বর্ষীয়ান কবি ও বাংলা সাবান

বর্ষীয়ান কবি ও বাংলা সাবান

 

কথাটা ঠাকুরের কবিতা নিয়ে। একটা বয়সে তো তাঁর ছড়া-পদ্য পড়েছি সুর করে, ‘তালগাছ একপায়ে দাঁড়িয়ে’ ইত্যাদি, কিংবা ‘বীরপুরুষ’ বা ‘হিংটিংছট’ বা বাবু ও উপেনের মধ্যকার ঘটনাবহুল সেই ‘দুই বিঘা জমি’। কিন্তু অচিরে আমাদের পথ যায় বেঁকে, একে একে অনেক কবি আসেন জীবনে আমাদের, এবং অবধারিতভাবে জীবন ও জীবনোত্তর কবিদের সনে শনৈ শনৈ আশনাই বাড়তে থাকে আমাদের। বহুদিন ঠাকুরবিহীন দিন কাটে আমাদের, ভালোই কাটে, এবং নিজেরাও একটুআধটু শুরু করে দিয়েছি লিখতে ততদিনে। সেই লেখার কারণেই হোক আর ঠাকুরকাব্যের ডিকশনের কারণেই হোক, অচিরেই রোম্যান্তিক কবিতার মধুবন থেকে ঘটে আমাদের প্রস্থান। অবাক ব্যাপার টের পাই অনেক পরে এসে, এই বয়সে, আসলে রবীন্দ্রকবিতা থেকে প্রকৃতপ্রস্তাবে প্রস্থান কখনোই ঘটেনি পুরোপুরি। রিসেন্টলি তো কিয়দ্দুর এগিয়ে যেয়ে এমনও মনে হয় যে, রবীন্দ্রকবিতায় রীতিমতো প্রত্যাবর্তন ঘটতে চলেছে নতুন করে আবারও আমার। এবং আগের চেয়ে ঢের বেঁকেচুরে, সঙ্গত কারণেই, বয়স ইত্যাদি কারণে এখন তো ব্যক্তি আমিও ঠিক আগের ন্যায় সিরাতুল মুস্তাকিম নাই আর। তাঁর অন্তত গোটা-চল্লিশেক কবিতা আমার সবসময় লেগে এসেছে ভালো, সমানভাবে এখনও ভালো লাগে, একটা তালিকাই দিয়ে দিতে পারি। কিন্তু তা না করে বরং কয়েকটা নাম প্রকাশ করি। যেমন ‘তাজমহল’ কবিতাটা, বা ‘সোনার তরী’, কিংবা ‘বলাকা’, বা ‘পৃথিবী’, কিংবা ‘আমরা দুজন একটি গাঁয়েই থাকি’ ইত্যাদি লিরিকগুলো, অথবা ‘আমি ভালোবাসি যারে, সে কি কভু আমা হতে দূরে যেতে পারে’ লাইনওয়ালা কবিতাটা, বা কাহিনিকবিতাগুলোর বেশ-কয়েকটা, বা ‘যেতে নাহি দিব তবু যেতে দিতে হয়’ পঙক্তিসম্বলিত দীর্ঘকবিতাটা আমার সবসময় সঙ্গে থেকেছে। এখন যুক্ত হয়েছে আরও বেশকিছু, যুক্ত হয়ে চলেছে বছর-বছর, উহারে এই জানা আমার ফুরাবে কি না আই ডাউট। তবে যে-ব্যাপারটা সহসা আবিষ্কার করে আমি বিস্ময়ে ভরে উঠেছি একদিন, সেইটা এ-ই যে, আমরা আমাদের জান্তে-অজান্তে আমাদের লেখায়-কথায় বিবাদে-ঝগড়ায় এমন অজস্র এক্সপ্রেশন এস্তেমাল করি যেগুলো সরাসরি রবীন্দ্রকবিতা থেকে উৎসারিত। প্রমাণ প্রচুর রয়েছে আপনার হাতে এমনকি আমারও হাতে, এবং কথার কথা নয় এই কথাটা, আমি হয়তো কোনো-একদিন এই নিয়া রিয়্যালি সামথিং ওয়্যর্থ-রিডিং লিখে উঠতে পারব। সেই লক্ষ্যে এগোচ্ছিও রোজ গুটিগুটি পায়ে, একটুএকটু করে, এই চিলতে নিবন্ধটাও হয়তো তখন কাজে লাগাতে পারব। মজার একটা কথা জানাই আপাতত। আমার এক বর্ষীয়ান সহকর্মী ঠাট্টাচ্ছলে ঠাকুরের কবিতাবলিকে বলেন বাংলাসাবান। কেন বলেন, সেই ব্যাখ্যা চাইলে তিনি দিতে পারেন না কোনোদিনই, তিনি আমতা আমতা করেন এবং এইটা তার ক্যারেক্ট্যারিস্টিক্স বলতে পারেন, বড় বড় বাতকর্মে পটু তিনি কিন্তু ধরলেই লবডঙ্কা। কিন্তু কথাটায় আমি খুব উপকৃত হয়েছি, বিশেষ একটা মানে বের করে নিয়েছি কথাটার যা কিনা ঠাকুরকে চেনাজানাজানিতে হেল্পফ্যুল। প্রতিদিনের মনের ও মননের ময়লা কাটাতে এই সাবান সহায়ক। আমি এমনও দেখেছি যে, একটা-কোনো কথা ড্যাম নিশ্চিত হয়ে লিখে দেখি ওইটা আমারই বস্তির খিস্তিব্যস্ত মুরুব্বির বিশেষ উদাসীন মুহূর্তের দার্শনিক দীর্ঘশ্বাস হিশেবে জানলেও অনেক আগেই তা ঠাকুরকাব্যে ঠাঁই নিয়ে নিয়েছে! এইটা একটা কারণ, হতে পারে, ঠাকুরকবিতা যুগ-অনুপযোগী হয়ে পড়ার। আমি বলতে চাইছি, রোজকার রুটিনকাজে ঠাকুর ব্যবহৃত হন বলেই তাঁকে আমাদের (ইনক্লুডিং মি, মোস্ট অফ দ্য টাইম, স্বীকার করতে কুণ্ঠা থাকবে কেন) অত আকর্ষণীয় মনে হয় না। ভাবুন একবার, রবীন্দ্রনাথ অভিব্যক্তি দিয়ে গেছেন এত এত প্রযুক্তিস্ফীত আমাদেরও আবেগের, এবং করেছেন কাজটা মূলত তাঁর কবিতায়! একটা নির্দিষ্ট সময়-অধ্যায় পেরিয়ে গেলে, আমার মনে হয়, একজন কবি ঠিক তার জীবদ্দশার সমকালের ন্যায় অ্যাট্রাক্টিভ থাকবেন আশা করাটা আতিরেক্য বৈ কিছু নয়। কিন্তু বক্তব্যানুবর্তী বিস্ময় আমার এখানেই শেষ নয়, শেষ কিংবা আপাত সমাপ্তি টানার জন্য বলি এখন, চেষ্টা চালাই নিবন্ধ ছোট রাখতে। একজনের কথা স্মরণ করুন, তিনি হুমায়ুন আজাদ। আমি আর আপনি তো একই সময়ে বেড়ে উঠেছি, একই বিজলি-ঝড়-বজ্র ও জোছনায়, সেই সময়েই লেখক হিশেবে হুমায়ুন আজাদ সাড়া জাগিয়ে উঠছেন ক্রমে। এবং আমরা ছিলামও সেই বিরলজন্ম স্পষ্টবাক ড. আজাদের প্রতিটি পৃষ্ঠার ঘোরতর প্রেমিক পাঠক। হুমায়ুন আজাদ যখন সোৎসাহ উল্লাসে রবীন্দ্রনাথমূর্তি, যেমন নজরুল এবং অন্য অনেক, সংহার করে চলেছেন পরশুরামের কুঠার হস্তে লয়ে, সেই সময়টায় শিখেছিও অনেককিছু। অভ্যস্ত বীক্ষণ নাড়া খেয়েছে দেখে দুঃখও পেয়েছি নিশ্চয়। কিন্তু কথা আজাদকে নিয়ে নয়, ঠাকুরকে নিয়ে, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রধান কবিতা’ নামাঙ্কিত একটা ব্যাপক কলেবরের বই সম্পাদনা করেছিলেন আজাদ তাঁর পঞ্চাশোত্তর বয়সে, এবং সেই বই কবিতার, এবং লিখেছিলেন একটা মর্মদ্রাবী দীর্ঘ ভূমিকা, যেখানে তিনি তাঁর আজীবনের রবীন্দ্র-খারিজকরণ প্রকল্পনার ব্যাপার উল্লেখ করে বলছেন যে, পঞ্চাশপূর্ণকালে যেন নয়াভাবে ঠাকুর ধরা দিচ্ছেন তাঁর কাছে! সেই ভূমিকা পাঠোত্তর সঙ্গে সঙ্গে একটা ভয় গ্রাস করেছিল আমার ভিতরটারে এই মর্মে যে, তাহলে কি আমারও এই দশা হবে একদিন! বলতে খারাপ লাগছে, সেই দশা দেখতে পাচ্ছি শুরু হয়ে গিয়েছে আমার বেলায় একটু আগেভাগেই। কিন্তু আমি এর কারণ খুঁজছি, রোজ, নোটও নিচ্ছি সাঁটলিপির ধাঁচে। একটা কথা আজকাল মনে হয় যে, আমাদের প্রত্যেকেরই একটা করে ‘প্রিয় রবীন্দ্রকবিতা’ নামধারী সংকলন থাকা দরকার। মৃত্যুর কয়েক বছর আগে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একটা সম্পাদনা করেছিলেন দে’জ পাবলিশিং  কর্তৃক প্রকাশিত শ্রেষ্ঠ কবিতা  গ্রন্থমালার আন্ডারে, এন্তার আগড়মবাগড়ম গৌণ কবিতা নিয়ে ভরিয়ে ফেলেছেন বলে মনে হয়েছে আমার কাছে, এবং সেজন্য প্রচুর গালিগালাজও করেছি গাঙ্গুলিকে, মনে মনে, সেখানে প্রায় একশ আটটা কবিতা আঁটানো হয়েছে এবং বেশিরভাগই বিরক্তিকর। একটা ম্যাড়মেড়ে ভূমিকায় কিছুই ক্লিয়ার বলতে পারেন নাই কবিতাগুলো চয়ন করার পেছনে কেমনতর মনস্তত্ত্ব কাজ করেছে বা তুলাডাণ্ডা কি ইত্যাদি বিষয়ে। সেই থেকেই ভেবে আসছিলাম আমার প্রিয় রবীন্দ্রকবিতা একজায়গায় জড়ো করে দেখবার ও বন্ধুদেরকে দেখাবার একটা প্রয়াস নিতে পারলে মন্দ হতো না, তাতে আমার মনোজগতের একটা খোঁজ হয়তো সহজেই পেত সবাই। মন্দ হয় না কিন্তু, ভেবে দেখুন, এবং অনলাইন মাধ্যমে এই জিনিশটা দারুণভাবেই সম্ভব। যা-হোক, পল্লবিত নটেগাছের কথা ছেঁটে ফেলি এখন আপাতত। রবীন্দ্রনাথের গান নিশ্চয় ভালো লাগে আপনার, অন্তত কয়েকটা তো খুব কাজে লাগে আমার মাঝে মাঝে, তেমন একটা এই-মুহূর্তে প্রাসঙ্গিক (পার্পাস সার্ভ করে, এ-রকম হতাশার মুহূর্তগুলোতে স্পেশ্যালি, কিন্তু কোটেশনভুক্ত গানটি যে খুব প্রিয় আমার তা কিন্তু নয়। এরচেয়ে বরং তাঁর অন্য অসংখ্য গান প্রিয় আমার, একটি-দুইটি নয়, একসঙ্গে অনেকটি) : ‘নিশিদিন ভাবনা রাখিস, ওরে মন হবেই হবে’… ইত্যাদি। কিংবা, আরও কত রকমেই তো সংকলিত হতে পারে একজন কবির কাজ; শিশুদের রবীন্দ্রনাথ, কিশোরদের রবীন্দ্রনাথ যদি ভিন্ন ভিন্ন সংকলনে অ্যাভেইল্যাবল থাকে তাইলে তরুণদের রবীন্দ্রনাথ, প্রৌঢ়দের রবীন্দ্রনাথ, তেমনি নজরুল, জীবনানন্দ, রাহমান, মাহমুদ সংকলিত করা যায়। বিবাহিতের রবীন্দ্রনাথ, আর অবিবাহিতের রবীন্দ্রনাথ — এক ও অভিন্ন কি না, এই ব্যাপারটা নিয়া বাংলার রবিডিস্ট্রিবিউটররা ভাবেন নাই মনে হয়। ইন্টারেস্টিং হয় কিন্তু, ভাবলে। আমি দুইদিকের একদিক কাভার করতে পারি, অন্যদিকটা আপনি করার চিন্তা করে দেখতে পারেন। তবে যে-অবস্থা দেখতে পাচ্ছি, ভাবগতিক সুবিধের ঠেকছে না, আটকে গেছি মনে হয়। দেখা যাক, অচলাবস্থা চিরস্থায়ী হয়নাকো দুনিয়ায়, এ-ই আশা মাত্র। তবে দেরি নেই ধারণা হয়, এইবার সময় সন্নিকট ‘পুষ্প বৃক্ষ ও বিহঙ্গ পুরাণ’-এর সিক্যুয়েলটা লিখে ফেলতে হবে, এবং খোদা-না-খাস্তা আমাকেই! মন্দ হয় না, পারলে, আগেরটা লিখেছিলেন মহাত্মা আহমদ ছফা এবং এইটা আমার প্রিয়দের মধ্যে অগ্রগণ্য। তো, ভয় নেই, আমরা তো সমুদ্রাভিযাত্রী, ডুবি কি ভাসি, সমুদ্রেই তো আছি, চিন্তা কী…পিপাসাই সত্য, চিরজাগরূক, অন্য সব মামুলি।… 

জাহেদ আহমদ ২০১৩


এই সিরিজের অন্যান্য রচনা

Support us with a click. Your click helps our cause. Thank you!

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you