সুখ-দুখ, চাওয়া-পাওয়া, আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্না, হার-জিত — প্রতিটি মানুষের জীবনের একেকটি অংশ মাত্র। বলা হয় পৃথিবীতে কোনোকিছুই স্থায়ী নয়, যেমন স্থায়ী নয় মানুষ তেমনি স্থায়ী নয় মানবসমাজের কোনোকিছুই। নির্দিষ্ট সময় বলেও নেই কিছুর অস্তিত্ব, নেই কোনো সম্ভাবনা। আজ যা পেয়েছি আনন্দমাধ্যম, কাল তা হারিয়ে কষ্টে পরিণত হতে পারে এবং এটাই জীবন, এটাই জীবনচক্র।
ব্রুনো ব্যারেটোর ‘রিচিং ফর দ্য ম্যুন’ চলচ্চিত্রটি বাস্তবজীবনের এই চাওয়া-পাওয়া এবং এই হারিয়ে-যাওয়ার অনুভূতি প্রকাশ করবে দর্শকের হৃদয়ে।
পরিচালক এখানে একটু বিকল্প পথেই হেঁটেছেন, চিন্তাও করেছেন অনেকটাই বিকল্প, চলচ্চিত্রে অভিনয়কারী তিনজন নারীচরিত্র বেছে নেয়ার মধ্য দিয়ে হাজির হয় পরিচালকের বিকল্প সন্দর্ভ। দর্শককে সবসময় ভালোবাসার মানুষ হারিয়ে যাবার চিন্তা থেকে মুক্ত রাখবার জন্যে এই চলচ্চিত্র।
স্টোরিলাইন ফলো করে গেলে দেখা যায়, আমেরিকান কবি এলিজাবেথ বিশপের একটি কবিতা যেটিকে কেন্দ্র করেই মূল কাহিনি বর্ণনা করেছেন চলচ্চিত্রকার। করেছেন এমনভাবে যেন দর্শক বাস্তব চিত্রটিই উদ্ঘাটন করতে পারেন, উপলব্ধি করতে পারেন হারিয়ে যাওয়ার প্রকৃত মানে। কবি বিশপ খুব দ্রুত হারানোর শিক্ষা নিতে বলেছেন, সেটা হতে পারে যে-কোনো কিছু, হতে পারে যেমন —মানুষ, বস্তু, জায়গা, নাম, অতি আনন্দময় ভ্রমণ, ভালো/খারাপ সময় ইত্যাদি। বিশপ বলছেন, ম্যুভিতে এলিজাবেথ বিশপের জবানিতেই আমরা কাহিনির অধিকাংশ ঘটনা জানতে পারি, কিংবা আদতে ঘটনার কোনো ঘনঘটা না দেখিয়ে এইখানে ঘটনা আড়ালে রেখে এর উপলব্ধ দ্যোতনা আত্মজৈবনিক কণ্ঠে জেনে এগোতে থাকি সিনেমাদর্শক আমরা, বিশপ বলতে চাইছেন যে হারাতে থাকুন প্রতিনিয়ত, হারানোগুলো একসময় দুর্যোগ মনে হলেও আপনি সেই শিল্প আয়ত্ত করা শিখে ফেলবেন। হারাতে হারাতে এই জীবনভ্রমণের শেষাবধি গিয়ে ঠেকবার গল্প, অন্তহীন এই জীবনভ্রমণ আদতেই নিখোঁজ নন্দনের অনবদ্য শিল্প একটা।
হারাতে হবে প্রতিদিন, প্রতি ঘণ্টা, প্রতি মুহূর্ত, কিছু একটা হারাতে হবে, হারিয়ে যাবে, এবং হারতে হবে, কেবল জয় নয়, জীবনে জয়লাভ একটি ইল্যুশন ছাড়া আর কিছুই না, হার মেনে নেওয়া শিখতে হয়, হার মানাতেও একটা আনন্দ আছে। আনন্দ যেমন আমরা উপভোগ করি, বেদনার বেলায় তা হয়ে যায় শুধু ভোগ করা; আশ্চর্য! দুটি শব্দ — উপভোগ করা আর ভোগ করা — এখানে অনেকটা গুলিয়ে যায়, প্রকৃতপক্ষে যার অর্থ একই, যেগুলো মেনে নেয়া মানুষের দায়। এই ভোগ তো আমার চাওয়ায় ছিল না, তবে কেন! ভোগান্তি কেন এত! আনন্দ উপভোগটা যেমন চাওয়ায় আসে না আবার স্থায়ীও নয়, যেমন বলা হয় কোনোকিছুই স্থায়ী নয় মানবজীবনে, এখানেও ঠিক এমনটাই। এই ভোগটাও চিরস্থায়ী নয়, শেষ আছে কোনো-একসময় যেমন রয়েছে তার শুরু।
এলিজাবেথ বিশপের কবিতাটি, যেটি নির্ধারণ করেছে এই সিনেমার কেন্দ্রভাগ, ‘Art of losing isn’t hard to master’ পঙক্তিটি নির্ণায়কের ভূমিকায় সিনেমাটিকে গতিঋদ্ধ করে তুলেছে।
এলিজাবেথ বিশপের জীবন ও সাহিত্য সম্পর্কে যারা আগে থেকেই জানেন তাদেরকে তো বলতে হবে না, যারা জানেন না তারা খানিকক্ষণ গ্যুগল করে নিতে পারেন সিনেমাটি দেখতে বসবার আগে, এই সিনেমায় বিশপের কবিজীবনের দ্বিধা, হ্যালুসিনেশন, কাব্যিক উপলব্ধির রাস্তায় বিচিত্র ক্ষতবিক্ষত পরিস্থিতি, নিজের যৌনচর্যার টানাপড়েন, সেকশুয়্যাল আইডেন্টিটির দুর্ভোগ প্রভৃতি সিনেমায় এসেছে ফ্যাটিশ কোনো দৃশ্য অবতারণা না করেই। নারী-সমকাম এই সিনেমায় এত সুন্দর ও মানবিকভাবে দৃশ্যায়িত হয়েছে যে তারিফ না করে পারা যায় না।
আর সমস্তকিছু দেখে সেরে একটা ব্যাপারে একমত সর্বশ্রেণির দর্শকেরাই হবেন যে এই সিনেমার সম্পদ হচ্ছে এর দৃশ্যকলা। প্রাকৃতিক নিসর্গের পাশাপাশি আধুনিক নগরনিসর্গের ইমারত ও স্থাপত্য এত নান্দনিকভাবে দেখা যায় সচরাচর অতি অল্প সিনেমাতেই।
সিনেমা দেখে একটা গানের কয়েকটা লাইন বাংলাভাষী সিনেদর্শকদের ভিতরে গুঞ্জরন তুলবে, একটা লালনগান, ‘চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে / আমরা ভেবে করব কী’ …
… …
- পিকি ব্লাইন্ডার্স || ফাইয়াজ বিন নুর - June 30, 2020
- ঋতুবৈচিত্র্য ও জৈবনিক চাকা || ফাইয়াজ বিন নুর - June 22, 2020
- মাইন্ডহান্টার || ফাইয়াজ বিন নুর - June 15, 2020
COMMENTS