যন্ত্রের সাজপোশাক কোনো নতুন বিষয় নয়। সেই রাজারাজড়াদের আমল থেকেই যন্ত্রীর পাশাপাশি যন্ত্রটাও আকর্ষণ করত। অন্তত সেকালের বাদ্যবাজনার সাজপোশাক দেখলে তা-ই মনে হয়। ফ্যাশনেবল না-হলে যেন চলে না। প্রশ্ন জাগতে পারে সংগীত তো শোনার জিনিশ, সেখানে ফ্যাশন আসে কি করে? মানুষ সৌন্দর্যের পূজারী; আর এই সৌন্দর্যের জন্যই ক্রমান্বয়ে বদলে যাচ্ছে ইন্সট্রুমেন্টের মডেল, রঙ ও ডিজাইন।
বাউলদের একরঙা লুঙ্গি আর পাঞ্জাবির সাথে বাদ্যের রঙচটা ডিজাইন, লাল কাপড় মোড়ানো ঢাক-ঢোল আর বাবরি ঝাঁকিয়ে পরিবেশনাই তো অনন্য এক ফ্যাশন। আবার ইন্সট্রুমেন্টের ধরন বুঝেও স্টাইল তৈরি হয়েছে। যেমন অ্যাক্যুস্টিক গিটার নিয়ে গান গাওয়ার জন্য টুল যেন একান্তই প্রয়োজন। টুলে বসা ছাড়া অ্যাক্যুস্টিক গিটার বাজানোটা যেন জমেই না।
ইন্সট্রুমেন্টে ডিজাইনের কথা বলতে গেলে তো সেই পুরনো কাল থেকে শুরু করতে হয়। আগে যেসব ইন্সট্রুমেন্ট ব্যবহার হতো তার সবই অ্যাক্যুস্টিক গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। সরোদ, সেতার, সন্তুরের গায়ে হাতের কাজ ও হাল্কা বা ঘন রঙটাই বেশি ব্যবহার হতো। সেতার বা তানপুরার মাথায় কখনো কখনো দেখা গেছে পশুর মাথা। কাঠ কেটে তৈরি-করা ডিজাইন। রঙের ক্ষেত্রে খয়েরি, চক্লেট, ও কালোরই প্রাধান্য। একতারার খোলে থাকে তেলতেলে রঙ। অ্যাক্যুস্টিক বাদ্যযন্ত্রের (শুধুমাত্র তারযুক্ত বাদ্যে) কি থেকে শুরু করে পুরো যন্ত্রেই করা হতো ডিজাইন। যেমন বর্তমানে যে তবলা ব্যবহার হয় তার সাথে মোড়ানো থাকে সোনালি বা রূপালি রঙের পাত। বাঁশির ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় ফিতা বা কাপড়ের ফুল। গিটারের মতো দেখতে ছোট ম্যান্ডেলিন যন্ত্রটা এমনিতেই সুন্দর; তার আর বাড়তি সাজের দরকার হয় না। একপাট বা তিনপাট যুক্ত করে বাজানোর প্রয়াস মেটায় কঙ্গো। তবে পরিবেশনভঙ্গি ও এর খাঁকি রঙের ধাঁচটা বেশ আকর্ষণীয়। এক্ষেত্রে হাল্কা কোনো রঙ বেমানানই লাগে। হার্মোনিয়ামের উপরের খাঁজটায় (রিডের সামনের ভাগ) ফুল, বা বিশেষ নকশা করে যেগুলো তৈরি হয় সেগুলোই যেন বেশি আকর্ষণ করে। পিয়্যানোর আকর্ষণটা রাখা হয় তার পায়ার ডিজাইনে।
বর্তমান সময়ের ইন্সট্রুমেন্টের মধ্যে অ্যাক্যুস্টিক তো এখনো বিশেষ অবস্থানে আছে। এক্ষেত্রে বেহালার অবদান বেশি। রঙের ক্ষেত্রে গাঢ় বেগুনি, খয়েরি বা খাঁকি রঙ ছাড়া বেহালা মানায় না। অবশ্য বর্তমানে ইলেক্ট্রিক বেহালার রঙ ও ডিজাইনে বেশ হেরফের দেখা যায়। দৈর্ঘ্য বাড়িয়ে মাউথ অর্গ্যানের স্টাইলেও একটা নতুনত্ব আনা হয়েছে। মিনি মাউথ অর্গ্যানগুলোয় ছোট ছোট কার্টুনের ছবিও বেশ আকর্ষণীয়।
বর্তমান সময়ে যে-ইন্সট্রুমেন্টগুলো সংগীতে একেবারে অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে তার মধ্যে গিটার, কিবোর্ড ও ড্রামসের কথাই বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অ্যাক্যুস্টিক ইয়ামাহা বা গিবসনের বডি মোটা এবং দেখতে ততটা ভালো না হলেও কারিগরি ও মিউজিক মান বেশ উন্নত। ইলেক্ট্রিকে মিউজিকম্যান (ভ্যালহ্যাল সিরিজ), অ্যাভেজিন (জেপিএম), ওয়ার্সবান (হাতে তৈরি), গারভেন, রোন্যাল্ড মডিউল, রোন্যাল্ড সিন্থেসাইজ্যার, বাস্ ইত্যাদি মডেল মানের দিক থেকে অনেক ভালো। আর যখন আপনার হাতে ভালো মডেলের গিটার থাকে তখনই তো আপনি হয়ে যেতে পারেন পরিপূর্ণ ফ্যাশনেবল।
পছন্দের পরবর্তী পর্যায়ে রাখতে পারেন রঙ। এক্সট্রা পার্ট লাগানো একের ভিতর দুই রঙের গিটার। কন্সার্টের লেজার আলোতে সোনালি ও রূপালি রঙের গিটার আলাদা চমক সৃষ্টি করে। আধুনিক অ্যাক্যুস্টিক মিউজিকহোলে প্রচলিত গোল বড় ছিদ্রের পরিবর্তে থাকে লতা ডিজাইনের ছিদ্র। ইলেক্ট্রিকেও আছে ত্রিভূজ আকৃতির গিটার। আর তিরের মাথার মতো ডিজাইনও মন্দ না। সাথে বাদকরা আকর্ষণ বাড়ানোর জন্য বডিতে ন্যা করা চারাল কালার স্টিকার কিংবা টিউনিং হেডের মাথায় রুমাল বাঁধেন। গিটার কাভার ও বেল্টের ক্ষেত্রে চামড়ার চাহিদাই বেশি। বিভিন্ন রঙের চামড়া ব্যবহার করা হয়। গিটারবক্স অনেকটা সাধারণ গোছের, অন্তত আমাদের দেশে সে-রকমই চোখে পড়ে।
ডাবল বা ট্রিপল কিবোর্ড ছাড়া অন্যান্য কিবোর্ড মিউজিশিয়্যানদের যেন ততটা ফ্যাশনেবল মনেই হয় না। হার্মোনিয়ামকে যদি আদি কিবোর্ড ধরা যায় তবে বর্তমান কিবোর্ডিস্টদের যেটা করতে হয় না সেটা হলো গলায় গামছা ঝোলাতে হয় না। আগে এটাই ছিল একটা স্টাইল। আর এখন গামছার বদলে আছে কিবোর্ডস্ট্যান্ড। স্ট্যান্ডের বৈচিত্র্য আবার কিবোর্ডের চেয়ে বেশি। লম্বাটে ডাবল কিবোর্ডস্ট্যান্ডের পাশাপাশি ট্রিপল স্ট্যান্ডের চাহিদাও বেশ।
কন্সার্টে ভালো মিউজিকমেকাররা ডাবলপার্ট কিবোর্ড ব্যবহার করেন। প্রথমটা সেটআপ ও দ্বিতীয়টা মিউজিকপার্ট হিশেবে। আর কিবোর্ডের ক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে বাজানোটাই রীতি, এটাই ফ্যাশন। বসে বাজানোটা আঁতেলমার্কা ব্যাপার হয়ে যায়। শাদাকালো রিড ও রূপালি বা কালো কিবোর্ড ছাড়া বিশেষ কোনো অন্য রঙ দেখা যায় না। তবে গিটাররূপী কিবোর্ড নিয়ে প্রোগ্রাম করলে বেশ ভালোই লাগে। কিবোর্ডের আকর্ষণ বাড়ানোর একই কিবোর্ডে চমৎকার ডিজাইনের ডাবল চেম্বার একসময় বাজারে এসেছিল। কিন্তু যেখানে মিউজিকটাই আসল সেখানে ডিজাইনের চমক ধোপে টেকেনি।
বিটের জন্মদাতা তো বাজাতে বাজাতে হয়ে যান শোয়ার্জিনেগারের মতো পেশির মালিক। আর তখন হাতকাটা টাইটফিটিং গেঞ্জিই হয়ে যায় তার পছন্দের ফ্যাশন। ড্রামসের ক্ষেত্রে রঙ পরিবর্তন ছাড়া আলাদা কোনো বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে না। তবে রিদম মেশিনের ক্ষেত্রে আকার ও ধরনটাও ব্যতিক্রমী। টোমা রকস্টার, পার্ল এক্সপোর্ট ইত্যাদির ড্রামস অনেক ভালো। হাতের স্টিক নাড়ানোর ক্ষেত্রেও অনেকের নিজস্বতা চোখে পড়ে। কারো কারো অ্যাক্যুস্টিক ও ইলেক্ট্রিক ড্রামস একত্রে বাজানোর অভ্যাস আছে; কারো জন্য সেটা স্টাইল, কারো জন্য প্রয়োজন।
ইন্সট্রুমেন্টকে ফ্যাশনতালিকায় স্থান দেয়ার ভাবনাটাই বিস্ময়কর। তারপরও যা বৈচিত্র্য এনে দেয়, তৈরি করে নিজস্বতা, আর উপস্থাপন করে অভিনব কর্মকাণ্ড, সেটাই তো ফ্যাশন। সেক্ষেত্রে ইন্সট্রুমেন্টকেও ফ্যাশনের বস্তু হিশেবে দেখা যেতে পারে।
[এই রচনাটা বাদ্যযন্ত্রের ফ্যাশন নিয়ে আবর্তিত হয়েছে। ইন্সট্রুমেন্টের সাজপোশাক নিয়েই রচনাটা। যদিও রচনাটা আপটুডেট নয় সেই অর্থে, বেশ আগের লেখা, মানে এখানে যেসব ইন্সট্রুমেন্টব্র্যান্ডের নাম ও মডেল বর্ণিত হয়েছে সেসবই প্রায় দেড়-দশক আগেকার। স্বাভাবিকভাবেই মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে এই অবসরে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে, যুক্ত হয়েছে নতুন মডেল ও ধরনধারণ, ফ্যাশনেও রদবদল হয়েছে যন্ত্র ও যন্ত্রীর। রচনাটা আমরা ‘গানপার’ থেকে বিশেষ যত্নে ছেপে রাখছি যেন এই বিষয়ে সাম্প্রতিক ট্রেন্ড অনুসরণ করে নবতর রচনা প্রণয়নের দিকে সংগীতামোদী লেখকদেরকে আগ্রহী করে তোলা যায়। এর তথ্যগত সাম্প্রতিকতা নিয়ে সেভাবে আলাপ না করে এখানকার ধাঁচ মনে রেখে এই আদলে নিত্যনতুন রচনা আমরা আগামী দিনগুলোতে পেতে চলেছি মর্মে আশা করতে পারি।
লিখেছেন রাসেল আজাদ বিদ্যুৎ, চমৎকার এই রচনাটা; ‘আনন্দভুবন’ ১৬ এপ্রিল ১৯৯৯ সংখ্যা থেকে এইটা আমরা কালেক্ট করে রেখেছি। কিন্তু রচয়িতার সঙ্গে যোগাযোগ করা স্বাভাবিকভাবেই সম্ভব হয়নি; কেননা প্রায় আঠারো বছর আগেকার পাক্ষিকে এইটা ছাপা হয়েছিল, কাজেই লেখকের পরিচয় আমরা আনন্দভুবন পত্রিকার স্টাফ-মেম্বার হিশেবেই জানছি। রচনাটা পাঠকের কাজে লাগবে, আমরাও প্রকাশ করতে পেরে সুখী। বিচিত্র বিষয়ে লেখা আহ্বান করার গরজে আমরা আর্কাইভ করে রাখব প্রচুর রচনা যা আমাদের একসময়কার বাণিজ্যিক সাময়িকপত্রিকা মারফতে প্রাপ্ত এবং কোনো গ্রন্থভুক্ত নয়। এই রচনাটা বাদ্যযন্ত্রপ্রেমী অনেকেই আমরা উপভোগ করব। ― গানপার]
- যেভাবে হয়ে ওঠে ‘এসো আমার শহরে’ || শিবু কুমার শীল - March 6, 2025
- Basudeb Dasgupta’s ‘Randhanshala’ The Cooking Place translated by Sourav Roy - March 4, 2025
- ভিক্টোরিয়া অ্যামেলিনা ও যুদ্ধদিনের ইউক্রেনীয় কবিতা || জয়দেব কর - February 17, 2025
COMMENTS