প্রতুল মুখোপাধ্যায় চলে গেলেন তার অচেনা ডিঙা ভাসিয়ে। মনে পড়ে ২০০০ সালের দিকে প্রথম প্রতুল শুনি বন্ধু মুনীর আহমদ অনন্তর বাসায়। সে কেন, কি উদ্দেশ্যে সেই বয়সে এসব শুনত তার ভিন্ন প্রেক্ষিত হয়তো ছিল কিন্তু আমি অবাক বিস্ময়ে অন্তুকে দেখতাম সে সকলকে ধরে ধরে প্রতুল শোনাচ্ছে। এর মধ্যেই হয়তো একুশে টিভিতে ‘আমি বাংলায় গান গাই’-এর একটা কভার ভিডিও সহ প্রচার হতো। সেটা অনেক পরে শুনেছি, দেখেছি এবং সেটা তার কণ্ঠেও ছিল না। ফলে অন্তু যেদিন প্রতুল শোনাল সেদিনই আমি প্রথম শুনলাম তাকে (প্রতুলকে), বলা যায় চমকে গেলাম ভেতর বাহির।
এর কিছুকাল আগেই কবীর সুমন শুনতে শুরু করেছিলাম ফলে নতুন বাংলা গানের স্বভাব যে বদলে যাচ্ছে তা টের পেতে শুরু করেছি ইতিমধ্যে। কারণ এর আগে আমাদের শ্রুতি মূলত রেডিওনির্ভর বা পাড়ার ডেকসেটে বাজানো বাংলা রক। সবকিছু ছাপিয়ে সুমন-প্রতুল আমাকে ভাবিয়ে তুলল গানের ক্ষেত্রে। যেন এরকম গানই হওয়া উচিত এই রকম ভাবতে শুরু করলাম। কাছের দু একজন বন্ধুও তাতে সায় দিচ্ছিল। ততদিনে গুনগুন করে আপন সুর ভাজতে শুরু করেছি। প্রতুল মুখোপাধ্যায় অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়কে সাক্ষাৎকারে বলছেন নকশাল মুভমেন্ট তাকে গীতিকার বানিয়েছে ফলে বোঝা যায় কি রকম এক প্রবল রাজনৈতিক বোধ থেকে তাঁর গানের জন্ম। যদিও তার গানগুলোর কথা বা উপস্থাপন খেয়াল করলেই বোঝা যায় তিনি কতটা রাজনৈতিক। এক্ষেত্রে কোনো অস্পষ্টতা তাঁর ছিল না। অকপট ছিলেন শ্রেণির প্রশ্নে।
যেকোনো জুলুম, অন্যায় প্রতিরোধে দেশকাল ভেদে তিনি আমাদের বেহালাহীন সেই ‘গানকবি’ যিনি কেবল তার কথা-সুর আর হাতের তালে ভরসা করেই গেয়ে গেছেন একের পর এক অসামান্য গান। তিনি আকাপেলার ভঙ্গিতে কখনো মুখ দিয়েই ভায়োলিনের অর্কেস্ট্রা গেয়ে উঠতেন। তার টেনর ভয়েজের উপর আস্থা রেখেই গান গাওয়ার বদলে গান ‘বলতে’ মুখোমুখি হতেন শ্রোতাদের।
বিপ্লবকে যাপন করে গেছেন সারাটা জীবন। প্রথম দিকে গান গেয়ে পারিশ্রমিক হিসেবে পেতেন পাঞ্জাবি। প্রিয় শিল্পী মৌসুমী ভৌমিক একবার আক্ষেপ করেই বলেছিলেন যে প্রতুলদাকে নিয়ে আমাদের এখানে খুব কম কথা হয়েছে। দুই বাংলাতেই তার গানের উপর লেখার সংখ্যা অনেক কম। আমিও একমত সে-কথার সঙ্গে।
প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের প্রকাশিত ক্যাসেটের গায়ে তাঁর গানের জনরা হিসেবে উল্লেখ আছে ‘গণসংগীত’। এই শব্দটি আমাকে অনেকদিন ভাবিয়েছে। তিনি যে গান গাইছেন তাকে তিনি প্রতিবাদী গানও বলছেন না বলছেন গণসংগীত এই বিষয়টি ভাবিয়েছে। কথা হলো প্রতিবাদী গান আর গণসংগীতের ফারাক কোথায়? আমি অন্তত জানি না। তবে এটুকু জানি সেই আইপিটিএ থেকে এ পর্যন্ত গণসংগীতের যে চরিত্র দাঁড়িয়েছে বাংলা গানে তার থেকে প্রতুল একদম ভিন্ন। যেখানে প্রচলিত গণসংগীত কোরাসনির্ভর সাথে উদ্দীপক সংগীতায়োজন। গণ বিষয়টি যেন তাতে খুব সহজভাবে ফুটে ওঠে। লোকে সমস্বরে যেন গেয়ে উঠতে পারে সে-গান কোনো মিছিলে কোনো আসরে। যে-কোনো ক্রান্তিকে মানুষের যূথবদ্ধতার শক্তির কথাই যেন গণসংগীতের ভাবপ্রকাশে ফুটে ওঠে। মোটকথা সংগীতে একটা সমাজচেতনা থাকে সেটি গণসংগীতে সবচেয়ে বেশি প্রকাশ্য।
প্রতুল এখানে গণসংগীতের প্রচলিত ফর্মকে চ্যালেঞ্জে ফেলে দেন। তিনি বরং তার গণসংগীতের ফর্ম খুঁজে পাচ্ছেন কোনো বাউল বা ভবঘুরের কাছে যে কিনা একা একা গেয়ে চলে; যার কথা ও সুর উঠে আসে তার কান্না, পরাজয় আর প্রতিরোধ থেকে। তিনি আমাদের ঘুমতাড়ানিয়া শিল্পী। তিনি রবীন্দ্রনাথের একক নির্জনের গানের স্বভাবকে বদলে নিয়ে যান বহুস্বরে। যা ভীষণ অন্তর্গত একাকী চিৎকার হলেও তা সকলের ভাষ্য।
প্রতুল কখনও হাতে তালি দিয়ে কখনও মুখে বোল দিয়ে শূন্য স্টেজে দাঁড়িয়ে শ্রোতাদের ম্যাজিক দেখান। ডিঙা ভাসাতে উদ্বুদ্ধ করেন। তার গানে কখন আফ্রিকার খনিশ্রমিক, তার গানে চাঁদেরা হয়ে ওঠে ছোঁকড়া অথবা জোয়ান। হাতুড়ির শব্দের তালে তালে তিনি গেয়ে গেছেন শোষণের বিরুদ্ধে লড়াকু মানুষের ব্যালাড।
তাঁর একটি অনুদিত গানের কথা দিয়ে আজ শেষ করি, ‘গিয়েছিলাম পাখির হাটে কিনেছিলাম পাখি বন্ধু তোমারই জন্যে, তোমারই জন্যে…’ এ-গান শুনে কেঁপে উঠেছিলাম কারণ তখনও আমি জানতাম না প্রেমিক কত রকম হয়। তাছাড়া একটা প্রেমের গান লিখবার বাসনায় তখন ছটফট করছি। আমি আমার প্রেমিকাকে কিভাবে আমার গানে তুলে ধরব তা যেন বুঝতেই পারছি না। কারণ ততদিনে বুঝতে শিখেছি এই দ্বন্দ-সংঘাতময় দুনিয়ায় কোনোকিছুই স্থির অবিচল নয়। নিপীড়িত এই পৃথিবীর রৌদ্রছায়ায় আমি আমার প্রেমিকাকে শকুন্তলার মতো করে আর ভাবতে পারছি না। তাহলে কি হবে সেই প্রেমিকার রূপ-উপমা? প্রতুলের গানের প্রেমিক সেই দ্বন্দ্ব ঘোচালো যে কিনা কখনও পাখির হাটে, কখনও ফুলের হাটে ঘুরে ঘুরে, কখনও লোহার হাটে গিয়ে ভারি শেকল কেনে প্রেমিকার পায়ে পরাবে বলে। কিন্তু তাঁর প্রেমিকাকে ততদিনে বাঁদির হাটে সে হারিয়ে ফেলেছে। তার ভারী শেকল, পাখি আর ফুল সকলই বৃথা হয়ে যায় তখন। এই এক গানে নারীজীবনের আখ্যান ও রাজনীতি যেভাবে বর্ণিত হয় তা বাংলা গানে নেই বললেই চলে। প্রতুল আফ্রিকার উপকথা থেকে এমন এক গান তুলে আনলেন বাংলা গানের সম্ভারে।
আমরা সকলেই আমাদের প্রেমিকাদের হারিয়ে ফেলেছি সেই বাঁদির হাটে তা যেন প্রতুলই প্রথম দেখিয়ে দিলেন। এই মহান বিপ্লবী শিল্পী ও কবির মৃত্যু যেন পাহাড়সম বেদনার হয়ে উঠেছে আজ।
গানপারে প্রতুল মুখোপাধ্যায়
শিবু কুমার শীল রচনারাশি
টুকটাক সদালাপ সমস্ত
- বাঁদির হাটে হারিয়ে ফেলা আমাদের প্রেমিকাদের স্মরণে || শিবু কুমার শীল - March 11, 2025
- টুকটাক সদালাপ ১১ - March 6, 2025
- মাসুম চিশতির মেঘনাদবধ : মনোক্রোমিক এক কোলাজ || শিবু কুমার শীল - February 24, 2025
COMMENTS