কী মসৃণ সাধুর সাধনাঘর || সরোজ মোস্তফা

কী মসৃণ সাধুর সাধনাঘর || সরোজ মোস্তফা


নতুন বইয়ের মলাট ও অন্তর্গত কতিপয় ইনফো অবগত হতে পারলে বই কিনতে যেয়ে একটু সুবিধা হয়। অ্যাট-লিস্ট আগ্রহের পারদটা খানিক চড়ানো তো যায়ই, বইটা আপনার কাপ অফ টি কি না তাও বুঝতে পারা যায়। কাজেই, এই রচনাটা পাঠকবান্ধব, মানে বই কিনতে যেয়ে উটকো যন্ত্রণা থেকে বাঁচাবে। সিদ্ধান্ত নিতে হেল্প করবে এই বইটা আপনি কিনবেন কি না। আমরা গানপার থেকে এই বই এবং গানের তথা গানকেন্দ্রী সমস্ত বইয়ের প্রচার, প্রসার, প্রযত্নের ব্যাপারে তরফদারি করি নীতিগত অবস্থানের জায়গা থেকে। এমনিতে এইটা তো বলার অপেক্ষা রাখে না যে দেশে বিচিত্র ধরন, ধাঁচ ও বিষয়বস্তুর বইয়ের উৎপাদন ও বাজার-বিপণনের ব্যবস্থাটা নাই। মিউজিকের বই মানেই হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল এবং এইরকমই কিছু আইকনিক ফিগার নিয়া কারবার। সেদিক থেকে দেখলে এই বই, ‘গৌরাঙ্গ আদিত্যের জীবন ও সাধনা’ নামের এই বই, ভিন্ন ধরনের একটা পাঠ-অভিজ্ঞতা আমাদেরে দিতে পারে। এইখানে সেই বইয়ের ভূমিকাটা আমরা পাঠের মওকা পাচ্ছি। ভিতরে যেয়ে একগোছা গানের দেখা পাবো যে এতে তো সন্দেহ নাই, পাবো অনুষঙ্গের আরও কিছু হয়তো, তবে বইটা হাতে নিলেই তা সম্ভব হতে পারে। এইটার সম্পাদক, সংকলক ও আয়োজক সরোজ মোস্তফা। কবি তিনি, শিকড় ও শিখর দুইয়ের ব্যাপারে ব্যালেন্সড, ফলে লেখার ভিতরে একটা পাঠসংবেদী বিষয় তো রয়েছেই। বইটা বার করছে চৈতন্য প্রকাশনী। নিশ্চয় এই বইয়ের সাফল্য কামনা করব আমরা। — গানপার


সরোজ মোস্তফা কর্তৃক সম্পাদিত বইয়ের ভূমিকা
চোখ বন্ধ করলেই তাঁকে স্পষ্ট দেখতে পারি। মন নিজেই তাঁর কাছে চলে যায়। কী জীবন্ত তাঁর কণ্ঠ ও চেহারা! দেওথানের ছোট্ট পল্লিতে একচালা ঘর। সেই ঘরে ধ্যানের আশ্চর্য জগতে ঢুকে-পড়া বাবুই পাখির মতো তিনি বাইরে তাকিয়ে থাকেন। বাইরে লেবুপাতার আহ্বান। বাইরে গান লেখার সুর ও বর্ণমালা। কিন্তু ঘরের ভেতরে জীবনসায়াহ্নের রঙ মাখতে মাখতে শুয়ে-বসে থাকেন পবিত্রপুরুষ। একপা অবশ। একপায়ে পৃথিবীতে দাঁড়ানো যায় না। একশ পাওয়ারি বাল্বের আলোয় গানের খাতাটা তাই উল্টেপাল্টে দেখেন। চকির কাছেই ছোট্ট একটা টেবিল। সেই টেবিলে ও বিছানায় অর্জিত ক্রেস্ট ও মেডেল। মানুষের অভিনন্দনমিশানো হাততালি বাতাসে মিশে গেলেও মেডেল ও স্মারক চিহ্নগুলো গরিব ঘরের বাল্বের আলোয় চকচক করে। সময়ের শ্যাওলা পিতলের মেডেলকে অবজ্ঞা করে। নদী ও পূর্ণিমার চেয়ে এই ধাতব মেডেল কি জীবনের জন্য জরুরি? মানুষের জীবনকে কী মেডেলের চকচকে বেঁধে রাখা যায়! যায় না। গৌরাঙ্গদা তাই বাইরে, এমনভাবে তাকিয়ে থাকেন যেন না-বলা কথাগুলোই অনন্ত নয়নতারা।

নিঃসন্দেহে বাপজ্যাঠাদের জীবন আমরা যাপন করি না। জীবন ও সংস্কৃতির রূপান্তর হয়। তবুও জেনো, মাটি ও বায়ুর অবগাহনে রক্তের ভেতরে চিরকাল নিত্যতায় বসবাস করে বাপদাদাদের আচার, ভাষা ও দর্শন। ভূমিকে পরিত্যাগ করা যায় না। ভূমিকে পরিত্যাগ করলে কিছুই থাকে না। শিল্পীর সাধনাঘরে লেগে থাকে জন্মভূমির ঘ্রাণ। গৌরাঙ্গদা যে দরদী ভঙ্গিতে গান গাইতে গাইতে মঞ্চে উঠতেন, গানের কথায় যেভাবে রাতের দর্শক ও শ্রোতার মন ধুয়ে দিতেন কিংবা বিবেক জাগিয়ে তুলতেন — গানের এমন পদ্ধতি আর কোন ভূমিতে আছে? বাঙালির ম্লান অন্তরকে গান পরিশুদ্ধ করে। এদেশের যাত্রাপালাকে সাধারণ লোকেরা গান বলে। রজনীর এই গ্রামীণ শ্রোতা গান শুনতে শুনতে কাঁদেন। গৌরাঙ্গ আদিত্যের মতন বিবেকশিল্পীরা মানুষের মনকে জাগিয়ে দেয়ার জন্য মঞ্চে ওঠেন। গান শেষ হয়। শান্তি ও সুরের রেশটা নিয়ে মানুষ ঘুমুতে যায়। মানুষের অন্তরকে জিজ্ঞাসার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে বিবেকশিল্পীরা গাইতে থাকে শান্তির গান।

পঁচাশিতে পদার্পিত গৌরাঙ্গ আদিত্যের কণ্ঠ এখনও কী তাগড়া, জোয়ান! আর নিবেদনে পরিপূর্ণ। সাধুসন্তের অবিচল ভাষায় কথা বলেন গৌরাঙ্গদা। বলেন, —

“যে-গান লিখেছি সে-গানে আমাকে খুঁজে পাবে আগামী দিনের গায়ক ও শ্রোতা। গান আমি বানিয়ে লিখিনি। অন্তর থেকে নেমেছে গানের বাণী। চেষ্টা করে গান লেখা যায় না। গান ছোট একটা পাখির মতো লাফিয়ে লাফিয়ে আসে। আমার গুরু ওস্তাদ গোপাল দত্ত আমাকে শিখিয়ে দিয়েছিলেন কীভাবে গান লিখতে হবে, কীভাবে সুর করতে হবে। গুরুর বরে বলিয়ান হয়েছি আমি। গুরু ছাড়া আমার আর কোনো আশ্রম নাই। গুরু আমার অন্তরে একটা জীবন্ত পাখির মতো বসবাস করেন। আমার দুই চোখের সাথে গুরুর চোখ দুইটাও আছে। প্রকৃত শিষ্যের সাথে প্রকৃত গুরু এভাবেই বসবাস করেন। শিষ্যের আদর্শ গুরুর আদর্শ থেকে ভিন্ন হতে পারে; কিন্তু গুরুর শিষ্যকে চোখে না মাখলে কেউ শিল্পী হতে পারেন না। ভারী ভারী পুস্তক আর টেলিভিশনে সারাজীবন গান শেখার চেয়ে প্রকৃত গুরুর একঘণ্টার সান্নিধ্য অনেক উপকারী। এখন গান কেউ শিখতে চায় না। এখন সবাই গান গাইতে চায়। এখন তাই পিচ্চি পিচ্চি গায়ক দেখবেন। গাছেন গুড়ি মোটা না হলে গাছ বড় হতে পারে না। আমার গান যদি কেউ গাইতে চান, অবশ্যই গাইবেন। কিন্তু গানটা সুর-তাল ঠিক রেখে গাইবেন। গান শিখে গাইবেন। গান শেখার মধ্যে আনন্দ আছে। আনন্দ ছাড়া কিছু হয় না। অনেক সাধনায় গান অন্তরে বসে। এইসব টেলিভিশনে ঢোকার লিপ্সায় না তাকিয়ে দূরের অভিযাত্রায় নজর রেখো প্রিয় অনুজবৃন্দ।”

শৈশবে বাবার কৃষ্ণলীলা দলে গায়েন ও অভিনয়ের মাধ্যমে শিল্পচর্চায় হাতেখড়ি। সংগীতের এই নির্জন পথে বিবেকের গান গাইতে গাইতে ‘বিবেক-সম্রাট’-এর মুকুট মাথায় নিয়েছেন। জীবিকানির্ভর আসরের গান গাইলেও প্রকৃত সাধুর মতো ধ্রুপদী ঘরানার সংগীতচর্চা করেছেন। সুপারস্টার হতে চাননি; নীরবে-নিভৃতে শিখতে ও জানতে চেয়েছেন সুরের জগৎ। লোকচক্ষুর অন্তরালে তার ঘর ও সাধনা। গুরু ওস্তাদ গোপাল দত্তের অনুপ্রেরণায় গান লিখেছেন, সুর করেছেন, গেয়েছেনও। গানের মধ্য দিয়ে তিনি সন্ধান করে চলেছেন জীবনের গভীরতর অর্থ। শাহ আবদুল করিম বলেছিলেন, “আমি গান গাই না; আমি গান প্রচার করি। আমি বিশ্বাস করি পৃথিবীটা একদিন বাউলের হয়ে যাবে।” জীবনযাপন, সংগীতচর্চা ও সাধনায় গৌরাঙ্গ আদিত্যও এমন একটা অকৃত্রিম পৃথিবীতেই বসবাস করেন। গানের পৃথিবীতে ডুব দিতে জানতে হিংসা ও স্বার্থের পৃথিবী থেকে মুক্তি পাবে মানুষ। প্রান্তবাসী এই সন্ত ও সাধকের কথা, সুরে ও বিবেকের গানে এই কথাই প্রচার করেছেন।

দয়াময় গো
ও কাণ্ডারি গো, আমায় করো পার।
কূলে একা বসে আছি, জগৎ অন্ধকার।।
নাই পুঁজি মোর পারের কড়ি গো, —
লাজে-ভয়ে তাই তো মরি গো।
( তোমার) নাইকো তরী নাইকো কড়ি, জানিনে সাঁতার।।
(ঐ) হাঙর-কুমির দিচ্ছে হানা গো, —
মানছে না মোর পরান-মানা গো।
(আমার) আখের ভেবে দু-নয়নে নামছে আঁধার।।
(বিবেকের গান। কথা : ব্রজেন্দ্র কুমার দে ।। সুর : গৌরাঙ্গ আদিত্য)

কংস-মগরা-সোমেশ্বরীর জলসরোবরে একদিন থাকবেন না বিবেকগানের সাধু গৌরাঙ্গ আদিত্য। কিন্তু জনপদের মাটিতে চকচক করবে সাধুর কথা, সুর ও মাথার খুলি। হাওরের উর্বর মাটির উর্বর সন্তানের আয়ুরেখা নয়; কর্মের পরিধি ও পথরেখাই বাঁচিয়ে রাখবে গৌরাঙ্গ সাধুকে। শাপলা কিংবা জলপদ্মের দেশে গৌরাঙ্গদার উত্তরাধিকারেরা আসবেন। কারণ, তিনি বিশ্বাস করেন, —

“বিবেকগান থাকবে। কৃষ্ণলীলার গান থাকবে। একদিন সুরের ধর্মে স্নাত হবে মানবপৃথিবী। সুর ও গানই পরার্থপরতার ডাক দিবে। স্বার্থ ও সংকীর্ণতা থেকে মুক্তি দেবে গান। হিংসা ও সাম্প্রদায়িকতা থেকে মুক্তি দেবে গান। সুরের পৃথিবী আত্মাকে শান্ত ও প্রসারিত করবে।”

একজন সাধুর জীবনে প্রবেশ করার অভিপ্রায়ে রচিত হয়েছে এই গ্রন্থ। যে-ছায়ায় দাঁড়ালে মনে শান্তি ও পবিত্রতা নামে, সে-ছায়াকে স্পর্শ ও আলিঙ্গনের অভিপ্রায়ে রচিত হয়েছে এই গ্রন্থ। গবেষণাগ্রন্থের রীতি ও পদ্ধতি এই গ্রন্থে নেই। আছে সাধুর জীবনে দেখার প্রেম ও আন্তরিকতা। একজন তাগড়া মানুষকে দেখতে হলে, একটা তাগড়া গদ্যভাষা লাগে। সেই গদ্যভাষা লেখার নিবেদন ও প্রয়াস এই গ্রন্থ।

আমার সহকর্মী হাবিবুর রহমান হবির সহযোগিতা ছাড়া এই গ্রন্থপ্রকাশ ছিল অসম্ভব। তিনিই লেখাগুলো গুছিয়ে দিয়েছেন। লেখক ও গবেষক মোহাম্মদ খায়রুল হকের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাই। কতবার যে তার হোন্ডায় চেপে গৌরাঙ্গ আদিত্যের বাড়ি গিয়েছি; সহযাত্রী হওয়ার আবেদন মুখ কালো করে কোনোদিন তিনি বাতিল করে দেননি। বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতা জানাই গানপারের অন্যতম সম্পাদক কবি জাহেদ আহমদের প্রতি। গ্রন্থের প্রত্যেকটি লেখা তিনি পরম মমতায় পড়ে দিয়েছেন। বই প্রকাশে আগ্রহী করেছেন।

সমস্ত বিপাক এড়িয়ে গ্রন্থটি বেরোল। বই প্রকাশ করার প্রস্তাব সাগ্রহে গ্রহণ করে আমাকে কৃতজ্ঞ করেছেন চৈতন্যর প্রকাশক কবি রাজীব চৌধুরী। শেষে বলি, বিবেকসম্রাট খ্যাত শিল্পী গৌরাঙ্গ আদিত্যের প্রতি শ্রদ্ধায় নিবেদিত এই গ্রন্থ।

… …   

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you