আফগানিস্তানের কবিতা। ভাষান্তরিত কবিতার সঙ্গে একটা ভালো, যদিও স্বল্পকলেবর, ভূমিকা। ছাপানো রয়েছে রাশপ্রিন্ট পত্রিকায়। লিখেছেন মঈনুস সুলতান।
মোটমাট চারজন আফগান আধুনিক কবির গোটা-দশেক কবিতা বাংলায় এনেছেন লেখক। সঙ্গে একটা ভূমিকা ও কবিদের পৃথক পরিচিতিভাষ্য অতি সংক্ষিপ্ত ও সুন্দরভাবে সেঁটে দেয়া আছে লেখাটার ভিতর। ভূমিকাটা কাজের মনে হয়েছে খুবই। নিতান্ত অল্প কয়েক প্যারায় আগ্রহ-উস্কানো ভূমিকা। আফগান কবিতায় আধুনিকতা বিষয়ে একটা আন্দাজ হয়ে যায় এইটুকু প্রিফেস ফোরোয়ার্ডিং পড়ে। ফের একবার স্মরণ হয় আমাদের যে, আধুনিকতা একেক দেশে একেক রূপে হাজির।
যে-চার কবির কাজ তর্জমা করেছেন সুলতান, প্রত্যেকেই সমান মনোযোগ পেয়েছেন তর্জমাকারের কাছ থেকে, পাঠকেরও নজর কাড়বেন প্রত্যেকেই নিঃসন্দেহে। একজন কবি, যিনি বয়সের দিক থেকে সর্বকনিষ্ঠ, নাদিয়া আনজুমন। শুধু নাদিয়াই নন, প্রত্যেক কবির কাজে আবেগের সংযত ও সংহত প্রকাশ লক্ষ করব আমরা, আর লক্ষ করব সলিলস্বচ্ছ সহজিয়ানা। আমার একটা ব্যাপার মনে হচ্ছিল কবিতাগুলো পড়তে পড়তে, এই কবিতা বাংলাদেশের কোনো কবি লিখলে সেইটাকে এইভাবে হেইল করতাম কি না। অ্যান্সার যদি নিগেটিভ হয়, কেন ও কোন কোন কারণে এইসব নিয়া ভাবতেও অল্প প্ররোচিত-প্রণোদিত করতে পেরেছে এই কবিতাগুলো, গোটা তর্জমাকাজটা। সার্থকতা তো বটে এইটা, রচক ও প্রকাশক উভয়ের, পাঠককে প্ররোচিত ও প্রণোদিত করতে পারা।
ব্যাপারটা মনে হয় এইভাবেও ভাবা যায় যে বহিরস্থিত বাস্তবতার সঙ্গে অন্তরস্থিত বাস্তবতা মিলে গেলে যে-একটা ম্যাজিক তৈয়ার হয়, এইটা আন্ধা-কালা-বয়রাও বুঝতে পারে। এই ম্যাজিকটা যেখানে থাকে, সেখানে আমরা শিল্পপ্রকরণ ও অনুষঙ্গের কারিকুরি খুঁজতে যেয়ে গলদঘর্ম হই না। ঘটনাটা আমরা অনুধাবন করতে পারি ফিলিস্তিনি কবিতা, ইরানি সিনেমা, অ্যাফ্রিক্যান সাহিত্য নজর করে গেলে। এই তিন ঘরের কাজ আমরা বাংলাভাষাভাষীরা এই একজীবনে এন্তার পড়েছি দেখেছি বুঝেছি। কিন্তু যখনই ইনার-আউটার রিয়্যালিটির ম্যাজিকটা রন্ধনপ্রণালিতে ঠিকঠাক করতে পারেন না আপনি, তখনই কারুকর্মের নানাবিধ করণকৌশল মুখ্য হয়ে ওঠে। এবং কবিতার ফায়দাটা আমরা পাই না পুরামাত্রায়। একটা গান মনে পড়ছে, আধুনিক বাংলা গান, কফিল আহমেদ লিখেছেন ও গেয়েছেন গানটা, কিং মাইডাসের মিথ ভর করে লেখা গান, মাইডাসের মিথের রেফ্রেন্স রয়েছে রচনাটায়, সেখানে একটা লাইন, কৌট। — “সোনার রাজার মতো কুৎসিত সব প্রকরণ কুৎসিত” — আনকৌট। আমরাও কি, আজকাল সন্দেহ পুঞ্জীভূত হচ্ছে, এক অতিকায় প্রকরণদৈত্য হয়ে উঠছি দিন-কে-দিন দুনিয়া-আখিরাতের দিকে ভ্রুক্ষেপটিও না করে? কে জানে, বাংলা কবিতার ফায়দা ও ফজিলতের ব্যাপারে এই নিবন্ধফাঁদা পাঠকের কোনো বক্তব্য রাখবার মওকা নাই।
কিন্তু মনে হয় যে একটা জনগোষ্ঠীর সবাই মিলিয়া যখন উল্লম্ফন/উল্লঙ্ঘন/অরৈখিকতা ইত্যাদি লেবেলের আন্ডারে একটা কমন ক্রোকোডাইলের কিড এক্সিবিট করে চলেছি। তিরিশিদের দোষ দেয়া প্রায় দুরদ পড়ার মতো দস্তুর হয়ে গেছে এসবক্ষেত্রিক আলাপে। অ্যানিওয়ে। দোষঘাট তিরিশিরা করেন নাই তা নয়, কিন্তু দোষ এত বুঝেও ভূতটা কাঁধ থেকে নামতেসে না সিন্দাবাদের, এইটাই মুশকিল। তিরিশিরা যখন এলিয়ট আর ব্যোদলেয়্যর সেলিব্রেইট করছেন, ওই দীর্ঘকালব্যাপ্ত উদযাপনার ভেতর ওয়েস্টল্যান্ডিক আর ক্লেদজ-কুসুমিত পরিবেশ এস্তেমাল করাই কবিতা করা এইরকম একটা লোকশিক্ষা কবিরা যেন কী-এক আজব কায়দায় গ্রহণ করতে লাগলেন। বাংলা কবিতা হয় ভদ্রলোক নয়তো ক্রোধী তারুণ্য — এই দুই খাঁচা/ধাঁচা থেকে আর স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরল না। লাফালাফি, পল্লবগ্রাহিতা আর শাখামৃগবৃত্তি দিয়া চালাইয়া চলিয়াছে তারা গাউসেল-আজম-মাইজভাণ্ডারির এই নিরন্তর কবিতাকারবার। বাবুবিলাসের নোশন এককালে ছিল পায়রাক্রীড়া, আজকাল কবিতাক্রীড়া। দ্যাট’স্ ইট। দ্যাট’স্ দ্য র্যুল। অ্যান্ড দ্যাট’স্ অল।
অ্যানিওয়ে। নাদিয়া আনজুমন ও তাঁর কবিতাগুলো মনে থাকবে অনেকদিন। মঈনুস সুলতান কৃত কবিপরিচিতিমূলক সূচনাভাষ্যটি এবং একটি কবিতা, রাশপ্রিন্ট লিঙ্ক সমেত, এইখানে রেখে দেই।
কবি নাদিয়া আনজুমন (১৯৮০-২০০৫)-এর জন্ম হিরাতে। দশম শ্রেণির ছাত্রী নাদিয়াকে বালিকা বিদ্যালয় ত্যাগ করে পর্দার অন্তরালে যেতে হয় — তালেবানী শাসন নারীশিক্ষা সাফ হারাম ঘোষণা দিলে। অতঃপর কবি ‘সোনালি সেলাই চক্র’ বলে খ্যাত মেয়েদের কাপড় সেলাইয়ের ছদ্মাবরণে সংগঠিত সাহিত্য বিষয়ক আন্ডারগ্রাউন্ড স্টাডি সার্কেলের সদস্য হন। তালেবানী শাসন বিলোপের পর হিরাত বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্যের ছাত্রী থাকাবস্থায় প্রকাশ করেন তাঁর পয়লা কাব্যগ্রন্থ ‘গুল-ই-দোদি’ বা ‘আন্ধার প্রসূন’। বিবাহিত হন হিরাত বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিয়ান ফরিদ আহমদ মাজিদ নেইয়া-র সাথে। তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হলে কিছু বিষয়বস্তু নিয়ে স্বামী তীব্র আপত্তি জানান। সূত্রপাত হয় দাম্পত্য কলহের। ঈদের দিন কবি নাদিয়া কবিতার মাইফেলে যোগ দেয়ার জন্য বাড়ির বাইরে যেতে চাইলে স্বামী পর্দার অজুহাতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। ঐদিন কলহের এক পর্যায়ে স্বামীর তীব্র প্রহারে মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে তিনি নিহত হন। ২০০৭ সালে তাঁর কবিতাসমগ্র প্রকাশিত হয় ইরান থেকে।
কবিতা একটা পড়ে ফেলি এখানে, ভেতরে গেলে আরও গোটা-দুই, মঈনুস সুলতান বঙ্গানুবাদিত।
আফগান দুহিতা ।। নাদিয়া আনজুমন
অনুবাদ / মঈনুস সুলতান
________
কীসের কবিতা?
কী আমি পাঠ করব বলো —
ইচ্ছে হয় না মুখ খুলতে,
ঘৃণা করেছে সরবে সমাজ
সমকাল দেবে না আমাকে
মাথা তুলতে।
কীভাবে করব আমি প্রতিবাদ?
ঠোঁটে ছোঁয়াতে চাই যে মধু
বিষ তা — মুখে লাগে বিস্বাদ।
যারা রুদ্ধ করেছে আমার বাকস্ফূর্তি
কীভাবে জানাই ধিক্কার?
বাস করছি এমন এক দুনিয়ায়
শুভার্থীও নেই কোনো — তারিফ করার।
আমি কাঁদি কিংবা হাসি
যায় আসে না কারো কিছু,
যদি-বা হয় আমার মরণ
বন্ধ করে দেয়াই সমুচিত
বিশেষ বাচনভঙ্গি
আমার কবিতা পাঠের ধরন।
বন্দি আমি আমারই অনুশোচনার
রুদ্ধ হয়েছে সম্ভাবনার সকল দুয়ার,
আমি জানি — বসন্ত, আমার আনন্দের ঋতু
হয়েছে অতিক্রান্ত
ডানা কাটা … কীই-বা করতে পারি
আমি পরিশ্রান্ত।
কিন্তু যাইনি ভুলে হৃদয়ের কথা
বিন্দু বিন্দু করে আমার নিজস্ব সিন্ধুতে
জমা হচ্ছে সংগীতের প্রবাল
আমার সমুদ্রতলে বেজে যাচ্ছে
গহন অতলে সুর হামেহাল।
আমারও আসবে সুদিন
ভাঙব খাঁচা — দিলখোলা এক প্রান্তরে
গাইব আমি গান
সুর জ্বলে যায় অন্তরে।
সহিষ্ণু বৃক্ষ এক —
আমার পত্রালিতে ঝলমল করে
সূর্যের সবুজ দর্পণ,
অবরুদ্ধ হব —
নিষ্পেষিত হবে আমার অন্তর
তবু করব না আমি আত্মসমর্পণ।
আফগানদুহিতা আমি
শিকড় আমার অনেক গভীরে প্রোথিত
ক্রমাগত ক্রন্দনই আমার নসিব
কেঁদে যাব নিয়ত।
রাশপ্রিন্ট পত্রিকায় ছাপা-হওয়া ‘আফগানিস্তানের কবিতা’ লেখাটার লিঙ্ক :
আফাগানিস্তানের কবিতা ।। মঈনুস সুলতান
রিভিয়্যুড বাই জাহেদ আহমদ ২০১৫
- ভোটবুথ, ভূতভোট, বজরঙবলি ও বেবুন - November 26, 2024
- ক্বারী আমীর উদ্দিন সান্নিধ্যে সেদিন || তারেক আমিন - November 20, 2024
- পোয়েট ও তার পার্টনার - October 19, 2024
COMMENTS