সীমান্তবর্তী সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলা। যাদুকাটা গাঙপারে একটা জায়গা লাউড়ের-গড়। পথঘাটের অপ্রতুলতা আর দূরত্ব ইত্যাদি বিবেচনায় নিলে সুনামগঞ্জ শহর থেকে লাউড়ের-গড় পর্যন্ত পৌঁছানো অত্যন্ত ঝক্কির। দুর্গম বলা যাবে না আজ আর, ভ্রমণাভিযাত্রীর অভীপ্সা থাকলে আজকের দুনিয়ায় যাওয়া যায় না এমন জায়গা নাই বললেও হয়। কিন্তু এইটা নিশ্চয় বলা যায় যে দেশের আর-দশটা ট্যুরস্পটের ন্যায় লাউড়ের-গড় অত সুযোগসুবিধাবহুল নয়। শারীরিক ক্লেশের ব্যাপারটা মাথায় এবং প্ল্যানের মধ্যে রেখেই ভ্রমণে বেরোতে হয়। তীর্থভ্রমণে ক্লেশ যত বেশি পুণ্যও সমপরিমাণে। কেষ্ট চাইলে কষ্ট তো সইতেই হয়।
লাউড়ের-গড়ের নবগ্রামে এই তীর্থস্থল। তীর্থজল। পণাতীর্থ। পণ থেকে পণা। অদ্বৈত মহাপ্রভু পণ করেছিলেন তার মায়ের সুবিধার জন্যে এই গৃহলগ্ন নদীতেই ভূভারতের তীর্থসমুদয় এনে প্রতিষ্ঠা করবেন। করেছিলেনও। চলছে সেই সিলসিলা। লাখো জনতা আজও জড় হয় এই তীর্থে বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে। বছরভর হিন্দু পুণ্যার্থীরা লাউড়ের-গড় নবগ্রামে যাতায়াত করেন মহাপ্রভুর পুণ্যধাম দর্শনের মনোবাঞ্ছা নিয়ে। স্নানও সম্পন্ন করেন নদীতে নেমে। কিন্তু চৈত্রমাসের পণাতীর্থস্নান পরহেজগার পুণ্যার্থীদের জন্য অন্যতর মহার্ঘ।
শুধু অদ্বৈত মহাপ্রভুর পুণ্যস্নানের জন্য নয়, এই তীর্থস্থানের তাৎপর্য উঁচা তারে বাঁধা আরেকটা কারণে। একই সময়ে এইখানে কাল-নিরবধি অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে হযরত শাহ আরফিনের উরস মুবারাক। মহাপ্রভু অদ্বৈত আর বাবা আরফিনের ভক্ত-আশেকানদের এই মিলনমেলা একই জায়গায় গা-ঘেঁষাঘেঁষি অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে শত শত বছর ধরে। এমনটা সাধ্যাতীত যে কেবল অদ্বৈতপ্রভুর স্নান সেরে মালা জপতে জপতে ম্লেচ্ছ-যবনের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে ফিরে আসবেন কোনো সনাতনী কিম্ভুত পরলোকের পুণ্যযাত্রী, কিংবা পারবেন ছোঁয়াচ বাঁচায়ে মাজার তওয়াফ করে ফিরতে কোনো ছুঁৎমার্গলিপ্ত গোঁড়া মুসলমান। নবগ্রামে যারা যায় তারা ভালোবাসা বিনিময় করে, একের ধর্মাচার অন্যে দেখে আসে, দেখাদেখি আর ভাবের বিনিময় হয় নবগ্রামে। যে যায় স্নানে, সে তার মন্দিরের আচারকৃত্য সমাপনের পরে উরসের তামাশা দেখে; এবং একইভাবে উরসওয়ালারা মাজারের জিয়ারত সেরে স্নান আর মন্দিরওয়ালাদের আচারকৃত্য দেখে আসে।
মেলা বসে বিশাল। বিপুল জনসমাগমের সমস্ত জায়গাতেই মেলা হতে বাধ্য। উরস আর বারুণীস্নানের লোকেরা বাজারসদাই করে মেলা থেকে। বিচিত্র সব মনোহারী পণ্যের পসরা সাজায়ে বেচুয়ারা বসে আর কেনুয়ারা কেনে। এই মেলার আঞ্চলিক নাম বান্নি। পণাতীর্থের বান্নি। সিলেটে এমনটা বান্নি আরও হয়। এবং সমস্ত বান্নিই দর্শনীয়। চৈতন্য মহাপ্রভুর বাপের ভিটা ঢাকাদক্ষিণে যে-বান্নি হয় চৈত্রের সব-কয়টা রবিবার জুড়ে, সেই বান্নি বহরে এবং ভাবেসাবে এতই তাৎপর্যমণ্ডিত যে মেলাকালীন এর নিদর্শন স্বচক্ষে দেখা ছাড়া মুখে বলে বোঝানো সম্ভব নয়।
আরফিন-অদ্বৈত একটা হাইফেনে আবদ্ধ করে এই তীর্থ বর্ণনা করতে পারাটাই বর্তমান বাংলাদেশে একটা কাজের কাজ হওয়ার কথা। খালি সিলেটেরই নয়, বাংলাদেশের আনাচকানাচ থেকে ব্যাপক হিন্দু-মুসলমানের জমায়েত হয় এইখানে এই অন্তিম বাংলা মাসের দুই-তিন দিন ধরে। এখানে এই পিলগ্রিমেইজে পিলগ্রিমরা আসেন ইন্ডিয়ার বহু দূরদুরান্ত থেকে। এমন লোকায়ত লৌকিক বাংলার পরিচয় এখনকার জেনারেশন ভাবে কেবল বইপুস্তকেই মিছামিছি লেখা হয়ে থাকে, অথচ এমন মেলা বাংলাদেশের বহু প্রত্যন্ত এলাকায় মাজারে-মন্দিরে বছরচক্রের বিভিন্ন সময়ে হয়ে থাকে। এই বাংলার খোঁজে নেমে কেউ অনর্থ হতাশ প্রজন্ম হিশেবে বেড়ে ওঠার চক্করে পড়বে না আশা করা যায়।
শাহ আরফিনের উরস আর অদ্বৈত মহাপ্রভুর পণাতীর্থস্নান প্রতিবছর চৈত্রমাসের মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশী তিথি পঞ্জিকামতে হয়ে থাকে। স্নানের জন্য লগ্ন-তিথি মেন্টেইন করা লাগলেও উরস বা বান্নিমেলার তো সেই বালাই নাই। ব্রহ্মার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যই তীর্থস্নান, সমস্ত জরা-পাপতাপ ধুয়েমুছে স্বর্গদুয়ার হাসিল করা যাবে বলেই বিশ্বাস করেন স্নানার্থীরা। হাজার-হাজার মানুষ সমবেত হন শুধুই নিজের আত্মার সন্তুষ্টি অর্জনের নিমিত্তে, মেলায় ভাসতে, মানুষ দেখতে, মানুষের সঙ্গে কথা বলতে, মানুষের কাণ্ডকারখানায় শরিক হতে। শেষোক্ত দলের মানুষের বাড়বৃদ্ধির উপরেই নির্ভর করছে বহুকিছু, ভবিষ্যৎ, বর্তমান, গোটা বাংলাদেশ।
ছবিগুলো পণাতীর্থস্নানের কিছু আচারকৃত্য ফোকাসে রেখে ধারণ করা হয়েছিল ২০১৩ খ্রিস্টাব্দের দিকে। এরচেয়ে বেশি কিছু বলা লাগবে না আশা করছি ইমেইজগুলোর ব্যাপারে। সেল্ফ-এক্সপ্ল্যানেটোরি হবার কথা আলোকচিত্রগুলো।
ছবিগুলোর উপরে কার্সার রেখে আলতো চাপ বা ক্লিক দিলেই ইমেইজগুলো খানিকটা লার্জ দেখাবে।
পণাতীর্থস্নান চিত্রগুচ্ছ
… …
- খোন্দকারের রচনাসংগ্রহ || প্রণবেশ দাশ - June 16, 2024
- ছবিনিবন্ধ : চড়ক || প্রণবেশ দাশ - April 13, 2019
- ছবিনিবন্ধ : পণাতীর্থ || প্রণবেশ দাশ - April 5, 2019
COMMENTS