রথরেইন

রথরেইন

রথের রেইন শুরু হয়েছে, সেই নিদ্রাশান্ত সকালবেলা থেকে, একটা আস্ত দিন কাবার হয়ে গেল তবু রথবৃষ্টির হিয়া বিরাম পায়নিকো। ওগো ঝরঝরজাগানিয়া, মায়াবী বেহায়া, গানও শোনা যাচ্ছে না তোমার বকবকানির তোড়ে। যেই ইউটিউবে একটা গানের পয়লা চরণ গেয়ে একটু প্রোসিড হতে লেগেছে ধুনটুকু, অথবা গানের ইন্টার্লিয়্যুড যুৎসই সম্ খুঁজে ফিরছে একটু অলস ঔদাস্যে, অমনি তোমার বাগড়া। আওয়াজের চোটে ইউটিউব ওঠে চাঙ্গে। এমনকি নিজের কণ্ঠটাও পৌঁছাতে বেগ পায় নিজেরই কানে, এতই তোমার আওয়াজের লীলা-কি-জাওয়ানি! কী আর করার আছে, এদেশ তোমার কাবিনের স্বত্ব, এইখানে তোমার দজ্জাল গলার আওয়াজে বিরক্ত হতে পারি, মিনমিনিয়ে আক্রোশ প্রকাশিতে পারি, কিন্তু তোমারে ছেড়ে যাবার উপায় তো নাই। কিন্তু উপায় থাকলে, মিয়্যুচুয়্যল্ সেপারেশন্ বা লিগ্যাল্ বিচ্ছেদের মওকা/অ্যাফোর্ডেবিলিটি থাকলে, ছেড়ে যেতে? — ইফ স্যেনোরিতা রেইন আস্কড য়্যু প্রেসাইস্লি, কী দিতে উত্তর তার? দ্যাট’স্ অ্যা কোয়েশ্চন্, অফ কোর্স।

অকহতব্য গুমট দাবদাহ দুনিয়ায়, দিনভর, রাত্তিরের দিকে পূর্ববিজ্ঞপ্তিবিহীন বৃষ্টি শুরু হলে খেয়ালের বশে বাসি খবরের পত্রিকা হাতে নিয়া মাস্টহেডের তলায় চিকন হরফের লেখাগুলো বিছড়াই। গিরস্তের ঘরে এই কিছুদিন আগেও পঞ্জিকা রাখা হতো, লোকনাথী পঞ্জিকা বা মোহাম্মদী পঞ্জিকা, মডার্ন হবার পরে গেরস্তের পঞ্জিকা রাখার দরকার চুকেবুকে গেছে। এখন এমনকি বিয়াশাদিতেও দৈনিক পত্রিকার মাস্টহেডের তলায় চিকন হরফের তারিখ দেখে ঠারেঠোরে দিন ধার্য হয়ে যায়। এখন গ্রহনক্ষত্রের ভাবগতিক বিবেচনায় রেখে মঙ্গলামঙ্গলচিন্তা বাপঠাকুরদারাও করে না। শাদি করবা তো করো, প্লট বরাদ্দ নাও কড়ি ফেলে বা ফ্ল্যাট খরিদ করো লোনের কিস্তিতে, দশটা-পাঁচটা তো নয় স্রেফ একসিঙ্গেল বাচ্চাই তো পয়দাবার মুরদ অবশিষ্ট, খুব ডেয়ারিং হলে ছেলে হোক মেয়ে হোক দুইটার স্লোগ্যানেই আটকা, তাইলে এত মঙ্গল-অমঙ্গল ভাবনায় আর পঞ্জিকায় বা দোয়াদুরুদেরই-বা দরকার কি? হিন্দু/সনাতনী বিবাহাদিতে এখনও লগ্ন-তিথি ইত্যাদি ঠিক করার গরজে পঞ্জিকাটা দেখতে হয় বোধহয়। ফ্যামিলি-অ্যারেইঞ্জড বিয়াশাদি যেভাবে ক্রমহ্রাসমান, দুনিয়াজোড়া অ্যাফেয়ারের শাদিই জিন্দাবাদ, পঞ্জিকা আর বোধহয় সনাতনী বিয়াতেও দরকার পড়বে না কিছুদিন বাদে। অ্যানিওয়ে। ঢেউটিনে রেইনপাতের সাউন্ডে এফেক্টেড হয়ে দেখতে যাই নিউজপেপার টেনে আজকে বাংলা মাসের কত তারিখ। দেখি যে, এইটা তো রথের মাস! খবরেই ছিলাম না, আজকের এই বৃষ্টি তো রথেরই আগমনী সিম্ফোনি!

ইট’স্ অন্তিম আষাঢ় টুডে। রথ শুরু হয়েছে মাত্রই, বৃষ্টি তো বাংলার বারোমাসি, কিন্তু রথের রেইনের কোয়ালিটি ডিস্টিঙক্ট। বঙ্গে বেবাক বৃষ্টিরই ফিচার স্বতন্ত্র। ম্যন্সুন রেইন আছে, উইন্টার রেইনও, তেমনি রথরেইন। শুরু হয়েছে এই সিজনে মাত্রই, ফিরাযাত্রা তো শুরুর দিন-দশেক পরে অ্যাট-লিস্ট। উল্টোরথ বলা হয় ফিরাযাত্রাটাকে। জনশ্রুতিই শুধু নয়, — একটু অভিজ্ঞতা আছে যাদের এই বৃষ্টির কাবিনস্বত্বের দেশে গৃহস্বামী হিশেবে সংসারযাপনের, তারা নিশ্চয় জানবেন যে রথ-ডিউরিং রেইন হবেই হবে। অ্যাট দি বিগিনিং কোনো কারণে রেইনট্রেন প্ল্যাটফর্মে এসে লাগতে লাগতে ডিলে হলে ফেরারথে তো কথা নাই বৃষ্টি হবেই। ঠিক একইভাবে বৃষ্টি হতে দেখা যায় বিসর্জনের দিনে, দেখা যায় দুই ঈদের দিনে, একেবারে মেরেকেটে কুর্বানির দিনে তো হবেই হবে রেইন এবং ব্যাপারটা প্রায় এভিডেনশিয়্যাল্ প্রুফ বলা যায়। ইন্ডাক্টিভ লজিক্ না?

তা, আবহমান পরিস্থিতি হচ্ছে এ-ই যে এই বৃষ্টি নিয়া, পাইকারি বৃষ্টি নিয়া, বাংলার গৃহস্বামীদিগের আদিখ্যেতার অন্ত নাই। দিস্তার পর দিস্তা বাংলা কাব্য পয়দানো হয় একেকটি বৃষ্টিডিম্বাশয় নিষেক প্রক্রিয়ায়। কাজেই বৃষ্টি জিনিশটা আদৌ অর্থকরী কি না বা কতটুকু অর্থকরী তা বাক্যিক সমীকরণে বলা ডিফিকাল্ট হলেও গোটা ব্যাপারটা আগাগোড়া কাব্যকরী ইহাতে নো সন্দেহ। অতশত কাব্য লইয়া আমরা কি করিব, প্রশ্নটা আমরা করি না, প্রশ্নটা হাসান আজিজ বা বঙ্কিমচাঁদের হলেও হতে পারে। অ্যানিওয়ে। রেইন রে, তুঁ হুঁ মম শ্যামসমান — এই লাইনে এখনও ঘরজামাই/গৃহস্বামীদিগের ক্যাথার্সিস্ হয় নিশ্চয়।

কেন সকালবেলার বৃষ্টিশব্দ শুনেই মনে হয় দেখি তো পত্রিকা টেনে আজ বাংলা কয় তারিখ? রথরেইনের সাইন মানেই কি বৃষ্টিবিড়বিড় পরিস্থিতি? ইন্ ফ্যাক্ট একটা কারণ হচ্ছে এই সিজলেস্লি বৃষ্টিপাত, বলা বাহুল্য। সড়কের দুইধারে যেসব দৃশ্যোদয় হয় যেতে-আসতে আপিশে বা ইশকুলে-কালেজে বা রোজগারখানায়, সেই দৃশ্যধারা খানিকটা ভ্রমে ফেলে বৈকি যে এইটা বোধ’য় রথযাত্রামাস। তবে সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে এই ইল্যুশন্ যে একভিড় বৃষ্টির ভিতর দিয়ে ঠেলেঠুলে ট্যাক্সি কিংবা বাইকে চেপে আপনি যখন চলেছেন রোজগারের রণে, এবং যখন ফিরছেন, যেন মনে হয় রথের গাড়ি ঠেলতে ঠেলতে যাত্রা এবং রথারূঢ় হয়ে ফেরা। আওয়াজটাও, বলা বাহুল্য, রথরশ্মি টানার সময়কার ভিড়ভাট্টারই মতো। অলমোস্ট।

ওগো আজ তোরা বাইর হ ঘরের থেকে, মেঘবাদলি নিয়া মাথায় রিকশায় সওয়ার হ! সম্ভব হলে দুইচাক্কার বাইকে বা পয়দলে বাহিরিলে বেজায় ভালো। রথযাত্রায় বেরিয়েছেন দ্যাখো সেলিব্রেটি কৃষ্ণ। জগতের নাথ। জগন্নাথ। বর্তমান মিডিয়াবারফট্টাইয়ের জামানায় কৃষ্ণের চেয়ে সেলেব কে আছে যে এত অজস্র রূপে প্রেজেন্ট করে নিজেরে অনস্ক্রিন-অফস্ক্রিন উভয় লাইফে? প্রেক্ষাগৃহে যেয়ে দেবু জগন্নাথজিকে যে বা যারা কাইফা হালুকা জিগায় না সারাবছরে একটাবারও, জগন্নাথ ওর্ফে কেষ্ট ঠাকুরের সেলিব্রেইটেড ইগো তাতে হার্ট হলেও উনি ভীষণ চাল্লু বলিয়া বাজারে তা চাউর করেন না, বছরে একদিন উনি নিজেই স্ট্রিটহিরোর রোলে সেজেগুজে বের হন ফ্যানবেইস্ আপ্ডেটের মকসদ মাথায় নিয়া। খালি শ্রীহট্ট শহরগেরামের গল্লি ঘূর্ণন দিয়াই ফিরবেন ফের প্যালেসে, এমনটা ভাবার কারণ নাই। পৃথ্বীধামের পুরী থেকে প্যারি নগরীর লেইন-বাইলেইন ঘুরে বিএমডাব্লিউয়ের বাড়া কাঠের চাক্কার শকটে চেপে প্যালেসে প্রত্যাবর্তন করতে করতে দিন-দশেক তো লাগেই। ইয়ারদোস্ত, ভগ্নিভ্রাতা, লটবহর কোম্প্যানিও কম থাকে না যাত্রায়, কাজেই স্ট্রিটশো সফলকামই হয়। মেলায় ভালোই মিলমুহব্বত মোচ্ছব লাগিয়া যায়। পাব্লিকেও ফুর্তিফার্তা করে সপরিবার। মন্দ হয় না।

আর এরই মধ্যে রেইনি হুজ্জোতি। কৃষ্ণের তাতে সুবিধাই হয়। আর রাধা? রাস্তায় রাস্তায় রেইনি সিনারিয়ো, দোকানবারান্দায় বৃষ্টিবন্ধের জন্য অপেক্ষমাণ শত শত রাধা, উদাস চোখে রেইনজবজবে শরীরে বেশুমার কৃষ্ণের অনিচ্ছ চলে-যাওয়া পাশ দিয়া, খানিক দূরে রিকাবিবাজারে মেলা বসেছে রথের, নাকফুল কিনে যার যার নির্বাচিতা রাধার লাগি জিকির করছে এ-যুগের শোভন কৃষ্ণেরা। ভালোবাসাতেই কৃষ্ণের সত্যিকারের সেলিব্রেশন হয়। “ভালোবাসা শত যুদ্ধেও জেতা যায় না / ভালোবাসা লুটতরাজকীর্তিনাশা / একা মেয়েটার নরম গালের পাশে / প্রহরীর মতো রাত জাগে ভালোবাসা” … কাজেই, কৃষ্ণের এই স্ট্রিটশো সফল হোক, শোভন হোক, দুনিয়া থাকুক মায়ায় ভরে, মিলমুহব্বতে, পূজা আর পারিজাতে … এ-যুগের কেষ্টঠাকুরটির যেন ষোলোশত গোপবালায় লিপ্সা না যায় … রাধে, রাধে … রেইনি গ্রিটিংস্!

লেখা : জাহেদ আহমদ

… … 

জাহেদ আহমদ
Latest posts by জাহেদ আহমদ (see all)

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you