জলধামাইল || অসীম চক্রবর্তী

জলধামাইল || অসীম চক্রবর্তী

অধিবাস মানে হচ্ছে যে-কোনো বড় সনাতনী অনুষ্ঠানের আগের রাত। সেটা বিয়েও হতে পারে, অন্নপ্রাশন হতে পারে, আবার  উপনয়নও হতে পারে। অর্থাৎ উদযাপনের ঠিক আগের রাতের মাস্তিময় সময়টুকু, অনেকটাই চানরাইত আর খ্রিস্টমাস-ইভের মতো ব্যাপার। আধুনিক গায়ে-হলুদের সাথে অনেকটা মিল থাকলেও রিচুয়াল আর উদযাপনের ধরন একেবারেই ভিন্ন।

আমরা আমাদের ছেলেবেলা পর্যন্ত দেখেছি বরাক উপত্যকার হিন্দুরা বিশেষ এক উপায়ে অধিবাস উদযাপন করে থাকেন, যে-অধিবাসে কিছু সনাতনী রিচুয়াল থাকে। যেমন অনুষ্ঠান যাকে ঘিরে তাকে সেই রাতে দুবার স্নান করানো হয়। ধানদূর্বা দিয়ে আশীর্বাদ করানো হয়। বাড়িভর্তি আত্মীয়স্বজন, গমগমে একটা ব্যাপার থাকে। বিস্তর খাওয়াদাওয়া হয়। রাতভর ধামাইল নৃত্য থাকে। উঠতি যুবাদের মধ্যে থাকে প্রেম-অপ্রেমের উস্কানি।  কালোবাঁশি থাকে। থাকে কর্নেট, কাশি, ঝুনঝুনি আর ঢোলের বাদ্য। সেই ধামাইল গানের মাধ্যমে ধামাইলশিল্পীরা গুরুবন্দনা করেন, জল ভরতে যমুনায় যান, রাধাকৃষ্ণকে একে অপরের প্রেমে ফেলেন, তারপরে রাধাশ্যাম বিচ্ছেদ হয়, রাধাকে ছেড়ে কৃষ্ণ ভুলে চন্দ্রার কুঞ্জে চলে যান, রাধার হৃদয় বিচ্ছেদের বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়, অতঃপর কৃষ্ণ নিজের ভুল বুঝে চন্দ্রার কুঞ্জ ত্যাগ করে রাধার কুঞ্জে ফিরে আসেন। ভোররাতে রাধাকৃষ্ণের মিলন হয়। অতঃপর ভোররাতে রাধাকৃষ্ণের মিলনের ধামাইলের মাধ্যমে শেষ হয় অধিবাসের উদযাপন পর্ব।

মাঝেমধ্যে ধামাইলশিল্পীদের মধ্যে চলে গ্রুপিং এবং বাহাস। কারণ একটা গান এদিক-সেদিক হলেই রাতভর ধামাইলের সিক্যুয়াল নষ্ট হয়ে যাবে। প্রায় একই ধরনের ধামাইলগান দেখা যায় সূর্যব্রতে। সূর্যব্রত করেন হিন্দু নারীরা। অনেকটা উদয়াস্ত টাইপের ধামাইল। সূর্যব্রত হয় মাঘ মাসে। মাঘ মাসের কুয়াশাময় সকালে সূর্যবন্দনা দিয়ে শুরু হয়, তারপরে হয় শ্রীকৃষ্ণের গোষ্ঠলীলা উপজীব্য করে রচিত ধামাইল গান, তারপরে হয় ফিরাগোষ্ঠ এবং সবশেষে কৃষ্ণ ফেরেন মায়ের কোলে। গোষ্ঠলীলায় রাধাপ্রেমের সাথে অন্য যে-প্রেম সার্বজনীন হয়ে ওঠে তা হলো বাৎসল্যপ্রেম এবং ভ্রাতৃপ্রেম অর্থাৎ সুবলসখা এবং দাদা বলরামের সাথে কৃষ্ণের যে আত্মিক সম্পর্ক সেই সম্পর্কের গল্পগাথা।  সেই গল্প বলব আরেকদিন অন্যকোনো গল্পআড্ডায়।

তো যা বলছিলাম, অদ্য অধিবাসের বৈকাল। এপাড়া-ওপাড়ার গীতুলীরা চলে এসেছেন সদলবল। অতঃপর শুরু হলো পানের জন্মকথা, সুপারির মর্মকথার সুরময় বৈঠকী সমবেত সংগীত। ওদিকে সুর্য প্রায় ডুবিডুবি। এমনি কমলারঙের গোধূলির পরেই কড়া লিকারের দুধচা পান করে করে পানসুপারির রস আস্বাদনশেষে প্রধান গীতুলী সহ বাকি গীতুলীরা নিজেদের ব্রজগোপী হিসাবে উপস্থাপন করে বাজখাঁই গলায় শুরুয়াৎ করলেন রাতভর ধামাইলের শ্রীকৃষ্ণবন্দনা :

 প্রথম বন্দনা-যে করি, প্রথম বন্দনা-যে করি
এগো জয়জয় কিশোরীর জয় শ্যামচান্দবিহারী।
কত সতীরে অসতী করলায়, অসতীরে সতী
এগো পতিপুত্র ছাইড়া আমরা হইলাম বনাচারী …

প্রথমে একতালে চলে গানের পুরো অংশ। ধীরে ধীরে লয় বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে ঘূর্ণায়মান ধামাইলের কাফেলার গতি। তাল বাড়ে। একতাল থেকে ঝুমুর ছন্দে দুইতালে যায়। তারপরে ষোলোমাত্রায় পৌঁছানোর পরে ঝরে পড়ে ধামাইলের সৌন্দর্য। ধামাইলনৃত্যের চক্র ঘুরতে থাকে নাগরদোলার মতো। আস্তে করে অভিজ্ঞতাময়ী গীতুলী  আলতো করে চারতালে নিয়ে  যান হ্যাঁচকা টানে। সবশেষে আবার ফিরে আসেন দ্রুতলয়ের একতালে  এবং সেইসাথে পূর্ণাহুতির আগুনে জল ঢেলে শান্ত করার মতোই ধীরে ধীরে পদকর্তার নামাঙ্কিত শেষ পয়ার ছন্দের সাথেই শেষ হয় ধামাইলনৃত্য। এভাবেই রাতভর চলতে থাকে।

তবে কিছু কিছু গান আছে যেগুলোর ধামাইলনৃত্য একেবারেই আলাদা। একে বলে সাতপাড়া ধামাইল। অর্থাৎ গীতুলীরা ধামাইল গান ধরে পাঁচপাড়া সামনের দিকে গিয়ে দুইপাড়া আবার পেছনের দিকে ফিরে আসেন। এই ধামাইল হয় পঞ্চতালের। এইমুহূর্তে এ-রকম একটা গান মনে পড়ছে, সেটা হলো “সখিসঙ্গে মনরঙ্গে …”। আবার কিছু ধামাইল হয় জোড়ায় জোড়ায় একে অপরের সাথে একধরনের কানেকশন তৈরি করে। সেইসাথে থাকে ঠাট্টাবিদ্রুপ এবং খিল্লি করে গানও।

কোনো বিভক্তি ছাড়াই দাঁড় হয়ে যায় দুটি গ্রুপ। ধীরে ধীরে বাড়ির আঙিনা মুখর হয়ে ওঠে গ্রামের মানুষে। এক গীতুলীর ধামাইল শেষ হবার সাথে সাথে গান ধরেন আরেক গীতুলী। রাতভর চলে যমুনার জলে জল ভরতে যাওয়া জলের গান, রাধাকৃষ্ণের লুকোচুরিপ্রেমের আখ্যান, অভিসার, বিরহ, বিচ্ছেদ এবংমিলন। সব পর্বই গীতুলীরা বরাক উপত্যকার বিশেষ করে সিলেট অঞ্চলের গীতিকবিদের লেখা সুর-করা ধামাইলগানের মাধ্যমে সাংগীতিক প্রকাশ করেন। ধারণা করা যায় ধামাইল গানের অগ্রদূত শ্রী রাধারমণ দত্ত অনুপ্রাণিত হয়েছেন মধ্যযুগীয় শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের মাধ্যমে, সেইসাথে রয়েছে চৈতন্যচরিতামৃতের অনুপ্রেরণা।

ধামাইল রচনায় যাদের নাম অগ্রগণ্য তারা হলেন শ্রী রাধারমণ দত্ত, মহেন্দ্র, ব্রজনাথ, রসিক লাল সহ আরো অনেকে। পরবর্তী সময়ে ধামাইলের সুর এবং ভাব ধারণ করে অনেক মুসলমান গীতিকবিরাও তাঁদের গানে রাধাকৃষ্ণের অপার্থিব প্রেমের আখ্যান উপস্থাপন করেছেন। সিলেটের মুসলমান ধামাইলরচয়িতার মধ্যে আছেন বাউল শাহ আবদুল করিম এবং ক্বারী আমীর উদ্দীন। সুনামগঞ্জের অদূরে এক বিবাহ-অধিবাসে শুনেছিলাম ক্বারী আমীর উদ্দীনের “কুহুসুরে মনের আগুন আর জ্বালাইয়ো না” গানের মর্মস্পর্শী ধামাইল সংস্করণ। আর আবদুল করিমের “কুঞ্জ সাজাও গো আইজ আমার প্রাণনাথ আসিতে পারে” গানটিতে ফুটে ওঠে চরম বিচ্ছেদেও শ্রীরাধার  কৃষ্ণদর্শনের আশার বাণী।

যা-ই হোক, ওদিকে কানু হারামজাদা কিন্তু বাঁশিতে মরণসুর তুলেছে। সেই বাঁশির সুর উপজীব্য করে ধামাইলের প্রথমেই হয় বাঁশির গান। যেখানে কৃষ্ণের বাঁশিকে নানাভাবে বর্ণনা করা হয়; কখনো মরণবাঁশি, কখনো প্রাণের বাঁশি, কখনো বিষের বাঁশি, নিলাজ বাঁশি ইত্যাদি । বাঁশিতে কখনো প্রাণের সুর, কখনো বুকে আফাল-তোলা বিরহের সুর আবার কখনো মরণের সুর। কৃষ্ণ বাঁশিতে জিকির করছেন রাধানামের। সারাপাড়া মাতোয়ারা। গোটা ব্রহ্মাণ্ড উদ্ভ্রান্ত। ব্রজগোপীরা  ছোটাছুটি করছেন। ভাটিয়াল নদী উজানে বইছে।  রাধা কেমনে ঘরে থাকেন! অবশেষে শ্যামের বাঁশি রাধাকে বাহিরে নিয়ে আসে। প্রেমময়ী রাধা উতলা হন। রাধার আকুলতা রাধারমণ দত্ত প্রাণপণে ধারণ করেন, ধামাইল লেখেন, সেই ধামাইল গীতুলীদের কণ্ঠে বাজে :

ডাইকো না রে শ্যামের বাঁশি জয়রাধা বলিয়া
হায় রে শ্যামচান্দের বাঁশি কই বিনয় করিয়া …

গান শেষ হলেই রাধারমণের দুঃখ বর্ণনা করতে আরেক গীতুলী ধরেন রাধারমণের আরেকটি গান :

কালায় প্রাণটি নিলো বাঁশিটি বাজাইয়া
কে বাজাইয়া যাও রে বাঁশি রাজপন্থ দিয়া
আমারে নি থৈয়া গেলায় উদাসী বানাইয়া রে
ভাইবে রাধারমণ বলে শোনো রে কালিয়া
নিভিয়া ছিল মনের আগুন কে দিলো জ্বালাইয়া রে …

সেইসাথে রাধার উথলে-ওঠা কৃষ্ণপ্রেম আর বাঁধ মানে না। জাগতিক মোহ তুচ্ছ করে রাধা মহাজাগতিক কৃষ্ণপ্রেমে আচ্ছন্ন।  সেই আচ্ছন্নতা পুঞ্জীভূত করে আরেক গীতুলীর কণ্ঠে ঝরে রাধার জন্য মর্মবেদনা।  গেয়ে ওঠেন :

আমার বন্ধুর বাঁশি বাজে কোনোস্থানে গো নিষেধ আর মানে না  …

কিন্তু কে শোনে কার কথা। অবিরাম বেজে চলে কানাইয়ার বাঁশি। বাঁশিতে কি রাধা একাই পুড়ছেন ? কৃষ্ণ কি একটুও বিরহগরলে নীল হচ্ছেন না? অবশ্যই হচ্ছেন।  রাধাদর্শনের জন্য সখাদের কাছে কৃষ্ণের আকুতিকে ধারণ করেন রাধারমণ দত্ত। গীতুলী সেই আকুতি তুলে আনেন ধামাইলে। ধরেন গান :

আজ কেনে রে প্রাণের সুবল রাই এল না যমুনাতে
আমি রাই অপেক্ষায় প্রাণ ত্যাজিব
না আসিলে যমুনাতে …

অথবা রাধা যমুনাতে না আসার বিরক্তিতে অবসাদগ্রস্ত হওয়া কৃষ্ণে মনে মনে ভাবছেন রাধা রূপের দেমাগে হয়তো দেখা করতে আসছেন না। অভিমানভরা কৃষ্ণের আবেগ প্রকাশ করতে গীতুলীরা ধরেন রাধারমণ দত্তের ধামাইল :

আমারে আসিবার কথা কইয়া
মান করে রাই রইয়াছ ঘুমাইয়া।

নারীজাতি কঠিন অতি
বোঝে না পুরুষের মতি

সদাই থাকে নিজেরে লইয়া
তুমি করছ নারী রূপের বড়াই
রাধারমণ যায় গাইয়া …

নানা গবেষণায় জানা যায় একমাত্র শ্রী রাধারমণ দত্ত রাধার ব্যথা সবচেয়ে বেশি অনুভব করতে পেরেছিলেন। সেইসাথে গভীরভাবে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন আত্মস্থ করে ধামাইলের প্রতিটা ধাপ অর্থাৎ বাঁশি, জল, বিচ্ছেদ আর মিলনের অপূর্ব সব গান রাধারমণ দত্তই সৃষ্টি করে গেছেন।

বাঁশির গান শেষ হলেই শুরু হয় জলের গান। অধিবাসের প্রধান কর্ত্রী অর্থাৎ যাকে ঘিরে অনুষ্ঠান তার মাতৃস্থানীয় একজনকে সর্বাগ্রে রেখে বাড়ির সমগ্র নারীকুল কলসি কাঁখে চলেন জল ভরতে। পিছনে থাকে বাদ্যবাজনা। আমাদের ছেলেবেলায় পাম্পলাইট বা হ্যাজাকবাতি জ্বালানো হতো এসব অধিবাসের রাতে। পাড়াপ্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন অথবা বাড়ির উঠতি তরুণদের কেউ-একজন সবার আগে চলতেন সেই হ্যাজাক নিয়ে। ছেলেবেলায় হ্যাজাক ধরা বড়ভাই বা কাকুদের খুব ঈর্ষা করতাম। কী সুন্দর সতর্ক চোখে দুইহাত দিয়ে নায়কোচিতভাবে সর্বাগ্রে তারা হেঁটে যেতেন! ও হ্যাঁ, সাথে থাকতেন গীতুলিরাও। তারা গাইতেন রাধার যমুনার ঘাটে যাওয়ার বাহানা এবং জলে যাওয়ার গান।

শুরু হয় জলের ছলে রাধাকৃষ্ণের দেখা-হওয়ার ছল। রাধা কাঁচা কাঠে আগুন জ্বেলে চোখের জল লুকান। ঘরের ভরাকলসি-জল বাহিরে ফেলে জাগতিক ভালোবাসা আর মায়ার বাঁধন টুটে বের হন কৃষ্ণপ্রেমের মহাজাগতিক ভালোবাসায়। ব্রজগোপীরা রাধাকে হুঁশিয়ার করেন সেইসাথে কৃষ্ণরূপের মহিমা বর্ণনা করে উস্কানিমূলক কথাবার্তাও। আবারো রাধারমণ দত্তের আবেগ ধারণ করে গীতুলী ধরেন গান :

জলের ঘাটে দেইখ্যা আইলাম
কী সুন্দর শ্যামরায়
শ্যমরায় ভ্রমরায় ঘুইরা ঘুইরা মধুখায়…
ভাইবে রাধারমণ বলে
পাইলাম না রে হায় রে হায় …

সখীরা রাধাকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেন কালিয়ার জলে গেলে জাত থাকবে না, কালাচাঁদ কৃষ্ণ জাতকুলমান সব হরণ করবে। সেই কুলমান হারানোর আশংকা ঘিরে রাধারমণ আবারো লেখেন :

জলে যাইয়ো না গো রাই
আজ কালিয়ার জলে যাওয়ার জাতের বিচার নাই।

শেষ হতে না হতেই আরেক গীতুলী ধরেন :

জলে গিয়াছিলাম সই
এগো কালা কাজলের পাখি
দেইখ্যা আইলাম ওই।

সোনার পিঞ্জিরা সই গো
রুপার টাঙ্গুনি
আবের চান্দুয়া দিয়া পিঞ্জিরার গাঁথুনি …

আবারো শুরু হয় :

জলের ঘাটে কী রূপ
দেখলাম গো বিশাখা

মেঘের বরন শ্যাম
ওগো শ্যাম ওগো শ্যাম
মেঘের বরন শ্যাম।

চলে অভিসার, অভিমান। চলে লুকোচুরি প্রেম। জলের ছলে ক্ষণিকের দেখা হয়। চৈতন্যচরিতামৃতে এই দর্শনকে বলা হয় চারচক্ষুতে মিলন। কিন্তু তাতে কি মেটে কৃষ্ণপ্রেমের ক্ষিদে? কিন্তু কৃষ্ণ তো বাঁধা থাকেন না। তিনি সার্বজনীন। তবে তিনি বাঁধা থাকেন প্রেমের সুতোয়। যে সুতো আবহমান মানববংশকে অদৃশ্য ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করে রাখার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। যদিও আজকের বাস্তবতায় সেই সুতোয় টান পড়েছে। ধীরে ধীরে মানুষের মনে প্রেমের বদলে জেগে উঠছে দানবীয় চরিত্র। সমগ্র বিশ্ব অতিবাহিত করছে এক দানবীয় সময়। এই ক্রান্তিকালকে দুপায়ে সরিয়ে দিতে প্রয়োজন পারস্পরিক নির্মোহ প্রেম। যাকগে, এসব রাজনৈতিক কথা হবে অন্য কোথাও অন্য কোনোখানে।

তো যা  বলছিলাম। স্বল্প দর্শন শেষে শুরু হয় দীর্ঘ বিরহ। আসলে আনন্দময় মিলন হচ্ছে বেঁচে থাকার রসদ আর কষ্টময় বিরহ হচ্ছে বেঁচে থাকার প্রবল চেষ্টা। সুদিনের জন্যই আমরা বেঁচে থাকি। সুদিন আসবে বলেই আমরা যাবতীয় দুঃখকষ্ট-হতাশা দুপায়ে দলে আনন্দময় মিলনের জন্য কাজ করি।

অতঃপর রাধাও ভাসেন বিচ্ছেদের অনলে। শেষরাতে রাধাকৃষ্ণের এই বিচ্ছেদী গান তথা ধামাইলে একবার যে মাতোয়ারা হয়নি তার জীবনের ষোলোআনাই মিছে। ভোররাতের বিচ্ছেদী ধামাইলে গীতুলীরা একদল হন রাধার পক্ষে আর আরেকদল কৃষ্ণের পক্ষে। গীতুলীরা গভীর রাতে লম্বা সুরে ধীরলয়ে বিচ্ছেদী গান ধরেন। ধীরে ধীরে গানের লয় বাড়ে। বাড়তে বাড়তে একপর্যায়ে মাতমের মতো শোনা যায় রাধার বিচ্ছেদের আবেগ। পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার বাঁশিতে শিবিরঞ্জনী রাগ যেমন গায়ের লোমকূপে শিহরণ তোলে ঠিক তেমনি কি জানি কিসের লাগি বুকের মধ্যে শুরু হয় রাধার বেদনার হাহাকার … বিরহের এমন বাহার দেখা যায় শাস্ত্রীয় সংগীতের অন্যতম শাখা ঠুমরিতে।  যেখানে আমরা শুনতে পাই কৃষ্ণদর্শনের জন্য রাধার হাহাকার। তেমনি কিছু ঠুমরির মধ্যে কুমারগন্ধর্বের কণ্ঠে খাম্বাজ রাগের উপরে ঠুমরির বান্দিশ যমুনাকিনারে মেরা গাঁও, য়সাভারে আই যাইয়ো অথবা উস্তাদ বড়ে গোলাম আলীর কণ্ঠে আয়ে না বালাম ক্যায়া কারু সজনী অথবা বর্তমান শাস্ত্রীসংগীতকার পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তীর কণ্ঠে ইয়াদ পিয়া কি আয়ে, এ দুঃখ সহন না যায়ে  … যেন একই সুরে রাধার বিচ্ছেদ বর্ণনা করছে। এমন আবেগী মুহূর্তে লোকজ ধামাইল আবারো রাধারমণ হয়ে ওঠেন ভরসার অকুস্থল। গীতুলীরা বিচ্ছেদ বর্ণনা করতে রাধারমণ দত্তের দ্বারস্থ হন :

বিধি যদি পাখা গো দিত
আমি উইড়া গিয়া দেখতাম শ্যাম জনমের মতো
আমার শ্যামের সাথে দেখা বুঝি না হইল গো।
শ্যামকালীয়া রূপে আমায় পাগল করল গো …

আমি জানি না আর কারো হয় কি না। তবে কিছু কিছু মুহূর্তে আমার বুকের ভেতরটা খালি হয়ে যায়। যাকে আমি বলি বুকের ভেতর খালি করা অনুভূতি। শেষরাতের বিচ্ছেদের সুরে আমার বুকের ভেতর খালি হয়ে আসে। আমি আসক্ত হই। কৃষ্ণের প্রতি আমার করুণা হয়। আমি শিখি নিজের আনন্দ থুড়াই কেয়ার করে অন্যের আনন্দ উদযাপন করতে। তবে কষ্ট হয় রাধার জন্য। তখনি অপর প্রান্ত থেকে আরেক গীতুলী ধামাইলে সুর তোলেন :

আমার বন্ধুর বাঁশি বাজে কোন স্থানে গো
নিষেধ আর মানে না
আমি আগুনে পুড়াইয়া বাঁশি
পুরাইতাম মনের বাসনা।

 আরো চলে :

রবো না রবো না গৃহে বন্ধুবিনে প্রাণ বাঁচে না …
জন্মের মতো দিয়া ফাঁকি, উইড়া গেল প্রাণের প্রাণপাখি …

এলোকেশী রাধার মনের মর্মবেদনা পুঁজি করে রাধারমণের পদে গীতুলী গেয়ে ওঠেন :

কারে দেখাব মনের দুঃখ গো আমার বুক চিরিয়া
অন্তরে তুষের আগুন জ্বলে গইয়া গইয়া  …

বিচ্ছেদী গানে শরৎ নামের এক পদকর্তা যার নামের উপাধি জানা না গেলেও তার গানটি সমাদৃত হয়েছে সমগ্র বিশ্বের বাঙালিদের কাছে।  অনেকে সুর বিকৃত করে গেয়েছেন, অনেকে আবার  নিজের মতো কথা বসিয়েও গেয়ে থাকেন।  গানটি হলো :

বনমালী গো তুমি পরজনমে হৈয়ো রাধা  …
তুমি বুঝিবে তখন নারীর কি বেদন
শ্রীরাধার মনে কত ব্যথা। …

ধামাইল

অর্থাৎ কৃষ্ণবিরহে আক্রান্ত রাধা প্রায় অভিশাপ দিয়েই বলছেন হে কৃষ্ণ পুনর্জন্ম বলে যদি কিছু থাকে তবে সেই জন্মে আমি হব শ্রীনন্দের নন্দন বনমালী (কৃষ্ণের আরেক নাম) আর তোমাকে বানাব রাধা। তখন তুমি বুঝবে বিরহযন্ত্রণা কাকে বলে।

ধামাইলে বিরহ অঙ্গের  গানের শেষে পয়ার ছন্দে রাধারমণ দত্ত “ভাইবে রাধারমণ বলে প্রেমানলে অঙ্গ জ্বলে …”  ” টাইপ কথাবার্তা দিয়ে রাধারমণ অপার্থিব প্রেমের হাহুতাশ প্রকাশ করেছেন। ওইদিকে কৃষ্ণও জ্বলছেন মরমবেদনায়। সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি হলো কৃষ্ণ ভুলে রাধার বাসরে যেতে গিয়ে ভক্তপ্রেমে বাঁধা পড়ে চলে যান চন্দ্রার কুঞ্জে। চন্দ্রা হচ্ছেন মধ্যযুগীয় মাইথোলজির শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের আরেক রূপক চরিত্র। যিনি হচ্ছেন কৃষ্ণভক্ত। ভক্তের অধীনেই থাকেন কৃষ্ণ। তাই কারো প্রাণপণ ডাকই উপেক্ষা করতে পারেন না। চন্দ্রার ডাকও উপেক্ষা করতে পারেননি কৃষ্ণ, চলে যান চন্দ্রার কুঞ্জে। আর এদিকে শ্রীমতী রাধিকা কুঞ্জ সাজিয়ে বসে আছেন আসন্ধ্যা। আবার এদিকে কৃষ্ণ চলে গেছেন চন্দ্রার কুঞ্জে। হঠাৎ করেই মনে পড়ল প্রাণের রাধার কথা। ব্যাস, কৃষ্ণ রাধাদর্শনের জন্য ব্যাকুল হলেন।

গীতুলী আবারো লম্বা সুরে ধীর লয়ে  বিচ্ছেদী সুরে গান ধরেন :

চন্দ্রা দাও গো বিদায়
না-জানি কি করে আমার
প্রাণের রাধায়।

এগো কুকিলায় কইরাছে ধ্বনি
নিশি গইয়া যায় …

অপর দলের গীতুলীরা চন্দ্রার দুঃখ  ধারণ করে সুর তোলেন :

বন্ধু অউত্ত যাইরায় গিয়া
অবলা আমারে বন্ধু একলা ফালাইয়া …

অন্যদিকে রাধার কুঞ্জে চলছে তুলকালাম কাণ্ড। অষ্টসখি নিয়ে রাধা কুঞ্জ সাজাচ্ছেন। আতর, গোলাপ, ছুয়াচন্দন কোটরে ভরে সাজিয়ে রাখা হচ্ছে। রাধাও সেজেছেন মোহন রূপে। বাউল আরকুম শাহের রচনা থেকে জানা যায় ময়ূরবেশে সাজগোজ করে রাধা আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে আছেন।  কিন্তু কৃষ্ণ তো আসছেন না।  চিরদুঃখী রাধার মনে আবারো বিরহের মেঘ। সেই মেঘ ঝড়ে রূপান্তরিত করে রাধারমণের সুরে গীতুলীরা বৃন্দস্বরে ধরলেন :

মনে নাই আমারে বন্ধুয়ার মনে নাই
আমি কৃষ্ণের আশায় বসে বসে রজনী পোহাই গো  …

অপর প্রান্ত থেকে অন্য গীতুলীর দল ধরেন :

বন্ধু আইলায় না রে হায়
তোমায় ছাড়া সুখের নিশি প্রভাত হইয়া যায়।

ভাইবে রাধারমণ  বলে রে বন্ধু করি কি উপায়
পন্থপানে চাইয়া রইছি তোমার অপেক্ষায়  …

অবশেষে কৃষ্ণ ফিরলেন রাধার কুঞ্জে। এবার আর শুধু চারচক্ষুতে নয়, এবার একই অঙ্গে রাই-কানাইয়ের মিলন।  এই সময়টাতে গীতুলীদের মধ্যেও দেখা যায় প্রাণের উচ্ছ্বাস। এবার আর কোনো বাহাস নয়, তর্ক নয়, দলাদলি নয়।  আবারো  সেই বন্দনার মতো এক হয়ে বাজখাঁই গলায় ধরেন :

কুঞ্জে মিলন হেরো গো
দেখো দেখো সখি শ্যামের বামে
রাই দাঁড়াইল।।

শ্যামের বামে রাই দাঁড়াইল
বাহুর উপর বাহু
পূর্ণিমার চন্দ্র যেন
গ্রাস করিল রাহু …

শ্যামের হাতে মোহন বাঁশি
রাইয়ের মাথায় বেণী
শ্যামের চূড়ায় ঝিলমিল
রাইয়ের বেণী ধরে ফণী …

কুঞ্জে মিলন হেরো গো।।

চারপাশ থেকে প্রেমধ্বনি আর উলুধ্বনি ওঠে মুহুর্মুহু, গীতুলীরা গান ধরেন :

দেখো রঙে রঙে রাইরঙ্গিনী
নাচিয়া বেড়ায় দেখো গো
বৃন্দাবন আজ প্রেমে ভাইস্যা যায়

হাত বাড়াইয়া শ্যামচাঁদে গো
দেখো ধরে রাইর গলায়
ওরে একই অঙ্গে এক মুরলি
তারা দুইজনে বাজায় দেখো গো  …

এদিকে রাত ভোর হয়-হয়। পুবআকাশে লাল সূর্য। যশোদা মায়ের প্রতি বাৎসল্যপ্রেমের টানে কৃষ্ণকেও বাড়ি যেতে হয়। শুরু হয় বিদায়বন্দনা।

গীতুলী এখন আরেক গীতিকবি ব্রজনাথের আবেগ ধারণ করে গেয়ে ওঠেন :

জাগিলে পাড়ার লোকে
আমায় বলবে চোর
রাধে নিশি হলো ভোর
বিদায় দাও গো বিধুমুখী
যাই বহুদুর …

রাধে গো ভাবিয়া কয় ব্রজনাথে
কেউ যদি কেউ দেখে পথে
চলিতে চরণে না পাই জোর
ও তোমার কূলমান বাঁচাইয়া রাইখো
ননদী নিষ্ঠুর …

ধর্মবিশ্বাসের উর্ধে উঠে ননীচোরা কৃষ্ণ হলেন মানবপ্রেমের এক মূর্ত প্রতীক। যাকে ঘিরে বাৎসল্যপ্রেম থেকে শুরু করে জাগতিক এবং মহাজাগতিক প্রেম এবং মানবতত্ত্বের নিগূঢ় আখ্যান রচিত হয়েছে। বাংলার লোকায়ত সংস্কৃতি আর কৃষ্ণলীলা যেন এক অচ্ছেদ্যঅঙ্গ। কৃষ্ণ কোথাও সন্তান, কোথাও ভক্তের প্রেমডোরে বাঁধা ভগবান, কোথাও একজন অতি তুচ্ছ নগণ্য প্রেমিক আবার কখনো সকল জাগতিক মায়ার উর্ধে গিয়ে বর্ণনা করেছেন মানবমুক্তির কথা। জাগতিক ইন্দ্রজাল ছিন্ন করে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অন্যায়ের বিরুদ্ধে গাণ্ডীব ধরতে তিনিই অর্জুনকে উৎসাহিত করেছেন। সেই কৃষ্ণ এবার বাৎসল্যপ্রেমের টানে ধীরে ধীরে মায়ের কাছে চললেন। আমরা যারা রাতভর ঢোলক, কর্নেট, কালোবাঁশি, কাশী আর মঞ্জিরার সাথ মশগুল হয়ে ধামাইলে  মাতোয়ারা ছিলাম তারাও বাড়ি ফিরছি অথবা নিজবাড়ির অধিবাস হলে দিনের মূল কর্মসূচির জন্য প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছি। সারারাতের নির্ঘুম চোখ  তখন সকালের রক্তজবার মতো লাল, মনের মধ্যে তখনো চলছে বিচ্ছেদিগানের মাতম আর কানের মধ্যে বাজছে :

বন্ধু অউত্ত যাইরায় গিয়া
অবলা রাধারে বন্ধু একলা কইরা দিয়া …

প্রেমের বাঁশ কাটিয়া বন্ধু রে
বন্ধু দিয়া গেলায় বেড়া
সেই বেড়ারই বেড়াজালে
কান্দে আমার হিয়া বন্ধু রে

বন্ধু অউত্ত যাইরায় গিয়া …

… …

অসীম চক্রবর্তী

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you