চঞ্চল আশরাফ : স্মৃতিশূন্য স্ফূর্তিশূন্য জগতের কল্পকার || আহমদ মিনহাজ

চঞ্চল আশরাফ : স্মৃতিশূন্য স্ফূর্তিশূন্য জগতের কল্পকার || আহমদ মিনহাজ

সদা পরিবর্তনশীল জগতে অস্তিত্বের অর্থ ও নিরর্থকতার দ্বন্দ্বে উপসংহার টানতে ব্যগ্র কবিদের তালিকায় চঞ্চল আশরাফের নামটি প্রাসঙ্গিক হয়। মানবজীবনের নিয়তি সম্পর্কে পূর্বসিদ্ধান্তে অটল চঞ্চলের কবিতা অস্তিত্বের প্রতি স্ফূর্তিশূন্য মনোভাব ও অনুরূপ স্ফূর্তিবিহীন প্রস্থানকে কবিতার আধারবীজ করে নিয়েছে। ‘ব্যক্তি আমি’-র জীবনে শামিল থাকা ও সেখান থেকে নিষ্ক্রমণের ঘটনাকে নিখিল নাস্তিগর্ভে বিসর্জন দিতে ইচ্ছুক কবি রিডাকশনিজম (reductionism) বা খণ্ডত্ববাদী ভাববৃত্তে সুস্থির কবিতার সঙ্গে কদম মিলিয়ে হাঁটতে পছন্দ করেন। মানবজীবনের গতি ও পরিণাম সম্পর্কে নিজের মত ঠিক করে নিয়েছেন এবং সেখানে অটল থেকে পরিপার্শ্বের সঙ্গে সত্তার সংযোগ ও বিচ্ছেদের ঘটনা পাঠে আগ্রহী কবিদের বর্গে তাঁকে ভাবা যায় :—

ওহ! জীবাশ্মের নিচে চাপা প’ড়ে যায়
আমাদের কোট আর কার্ডিগান…
(একটি সভ্যতার শোকপ্রস্তাব)

যেতে যেতে শুক্রস্নান, ভ্রূণহত্যা, আড়ষ্ট চুম্বন, তন্দ্রাপ্লুত স্বর
যেতে যেতে ফিরে আসা, যেতে যেতে নিমজ্জিত ঘর
পুরনো চিঠির ভাঁজে গোলাপের বিবর্ণ পাপড়ির ভেসে ওঠা
যেতে যেতে যেতে যেতে

ফসফরাসের চকিত আলোর দিকে যেতে যেতে
কিছু দূর গিয়ে থেমে পড়া…
(নিমজ্জনচিত্র)

রেখে যাই মৃত শব্দ, আরো মৃত ঘাসের শিকড়…
কেবল রাখি না শুধু নিজেকেই, তাকে আমি সঙ্গী করে চলে যাই
সেই দূরে, যেখানে সবাই শোনে বোবাদের স্বর…
(অমরতা)

দ্যাখো যায়, অন্ধকার ঝুঁকে ঝুঁকে যায়
শাদা শাদা অন্ধকার যায়

হাতে বাঁশ কাঁধে লাশ…
(শবযাত্রা)

একদিন মনে হলো আকৃতির ধারণায়
কমলালেবুর আবেদন শেষ হয়ে গেছে—
পৃথিবী আসলে উপবৃত্তাকার সেদ্ধ ডিমের মধ্যে
বৃত্তাকার হলদে অংশের মতো গোল

আর একদিন মনে হলো—এসব কিছুই
দেয়ালে হিসির পর
উবে-যাওয়া মূত্ররেখার চেয়ে বেশি অর্থ
ধারণ করে না…
(স্মৃতিচারণ)

জীবনের অর্থ অনুসন্ধানে ওরাকলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার ঝোঁক চঞ্চলকে প্রণোদিত করে যায়। তিনি হলেন ওরাকল;—অস্তিত্ব যাপন ও নির্গমনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে রচিত বিচিত্র উপলখণ্ড যাকে বিস্মিত বা বিভ্রান্ত করে না! বস্তুপুঞ্জের জগতে নিজের মিলন ও সংঘাতের জায়গা চিনে নিতে যেসব বাকপ্রতিমা তাঁর কবিতায় ঠিকরায় সেখানে দ্বিধা, স্ববিরোধ, অনিশ্চয়তা ও প্রহেলিকার কুয়াশা একপ্রকার গরহাজির থাকে! স্ফূর্তিশূন্য বিঘোষণা সঙ্গে করে কবি অগত্যা জৈব সত্তা যাপন করেন এবং পাঠককে অনুরূপ যাপনের উসকানি দিয়ে চলেন।

নব্বইয়ের কবিতায় বিচিত্র পথে বিভ্রমের উপস্থিতি, পরিপার্শ্বের একঘেয়ে ছক থেকে নিষ্ক্রমণ অথবা ‘ব্যক্তি আমি’-র খোলসে গুটিশুটি মেরে সিঁটিয়ে থাকার প্রবণতা রয়েছে, সুখের ঘটনা হলো ওরাকলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেও চঞ্চলের কবিতা এইসব বেগার থেকে মুক্ত ও ঝরঝরে। নব্বইয়ের পরাভাষায় ব্যাপক চল হয়ে ওঠা মরমি বা আধ্যাত্মিক ভাবধারার সঙ্গে তাঁর সখ্য নিবিড় নয়। যৌনগন্ধি যেসব ঘটনা তাঁকে টানে সেখানে আবেগের আতিশয্য ও বিস্ময় ছাপিয়ে নিস্পৃহতা অধিক ছায়া বিস্তার করে। বিবমিষা তাঁর জন্য স্বাভাবিক হওয়ার কথা থাকলেও কেন যেন গৌণই থাকে শেষতক! যারপরনাই তথাকথিত নৈরাশ্যবাদী কবির কাতারে ফেলে তাঁকে পাঠ করার যুক্তি থাকে না। যৌনতাড়নার চক্রে নিপতিত মানুষকে বস্তুগত দুর্ঘটনার অতিরিক্ত স্বীকৃতি প্রদানে অপারগ চঞ্চলের কবিতা বায়বীয় নিরর্থকতায় সত্তার পরিণাম নির্ধারণ করে যায় : — ‘…আমাদের যৌনান্ধ জাগরণ শেষে হয়ে গেছে : যৌথ লাম্পট্য, মূর্খতা / দিগম্বর হাওয়ায় রেখে শরীরের ভর’ (দ্রষ্টব্য : দাম্পত্য)। মানব-অস্তিত্ব নিয়ে কবির ভাবনা এ-কারণে হবে হয়তো স্ফূর্তিশূন্য রিরংসায় ঝুঁকে থাকে! স্ফূর্তিশূন্য রিরংসার এমতো প্রয়োগ মানুষের সামগ্রিক যাপনকে শিশ্ন ও যোনির সংযোগক্ষমতায় সচল অস্তিত্বরূপে ভাবে এবং এর হ্রাসপ্রাপ্তিতে অস্তিত্বের পতন ও অন্ত দেখে ফেলে :—‘মানুষের অসমাপ্ত শিরদাঁড়া বেঁকে যায় শিশ্নক্ষমতা তার যখন বাজায় / শেষ ঘণ্টাধ্বনি…’ (দ্রষ্টব্য : চক্র)।

জীবনের স্ফূর্তিশূন্য পরিণামকে কবিতায় মহীয়ান করে তোলার শক্তি চঞ্চল আশরাফের স্বকীয়তা। নব্বইয়ের যুগবিশ্বে প্রবল হয়ে ওঠা সমগ্রতার ভাবনা অর্থাৎ খণ্ড ঘটনাকে অখণ্ড মালিকায় গেঁথে তোলার হোলিস্টিক (holistic) বা সামগ্রিকতাবাদী প্রবণতার বিপরীতে নিজেকে তিনি সচল রাখেন। তাঁর ভাষাবয়ান ঘোষণা করে,—জীবনের হাজারো অনুষঙ্গে মানুষের বিজড়ন ইন্দ্রিয়জ সংবেদনের রকমফের হলেও এটি তাকে নিরাময় করার ক্ষমতা রাখে না; সুতরাং রক্তমাংসে সজীব মানব-অস্তিত্ব উত্থানপ্রবণ থেকে উত্থানরহিত শিশ্নের পরিক্রমায় নিজের পরিশেষ ঘটাতে বাধ্য। নিজের এই নির্ধারণকে তিনি কবিতায় চরিত্র দান করেছেন এবং সেখানে তাঁর সফলতা স্বীকার যাওয়া উচিত। এমনকি, জীবনের চালচিত্রকে একত্রে গেঁথে সমগ্রতার প্রতিমা নির্মাণের ক্ষণে কবির মনোবিশ্বে সজাগ স্ফূর্তিশূন্যতায় বড়ো কোনো বিপর্যাস ঘটে না :—

যদিও অনেকবার বলেছি ধোঁয়ার কথা
আগুনের উৎসজ্ঞান কখনো ছিল না
পাহাড়চূড়ায় সারারাত বৃষ্টিপাত-শেষে
পাথরের গায়ে লেগে প্রবাহিত জল
জেনে গেল আত্মপরিচয়

নদী বলে : এত সরল সূত্র ধ’রে
আমি কি চলেছি?
বিশাল বরফখণ্ড আমার একক
উৎসের সামান্য তাপে সেটি অনেক গলেছে

এ-বৃত্তান্ত সমুদ্রকে বহুবার স্পর্শ করেছে…
(উৎস)

ওপরে উদ্ধৃত চমৎকার পঙক্তিমালার জনক কবি একরৈখিক আত্ম-অনুভবের খাঁচায় নিজেকে স্বেচ্ছাবন্দি রাখলেও কবিতাকে মন্ময় সংবেদি ভাষার খোরাক করে তোলা কৃতির পরিচায়ক এবং চঞ্চল আশরাফ সেই কর্মে কৃতবিদ্য বটে। তাঁর ভাষাঅঙ্গ থেকে নিঃসরিত বাকপ্রতিমায় ভ্রমণ করতে মন তাই বিমুখ বোধ করে না। অবশ্য নামে নব্বইয়ে বিরাজ করলেও কবির ভাষাবয়ন থেকে শুরু করে ভাবুকতা নব্বইয়ের সঙ্গে কদম মিলিয়ে হাঁটে কি-না সেই পুনর্পাঠ হয়তো একদিন প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবে। শামীম কবীরের মতো তাঁকেও দশকি-ছকের বাইরে বসে পড়তেই পাঠকের আরাম জোটে।


আহমদ মিনহাজ রচনারাশি

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you