাটিয়া’ উপন্যাসের জীবনবাস্তবতা অস্বীকার করা হতো। জয়হরি এবং মনোরঞ্জনের মধ্যে সমকামিতার যে ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে তাতে পালাগানের চরিত্র চিত্রণেরই প্রকাশের পরিণতি।
কৃষিভিত্তিক জীবন-জীবিকার এই জনপদের আরেক চরিত্র হলো পদ্মনাথ। সে আধিয়ার। জোতদারের আধিয়ার। সমস্ত শ্রমঘামের ফসলের অর্ধেক পরিমাণ ফসল জমিদারের গোলায় তুলে দিতে হয়। তা-নইলে জোতদারের অত্যাচার। যে-অত্যাচারের পরিণতিতে চল্লিশজন আধিয়ারের নির্মম ইতিহাস রচিত হয়েছে। কেউ কেউ প্রাণ বাঁচাতে রাতের অন্ধকারে ভুটানের পথে পাড়ি জমিয়েছে। অবশ্যই এতে থেমে থাকে না মানুষের বেঁচে থাকার লড়াই। আধিয়ার থেকে তেভাগার আন্দোলন শুরু হয়। এই আন্দোলনের স্লোগ্যানের সুর এ-রকম :
‘নিজ খোলানে ধান তোলো’
‘আধি নাই তে-ভাগা চাই’
‘কব্জা ধানের সুদ নাই’
সন্দেহ নেই ঐতিহাসিক এই আন্দোলন উপন্যাসের ভিত্তিকে কিছুটা মজবুত করেছে। আধিয়ার পদ্মনাথ কৃষি উৎপাদনে সক্ষম হলেও স্ত্রী বিজয়ার গর্ভে সন্তান আনতে অক্ষম। একজন কৃষককে দু-ক্ষেত্রেই উৎপাদনমুখী হতে হয়। তুলাই আর টেপাই নদীর জলহাওয়ায় বেড়ে-ওঠা একজোড়া নারীপুরুষের সম্পর্ক বড় শিথিল, সেতুহীন।
‘একজন নারী অন্যজন পুরুষ — মাঝে অগ্নি আর মন্ত্র। অন্যের মন্ত্র শুনে শুনে আওড়ানো, এতে কি সম্পর্ক রচিত হয়?’
সম্পর্কের এই টানাপোড়েনের ফলে যে ফাটলের সৃষ্টি হয় সেই ফাটল ক্রমশঃ চওড়া হতে থাকে বিজয়া আর পদ্মনাথের মধ্যে। পদ্মনাথের ঠাকুরদাদা শক্তিনাথ, বাবা রঘুনাথও ছিল আধিয়ার। ফসলের ন্যায্য অধিকারের দাবিতে যে-আন্দোলন সেই আন্দোলনের মধ্যেই পদ্মনাথের জন্মলাভ। বলা যায় পদ্মনাথ আধিয়ার বা তেভাগার সন্তান। বাবা রঘুনাথ পদ্মনাথকে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে গাইত এই গান :
১৩৫৩ সাল মাঘ মাসের শেষে
তেভাগার রণে কৃষক কুদ্দিল সাহসে।
ভালকা বাঁশের ধনুক নিলো হস্তেতে তুলিয়া
চোখা চোখা তির নিলো পৃষ্ঠেতে বান্ধিয়া।
দলে দলে কৃষকসাজে বলে মার মার
কোমর বান্ধিয়া সবে হৈল তৈয়ার।
ঘুটঘুটি আন্ধার রাতে ম্যাঘের বড় পানি
জালিমে এই রাতে বুঝি করিবে দুশমনি।
এই উপন্যাস নিছক চিরাচরিত কোনো কাহিনির নির্মাণ নয়। সম্পূর্ণ অন্যরকম আদলে গড়ে উঠেছে এর নানান বিভঙ্গ। একদিকে প্রান্তিক মানুষের মধ্যে পালাগানের মতো শৈল্পিক ভাবনার জারণ, অন্যদিকে ভূমিহীন কৃষকের জীবন-জীবিকার সংগ্রামের ইতিহাস রচিত হয়েছে। আর আছে আমাদের সমাজজীবনে পির-ফকিরদের নিয়ে নানান কল্পকথা, গল্পগাথা। সেখানে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে মানুষ মাটির ঘোড়া দান করে, ফুল-ফল দান করে, মানত হিসাবে। আছে ঘোড়াপিরের দরগার প্রধান খাদেম তোরাব মুনশির কথা। চার-পাঁচপুরুষ ধরে সে খিদমতগার দরগার। মোসলেমের মতো নির্বিবাদী মানুষেরা কত সহজেই বলতে পারে। ‘ঘোড়াপির কি জাইত-বেজাইত মানি চলে?’
‘পালাটিয়া’ উপন্যাসে আরেকটি নারী চরিত্রের সন্ধান পাওয়া যায়। সেই চরিত্রটি হচ্ছে নয়নজলি। খুবই উজ্জ্বল চরিত্র নয়নজলি। মাতৃহীন এই মেয়েটি কৃষ্ণনাথ গৌরির স্নেহে-আদরে বড় হয়েছে। তার রূপ ও যৌবনের লালসায় জয়হরি-মনোরঞ্জন সহ আরও অনেক চরিত্র আকৃষ্ট হয়েছে। নয়নজলির মধুর কণ্ঠে গীতবান্ধা দেখে কতজনই ভেবেছে পালার জন্য বায়না করবে। কারণ কোনো ‘মাইয়াছুয়াল’ আজ অব্দি পালার নায়িকা সাজে নাই। এহেন নয়নজলি যদি কোনো পালায় অংশগ্রহণ করে তাহলে সেই পালার নাম দশদিকে ধ্বনিত হবে। উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া তার অভিনয়দক্ষতা আর রূপের মোহ দর্শককুলকে কাছে টানবে। এহেন নয়নজলিকে তার সম্পর্কিত কাকা ভুবনমোহনও ছাড়েনি। সে গৌরিকে — কাকিকে — এ-কথা বলতে পারেনি, ‘একদিন তোমহার ঘরত মোক একলা পাই ভুবনকাকু মোর পেন খুলি দিছিল। পেন খুলি মোক ন্যাংটা করি দেখিছিল।’ অবশ্য শেষমেশ জয়হরির সঙ্গে বিয়ে হয় নয়নজলির।
আরেকটি কথা বলার যে, পালাগানের মধ্যে চরিত্রের নানান উত্থান ও পতনের ছবি। দেখা যায় চঞ্চলা আর মায়ারানীকে হনহন করে হেঁটে মাস্টার মঙ্গলচন্দ্রের বাড়িতে হানা দিতে। কারণ, মাস্টার তাদের স্বামীদের যাত্রাপালায় ভিড়িয়ে ঘরসংসার উচ্ছন্নে দিচ্ছে। তাদের যাবতীয় অভাব-অনটনের কারণ হচ্ছে মাস্টার। যে-কারণে মায়ারানী-চঞ্চলা মাস্টার মঙ্গলচন্দ্রের কাছে তাদের দৈন্যদুর্দশার কৈফিয়ৎ চাইতে যায়। স্ত্রী ননীবালাও স্বামী মঙ্গলচন্দ্রকে একসময় দুষতে থাকে। সমস্ত পারিবারিক দ্বন্দ্বসংঘাতের মধ্যেও পালাগান চলতে থাকে। পালাগানের নেশায় নেশাগ্রস্ত পালাকারকে এসব বাধাবিপত্তি তেমন স্পর্শ করে না। উপন্যাসের শেষের দিকে দেখি বিশুরামের স্ত্রী চঞ্চলার অস্বাভাবিক আচরণের মধ্যে পুত্র এবং কন্যাদের নিয়ে গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করে। অথচ যাত্রাপালায় বিশুরাম তখন জীবনবাবুর ভূমিকায় অভিনয় করার জন্য বিভোর হয়ে আছে। যাত্রাপালার আয়োজন সম্পূর্ণ। পালার নাম ‘মাটিকাঁপা দেওয়ানীয়া’। পুত্র-কন্যা সমেত চঞ্চলার আত্মাহুতির পরপর আরেকটি দুর্ঘটনার মাধ্যমে এ উপন্যাসের পরিসমাপ্তি ঘটে, তা হলো : পদ্মনাথের স্ত্রী বিজয়ার মনোরঞ্জনের হাত ধরে রাতের অন্ধকারে গৃহত্যাগ। পিছনে পড়ে থাকে কইনগর খীয়ারের রুখুশুখু মাঠ ও মাটি। আর এ ঘটনার অব্যবহিত পরে ভেসে আসে আন্ধারু, পাতানি কিংবা পাতানুর গলা থেকে নতুন বাংলাদেশ গড়ে-ওঠার গান —
ঐ-না রেডিওর খবর
বাংলাদেশের রাজা হবে শেখ মুজিবর।
সবশেষে এ-কথা বলতেই হয় যে পাপড়ি রহমানের উপন্যাস ‘পালাটিয়া’ এক আঞ্চলিক ইতিহাসের দলিল যা উপমহাদেশের সাহিত্যপরম্পরাকে সমৃদ্ধ করে। আনপড় মানুষের ভাষাকে যেভাবে সাহিত্যের পাতায় তুলে ধরা হয়েছে তা প্রশংসনীয়। কিছু শব্দবন্ধ আপাতদৃষ্টিতে অশ্লীল মনে হলেও তা ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত। ওই নিম্নবর্গীয় মানুষের মুখে নাগরিক ভাষা বসিয়ে দিলে এই মহৎ উপন্যাসটির বরং অঙ্গহানি ঘটত বলে মনে করি। কেবল পরিসমাপ্তির অংশে পদ্মনাথের স্ত্রীর মনোরঞ্জনের সঙ্গে আচমকা গৃহত্যাগের বিষয়টির ক্ষেত্র যদি আরেকটু স্পষ্ট করা যেত, ভালো হতো। যদিও বিজয়া নিঃসন্তান, তার সন্তানকামনা স্বাভাবিক। তবু ঘটনা এত দ্রুত ঘটল যে মানিয়ে নিতে একটু হোঁচট খেতে হয়। আর নয়নজলির মতো আকর্ষণীয় চরিত্রটির আরেকটু প্রকাশ কি ঘটানো যেত না? তাকে অন্যান্য ক্ষেত্রে যেভাবে পেয়েছি, অভিনেত্রী হিসাবে মঞ্চে তেমনভাবে আলোকিত হতে দেখিনি।
ধন্যবাদ পাপড়ি রহমানকে এমন একটি উপন্যাস পাঠের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। তিনি যে শক্তিশালী কাহিনিকার তা তাঁর ‘বয়ন’ উপন্যাস পড়ে বুঝেছিলাম। এরপর থেকে তার অন্য উপন্যাসের জন্য অপেক্ষা করতেই পারি।
… …
- গানজীবী মানুষের আখ্যানপালা || আনসার উদ্দিন - February 19, 2019
COMMENTS