১৫, ১৬, ১৭, ১৮ … || আনম্য ফারহান

১৫, ১৬, ১৭, ১৮ … || আনম্য ফারহান

আঠারো জুলাই যে-লেখাগুলা (ড্যাশবোর্ডে তেমন অন্তত তিনটা সাজানোগোছানো আছে, সেখান থেকে এইটা একটা) আমরা গানপারে আপ্লোডের জন্যে রেডি করে রেখেছিলাম, হননোন্মত্ত হাসিনাতাণ্ডবে সেসব আর ছাপানো সম্ভব হয় নাই। কেন হয় নাই, তার বিবরণব্যাখ্যা আর দরকার হবে না। আদতে সতেরো জুলাই থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় বাংলাদেশ গোটা দুনিয়া থেকে। ইন্টার্নেট, যত ধরনের সোশ্যাল মিডিয়া, মানুষে-মানুষে এক্সপ্রেশন লেনদেনের ফোনসংযোগব্যবস্থা শাটডাউন করে দিয়ে হাসিনা শুরু করেন হত্যা আর হত্যা আর হত্যা। মিথ্যা আর মিথ্যা আর মিথ্যা। কারফিউ। কারফিউয়ের পর কারফিউ। গভমেন্ট হলিডে একের পর এক। হত্যা হাজার ছাড়ায় রাতারাতি। ইন্টার্নেট পুরাপুরি ফিরে পেতে পাঁচ অগাস্ট বিকাল গড়ায়, হাসিনা দেশের জাতীয় মর্যাদাবাহী বিল্ডিং-ভবনগুলি বিশেষত সংসদ ও গণভবন অরক্ষিত রেখে সেনাপাহারায় পালিয়ে যান। দিগ্বিদিক পালাতে থাকে ষোলো বছরের আইন-ও-বিচারবহির্ভূত হত্যাযজ্ঞের হোতা হাসিনার পোষা আইনশৃঙ্খলা-রক্ষাকারী বাহিনী ও আওয়ামী লীগের গুণ্ডাপাণ্ডারা। রাজনৈতিকভাবে অবদমিত জনতা ফাঁকা প্রবেশতোরণ পেয়ে ঢুকে যায় গণভবনে, সংসদে, ব্যাপক লুটের শিকার হয় ন্যাশনাল আইকনিক স্থাপনাসমূহ। গভীর সংকটে নিপতিত দেশ ও মানুষ। ষোলো বছর ধরে তৈরি হওয়া বিচারহীনতার সংস্কৃতি গেঁড়ে বসা সর্বত্র। অরক্ষিত অরাজক গোটা বাংলাদেশ আজ। দরকার রাষ্ট্রের খোলনলচের সংস্কার।

যা-হোক। অতি সংক্ষিপ্তভাবে বলা হলেও উপরোক্ত কথাগুলি ইতিহাসের নিরিখে পাঠের ও প্রতিক্রিয়ার বিশদ পরিসর সামনের দিনগুলায় আমরা আরও করে নিতে পারব নিশ্চয়। আপাতত পুরানা লেখাগুলা আপ্লোড করে রাখি। নিচের লেখাটা আমরা পাচ্ছি কবি আনম্য ফারহানের বয়ানে। এই লেখা ডায়রির আদলে এগিয়েছে, যেখানে লেখক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং তার আশপাশের ক্রমশ-স্ফীত-হওয়া ছাত্রজোয়ারের সশব্দ ঢেউটুকু ধরে রেখেছেন; মূলত সোশ্যাল মিডিয়ায় তথা ফেইসবুকে জুলাই-অভ্যুত্থানের উন্মেষকাল থেকে যে-লেখকগোষ্ঠী শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সমর্থন করে আসছিলেন, কথিত ‘মূলধারা’ সাহিত্যিক-কবি-লেখকদের ষোলো বছর ধরে মেনে নেওয়া ও মাখনের ভাগ পাওয়া আওয়ামী স্থিতাবস্থার প্রতি বিশ্বস্ততা বা আর-কোনো অজ্ঞাত মনোবৈকল্য হেতু শ্মশানকব্বরের নীরবতা বিরাজ করছিল তাদিগের ভিতর, অপেক্ষাকৃত তরুণ ‘অপ্রতিষ্ঠিত’ কবি-লেখকদের হন্তারকবিরোধী অবস্থান অটুট ছিল শুরু থেকে। এ-লেখার, এ-ধাঁচের লেখার, বড় বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে এর তাৎক্ষণিকতা; আর, এর জ্যান্ততা, এর লিপ্ততা।

আপাতত বলি যে, যে-লেখা আঠারো জুলাই রিলিজ হবার কথা ছিল তা আজকে এক নতুন গুমট/অচেনা আবহাওয়ায় পাঠ করতে কে/কারা আগ্রহী হবে তা জানি না, সামনে এখন মুহুর্মুহু তৎপরতার বিচিত্র ডঙ্কা ও তদুদ্ভূত শঙ্কা, আমরা চাই বিগত সময়ের যা-কিছু গরিমার তা ছাড়াও ন্যাক্কারজনক প্রতিটি অধ্যায় যেন পুনর্পাঠ করে যেতে পারি এবং পারি লার্নিং ডিসেমিনেইট করতে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, জুলাই সতেরো পর্যন্ত কোটা-(সংস্কার/বিরোধী) আন্দোলন কেন্দ্র করে শাসক আওয়ামী লীগ ও তার দোসরদের নিপীড়ন ও পরিকল্পিত হত্যা মাথায় রেখে এই লেখার জন্যে নির্ধারিত কালো পটভূমিকায় বানানো প্রচ্ছদনকশা বাতিলপূর্বক লাল ব্যানার করতে হলো। মূলত ১৮ জুলাইয়ের পর থেকে গোটা বাংলাদেশ রক্তাক্ত হচ্ছিল রোজ শিক্ষার্থীদের খুন করার ধারাবাহিক ঘৃণ্য প্রক্রিয়ায়। হাসিনা তার গণহত্যাকারী চেহারাটা আর লুকিয়ে রাখতে পারেন নাই, অগত্যা, উপায়ান্তরহীন, জনতার সগর্জন ধাওয়ায় পালিয়ে যেতে বাধ্য হন প্রকাশ্য দিবালোকে সেনাপাহারায়।

এই অভ্যুত্থানকালে যারা শহিদ হয়েছেন তাদের প্রতি শ্রদ্ধা আমরা জাতিগতভাবে যেন অটুট রাখতে পারি। — গানপার / ০৯ অগাস্ট ২০২৪


১৫, ১৬, ১৭, ১৮ … || আনম্য ফারহান


১৫ জুলাই ২০২৪
ছাত্ররাজনীতির তাত্ত্বিক গুরু হওয়ার স্বপ্ন এবং অ্যাক্টিভিটি অনেকেই দেখাইতেছিলেন। কিন্তু সেইটা হওয়ার উপায় তো প্রায় নাই। ক্ল্যাসিক রাষ্ট্র মডেল এখন নতুন ক্ল্যাসিক। মানে কনভেনশনাল ওই রাজনীতির লাইনে সেইটা হবে না। আর বিগতযৌবনা ছাত্ররাজনীতি কেন আবার ফিরবে তার আপন মহিমায়, বলেন তো?

সিরাজুল আলম খান দাদাভাইয়ের নিউক্লিয়াস ফর্মেশনের সেই জিনিসটাই এই বাস্তবতায় বইসা রাজনীতিবিদ এবং বুদ্ধিজীবীদেরও বোঝা উচিত যে তা নিছক দায় এড়ানোর মতো। ফরহাদ মজহার এই সেদিনও বলছিলেন নিউক্লিয়াস ফর্মেশনের কথা।

বরং ছাত্রসমাজ রাষ্ট্রকে যে চ্যালেঞ্জ করতে পারে, এইটার প্রদর্শন সময়ে সময়ে কার্যকর। ক্ষমতা তো সবকিছুরই বেনিফিট নিতে চাইবে। সেইটা বড় ক্ষমতাই হোক আর ছাত্রসমাজের সুইট ছোটো ক্ষমতাই হোক। ক্ষমতাপ্রশ্নে বড় এবং ছোটো উভয়ের ইস্যু কমন। তারা ওইগুলাতে নিবিষ্ট আছেন।

ফ্যাসিবাদবিরোধীতা এই যুগে কাউন্টার-ক্ষমতা প্রদর্শনের পারদর্শিতার হিসাব। আন্তঃদেশীয় আন্দোলনের হাতেও অনেকাংশে তার জোর আর তার হাতে নাই। ভূ-রাজনৈতিকতার জটিল সমীকরণ রইতেছে। বড় দলগুলা ঐতিহাসিকভাবেই এর শিকার। লাভবানরাও ঐতিহাসিকভাবেই লাভবান।

তবে? আরও গোড়ায় যাইতে হবে। পুঁজির বিকাশ তার সর্বোচ্চাবস্থায় যেহেতু ফ্যাসিবাদ ডাইকা নিয়া আসে, আর নতুন রাষ্ট্র নামক কর্পোরেটের দাসদের যেহেতু সম্মানজনক দাসত্বই বরণ করতে হইতেছে, সেহেতু ফ্যাসিবাদকে আমাদের কালচার দ্বারা সমালোচনা করাই নতুন পুঁজির সমালোচনা। কালচারগুলির জাতীয়তাবাদী চরিত্র সংবরণ করা যাবে কীভাবে তা অলরেডি অনেকেই ভাইবা ফেলছেন। আমিও ভাবছি এবং বয়কটের জাতিবাদী হিংস্রতা নিয়া অলরেডি বইলা ফেলছি। এবং, আমি সাংস্কৃতিক এই বিপ্লবের রাস্তায় ইসলামিক স্টেইটের প্রস্তাবনাকে আরেক অদূরদর্শিতা আকারে দেখি। যতই মডেল হিসাবে হাজির থাকুক, যতই তার স্বাদ চাইখা-তো-দেখা-হয়-নাইয়ের মতো সহজ সমাধান মনে হোক, তার অ্যাপ্লিক্যাবিলিটি বেশ জটিল। ক্ষমতাপ্রশ্নে ইসলামিস্টদের মধ্যে যেই অংশ সবচাইতে অ্যাডভান্স, তাদের শত্রু অন্য সকল ইসলামিস্টরা। এরা ইসলামের প্রস্তাব এবং এর রাজনৈতিকতাকে কেবলই ঐশ্বরিক মনে করেন।

আর প্রগতিশীলরা সবসময়ই অপরাপর সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক শক্তির ব্যাপারে নিজেরা ইনসিকিউরড থাকেন। তার কারণ আছে। কিন্তু সমাধানও তো নিশ্চয়ই আছে।

প্রগতিশীল এবং প্রতিক্রিয়াশীল উভয় অংশকে একসাথে যুক্ত করার সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ তথা পুঁজির সমালোচনাটি জমাইয়া তোলার বিবিধ প্রস্তাব বাইর করা লাগবে। কিছু বুদ্ধিজীবী গভীরভাবে করতেছেন সেই কাজ। তার নিবিড় পর্যবেক্ষক আমি। তবে আরও সরাসরি এবং বিবিধ প্রস্তাবনা লাগবে। আমিও এই চিন্তার কাজ হাতে লইছি।
.

১৬ জুলাই ২০২৪
নেটওয়ার্ক বন্ধ কইরা কী এক কলিযুগের সূচনা করছে এরা। একই মেথড। একই ফর্মূলা।

স্বৈরাচাররা লুটপাটের তরফদার, পাহারাদার এবং তহশিলদার। তারা তাদের লোকজনদের বিদেশ পার কইরা দিবে। আর আমাদের রেপ করতে থাকবে। ঘরে ঘরে শিশুদের মারা বাকি আছে আর। ভাতে, চাকরিতে তো মারতেছেই এখন সারাজীবনের জন্য অঙ্গহানি আর প্যারালাইজড হওয়ার দিকেও আগায়ে নিতেছে।

গণতান্ত্রিক আন্দোলনে, অধিকার আদায়ের আন্দোলনে রাষ্ট্রের এবং তার প্রেস ব্রিফিংয়ের দোসরদের এই ছাত্রদের উপর ঘৃণা ও মিলিটারি আচরণ দ্বারা নিপীড়ন করাকে ধিক্কার, ধিক্কার এবং ধিক্কার।

*
সর্বস্তরের জনগণের প্রতি আমাদের ছাত্রসমাজ আহ্বান জানিয়েছে আজকের বিক্ষোভে তাদের সাথে থাকতে। দুপুর তিনটায় অনুষ্ঠিতব্য বিক্ষোভ সমাবেশে সারাদেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যুক্ত হবে। এলাকাভিত্তিক খোঁজ নিন, ছাত্রদের পাশে দাঁড়ান।

শুধু কোটা সংস্কারের আন্দোলনে এই আন্দোলন আর নাই। ন্যাক্কারজনক হামলা এবং রাতভর তান্ডবলীলা চালিয়েছে সরকার। ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে। হলে হলে। এই স্বৈরাচারবিরোধী বিক্ষোভে ছাত্রদের পাশে দাঁড়ান।

*
হোয়াট ইজ রিয়েল, এইটার একটা বায়াসড উত্তর/ন্যারেশন/ইউটিলিটি ক্ষমতা ও রাজনৈতিকতার হাত ধরেই নির্মিত হয়। আর আমরা যারা আমজনতা, বা সবসময়ই ক্রিটিক্যল, আর্টিস্ট, পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল, যেই যেই রোলেই থাকি না কেন, আমাদের সত্যকে শুধুই অন্যদিককার সত্য হিসাবেই দেখা হয় না। আমাদের সত্যকে কাউন্টার করার মাধ্যমেই ওই সত্য গড়ে ওঠে। এইটাই ক্ষমতার সমূহ ভয়। আর এইটাই ক্ষমতার রাজনীতি।

*
কালকে বিকালে আমি ইউনিভার্সিটির দিকে গেছিলাম। তার আগে রাতে পিএম-এর চীনফেরত প্রেস কনফারেন্স দেখছিলাম। তখন থেকেই খারাপ লাগতেছিল। সাংবাদিকদের অনেককেই তো আমরা সবাই-ই জানি। দীর্ঘদিন ধরে জানি। তাদের বল বানানো আর সেই শাহবাগ, গণজাগরণ মঞ্চের দিনের কথা একই স্কেলে যে চড়তেছে, দেখতেছিলাম। ন্যারেটিভ পয়দা হয়েই ছিল শুধু দরকার ছিল একটু ব্রেইন স্টর্মিংয়ের। দেশের সাংবাদিক এবং পিএম মিলে আজকের প্রেক্ষাপটের যৌক্তিকতা ওইখানে সাইরা নিছিলেন।

আমি কাজ থেকে একটু আর্লি বাইর হইতে চেষ্টা করছিলাম। কাজের ওইখানেও কিছু ঝামেলা ছিল। সবমিলায়েই সারাদিন খুব ডাউন ছিলাম। এর মধ্যেই তো খবর সব আসা শুরু হইছিল। আমি বাইর হইয়া টিএসসির উদ্দেশ্যে হাঁটা দিছিলাম। তড়িঘড়ি কইরা আসা সচিবালয়ের গাড়িগুলি দেখতেছিলাম। আমি এখন দেখলেই বুঝি কোনটা সচিবালয় থেকে আসতেছে। ডাবল ডেকার লাল বাসেরও দেখলাম অনেক তাড়া। লোকজন খুব দ্রুত ফিরতেছে। আর দেখলাম আকাশের কী এক অদ্ভুত রং বাইর হইছে আজকে। মাগরিবের তখনও অনেক দেরি। এ-রকম আকাশে নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় কাক দলবেঁধে ঘুরতে থাকে চিলের মতো। বাড়িগুলি, রংগুলি অন্যরকম লাগে। অন্যসময় হইলে ছবি তুলতাম হয়তো কিছু। কিন্তু আজকে মনেই হয় নাই। জাদুঘরের সামনে পাইলাম সরকারি দলের প্রথম জমায়েত। চেয়ারে বইসা আরাম করতেছিলেন তখন। পুলিশ চারপাশ দিয়া ব্যারিকেড দিয়া রাখছে। শাহবাগ থানাও পুলিশে পুলিশে ভর্তি। শাহবাগ পার হওয়ার আগের মোড়েও পুলিশের সাদা সাঁজোয়া যান দেখছিলাম।

এইগুলা পার হইয়া দেখি রাজু ভাস্কর্যের দখল সরকার পক্ষের ক্যাডারদের হাতে। এলাকা খুব গরম। রাস্তায় ইটের টুকরা। হেলমেট হেলমেট হেলমেট। কিশোরগ্যাংয়ের সদস্যদের মতো দেখতে প্রচুর হিটাররা। বেইজ বলের স্টিক হাতে। স্ট্যাম্প হাতে। একটু পর পুলিশ ব্যাকিংয়ে এরা যাবে হল থেকে হলে। ওইদিকে শহীদুল্লাহ হলের এলাকা থেকে খবর আসতেছিল যে অবস্থা খুব খারাপ। ঢাকা মেডিকেলে ঢুইকাও নাকি আধা রক্তাক্ত যারা চিকিৎসা নিতে আসছেন, তাদেরও পেটাচ্ছে। রক্তাক্ত সব ছবিতে সোশ্যাল মিডিয়ার গ্রুপগুলিতে ঢোকা যাচ্ছিল না। প্রথম আলোও কিছু ছবি ছাপাইছে।

বাস ও লেগুনা পার্ক করা দেখছি জায়গায় জায়গায়। জনসভায় যে-রকম লোক আনতে ব্যবহার করা হয় যে, ওইরকম। এই পোলাপাইনগুলা আবার পুরি, চপ, মুরগির হালিম খাইতেছিল দলে দলে ভাগ হইয়া। হাকিম চত্বর ও টিএসসির দিকের ঘেঁষা দোকান দুইটায়। আশ্চর্য লাগছিল টীন কিছু মেয়েদেরকে দেখে। মনে হইল এরা কোনোপক্ষেই নাই। খাইতেছে, চীল করতেছে। হাসাহাসি করতেছে। ‘আমার কাছে একটাকাও নাই’ বইলা বন্ধুদের সাথে উইড়া বেড়াইতেছে। আমি একটু ধাতস্থ হইলাম মনে হয়। এইদিকে অ্যাম্বুলেন্স, স্লোগ্যান আর পুলিশের বাঁশির শব্দে আকাশ আরও টনটন করতে লাগল।

আমি ঘুইরা রোকেয়া হলের সামনে দিয়া ঢাকা মেডিকেলের দিকে আগাইতে ধরলাম। ঢাকা মেডিকেলে প্রচুর রক্ত লাগবে, খবর আসতেছিল। পুলিশ পুলিশ পুলিশ। ব্যারিকেড ব্যারিকেড। ছাত্রলীগ এদের চাইতেও গরম। তার চাইতেও গরম পিচ্চি বাহিনী। স্বাভাবিক কিছু সংসারী চাকরিজীবীদের দেখলাম। অল্প কিছু নারী শিক্ষার্থীদেরকেও। ইনারা কেউ তাড়াহুড়ায় নাই। আমার মতোই এলাকা-ভাব নিয়া ধীরেসুস্থে আছেন মনে হইল।

রিকশাওয়ালারা আছেন সবাই-ই। এই আবহাওয়ার একটা গরম আছে, ওইটা নিম্নবিত্তের অনেককেই দেখছি আমি চার্জ দেয়। পক্ষ-বিপক্ষের বাইরের জিনিস এই চার্জ। বুঝতে পারি।

আমি পিচ্চিবাহিনীর কয়েকজনের সাথে কথা বলার চেষ্টা করছিলাম। আমার চুলটুল বাট আবার কাপড়চোপড় দেইখা কথা বলতে কনভিন্সড হইছে তারা। আমি শুধু জিজ্ঞেস করছি আপনি কোন্ পক্ষ। যাদের সাথেই কথা হইছে আর কি। উত্তর দিছেন, আমরা ভাইগো লগে আছি। ঠিক করতে আইছি সব। আমি বললাম ওই পক্ষ তো ‘ঠিক’ আছিলই। উত্তর পাইছি, না ক্যামনে ঠিক, দেখতেছেন না, আমরা আসছি, সবাই আছে, আমরা ঠিক করা দিয়া যামু।

ঢাকা মেডিকেলের বাইরে পুলিশ আর হেলমেট হেলমেট হেলমেট। জায়েজ কর্তৃপক্ষের জায়েজ করতে আসা পোলাপাইন সবার হাতেই লাঠি। আর আবোলতাবোল সব শব্দ। ভেতরে যাওয়া যাবে না। গরম।

আমি কার্জন হলের ওইদিক ঘুইরা শহীদুল্লাহ হলের দিকে যাব ভাবলাম। কার্জন হলের এলাকা, দোয়েল চত্বর বেশ স্বাভাবিক একটা লোকজন-কমওয়ালা মনে হইল। কিন্তু গ্রুপগুলাতে খবর পাইছিলাম এইদিকে ছাত্রসমাজ সবল অবস্থানে আছে। রাস্তার ব্যারিকেডে পুলিশ, পিচ্চিরা, ছাত্রলীগরা দেখলাম একটু ঠাণ্ডা। শহীদুল্লাহ হলের ওইদিকে যাওয়া যাচ্ছিল না।

আমি আগের রাতের মতোই এই সন্ধ্যায় আরও খারাপলাগা অনুভব করলাম। এত বিপুল বাহিনী বাহিনী বাহিনী। একটু ঢিলেঢালা ভাব অনেকের মধ্যে। অপারেশন অপারেশন গন্ধ কেমন। আর ওই আকাশের রং। রাত্রি যে সমাগত তা বুইঝা ভালো লাগতেছিল না। লাইট নিভায়ে, নেটওয়ার্ক ডেড করে যে-কোনোকিছুই করা সম্ভব এদের পক্ষে। ৫ই মে শাপলা চত্বরের ঘটনা মনে পড়তেছিল। আরও ফালতু লাগতেছিল। তবে, এবারের স্পার্ক ভিন্নরকম। ছাত্রসমাজের ইন্টিগ্রিটিও ভিন্ন। রাজনীতির মাঠও বেশ টেন্ডারনেস সমৃদ্ধ। আশা এবং নিরাশা দুই-ই চোখের সামনে থাকা লক্ষণ হিসাবে ভালো। রাতে কি হবে, কালকে কি হবে, এই অস্বস্তি এবং উদ্বেগের যেই খারাপলাগা তার মাধ্যমে আমাদের পজেটিভিটির সান্নিধ্যই লাভ করা হয়। যেন ভয় আছে মানেই আশা আছে।

*
আমি এইবারের মেইনস্ট্রিম প্রায় সকল মিডিয়ার খবর, ছবি, ফুটেজ ইত্যাদি প্রকাশকে সরকারের চাওয়ার প্রতিফলন হিসেবেই দেখতে চাই। কারণ হয়তো দুই-এক দিনের মধ্যেই এরা বলবে ছাত্রদেরকে ভুল বুঝিয়ে আন্দোলনে নামিয়ে এইরকম ক্ষয়ক্ষতি বরণ করাইয়া নেওয়ানো হইছে।

এই ব্রেইনস্টর্মিংও পিএম-এর চীনফেরত প্রেস কনফারেন্সে জাতিকে সাক্ষি রেখে সাংবাদিকরা কইরা নিছিলেন। ইউটিউবে এইটা আছে। আর আপনারা তো যারা জানেন, তারা জানেনই।

গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে সবসময়ই অবৈধ এবং স্বৈরাচারী সরকার থ্রেট হিসাবে দেইখা আসছে। আর বলে, জনগণের জান-মালের নিরাপত্তা ও রাষ্ট্রের জন্য হুমকি তৈয়ার হইছিল জন্যই উনারা তা ঠিক করতে যান। তো কীভাবে ঠিক করেন? হামলা, এবং দেশের সম্পদ ছাত্রসমাজকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করে? পঙ্গুত্ব বরণ কইরা নিতে দেয়ার ভিতর দিয়ে?

তো, দেশের জান-মালের হেফাজত হইল?
.

১৭ জুলাই ২০২৪
আমরা মৃত্যুর খবর আগেই পাইছিলাম। এখন অফিশিয়ালি মিডিয়া বলতে পারতেছে। তাও ঢাকার বাইরেরটা।

ব্যাস। এটুকু মনে রাখবেন।

আর মনে রাখবেন, সিরিজ মৃত্যুর কোনো সহিংসতা ছাত্রসমাজ চায় নাই। রাষ্ট্রীয় জান-মালের নিরাপত্তা নিশ্চিতের নামে পুলিশ এবং ছাত্রলীগ শুরু করছিল সহিংসতা। টাইমফ্রেমগুলার নিবিড় পর্যবেক্ষক আমরা।

আরও মনে রাখবেন, সরকার প্রধান এই লাইসেন্স দিছেন।

*
আজকে ঢাবির ছাত্রলীগ একটু ঠাণ্ডা এখন। কিশোরগ্যাং টাইপ পোলাপাইন গতকালকের তিন ভাগের এক ভাগ। বাট মূল সিনে নাই। ‘টোকাই’ কেন ক্যাম্পাসে, স্লোগানে কাজ হইছে।

ছাত্রদেরকে হলে হলে ঢুকায়ে বাইর হইতে দেয়া হইতেছে না। মানে কর্নারড করা হইছে। বাট উনারা ওই গেটে থেকেই স্লোগান দিচ্ছেন। ছাত্রলীগ ক্যাম্পাস ভরায়ে ফেলছে শহরের সব পোলাপাইন আইনা। সবার হাতেই লাঠি, বাঁশ, হকিস্টিক, বেজবল স্টিক, স্ট্যাম্প, জিআই পাইপ। আর হেলমেট মাথায়।

তবে শহীদমিনার এলাকা আর ঢাকা মেডিকেল এলাকায় ছাত্ররা রাস্তা ছাড়েন নাই। বুয়েট দুই নাম্বার গেইটের কাছেও ছাত্ররাই আছেন। টিএসসি আর রাজু ভাস্কর্য এবং শাহবাগ ছাত্রলীগের দখলে।

দুই পক্ষই প্রস্তুত। আর এইদিকে রাত আসতেছে। ঢাকার বাইরে এবং ঢাকায়ও ওরা রাত্রে ‘হল তল্লাশি’ এবং হামলা চালাইছে। পুলিশসহ। ঢাবি এবং বুয়েটের ছাত্ররা দেখলাম বেশ কনফিডেন্ট। স্বাভাবিক।

*
চিকিৎসা নিতে থাকা আহত সহপাঠীদের, কমরেডদের উপর কালকের মত যেন আবার ছাত্রলীগ ভিতরে ঢুইকা দ্বিতীয়দফায় হামলা করতে না পারে, সেজন্য ছাত্রসমাজ ঢাকা মেডিকেল অ্যারিয়া সিল করে দিছেন। এছাড়া বাকিরা হলে হলে।

এই জিনিস দেখলে আপনি আস্থা এবং বিশ্বাসের প্রতি অটল থাকা কি জিনিস সেইটা বুঝতে পারবেন।

*
বুয়েট আর ঢাকা মেডিকেল এলাকায় ০৭:৪০-এর পর থেকে ইন্টারনেট পাই নাই। পলাশীর দিকে আসতে আসতে পলাশী মোড় পার হওয়ার পরে জিপির নেটওয়ার্ক পাওয়া গেছে।

যেই কয়জনের সাথে কথা হইছে, ভিতরের, উনারা আতঙ্কে আছেন বললেন। কেউ কেউ ভয় যে পাচ্ছেন না, এমন না। বললেন।

*
খানকির পোলারা এইবার স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা এবং কারিগরি সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করছে।

আন্দোলনের শক্তি কমাইতে অগো তো অপারেশন চালানো দরকার। তা যত কম পোলাপাইনের উপর দিয়া চালাইতে পারে। মাদারচোতরা।

*
এইবার লাইন পাওয়া গেছে।

বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের ঘোষণা দিছেন সরকার। এইটা হয় না। আপনারা নিজেরা ৬ জনকে মারলেন। আর বলতেছেন ‘শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার স্বার্থে’ বন্ধ ঘোষণা করা হলো ও হল ত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হলো।

শিক্ষার্থীরা নিরাপদই ছিল। আপনারা তা চান নাই। এখন দমনপীড়ন শুরু করতে গিয়া গতকালকে ওদেরকে অপ্রস্তুত পাইয়া পিটাইছেন। আজকে আর সুবিধা করতে পারেন নাই। বিজিবি মোতায়েন করেও দেখলেন যে দাবানলের গতি স্বৈরাচারগ্রাসী।

তো কিসের বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ? কিসের হলত্যাগ?

এই মামুলি জায়গায় রাখছেন নাকি জিনিসটা? বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজেরই আন্দোলন এইটা। স্পেসিফিকলি। সকল পর্যায়ের স্কুল-কলেজের ছাত্ররা সংহতি জানিয়েছেন। উনারা স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকলেও যোগ দিতে পারবেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় এবং হল অন্য ব্যাপার; এই ইস্যুতে ছাত্রদের সাথে অন্য কোনো পন্থায় না পাইরা এইবার ওদের ক্যাম্পাস ছাড়া করবেন?

*
ছাত্রলীগ হারল
পুলিশ হারল
বিজিবিও গেল তল

দুইপয়সার সরকার কয়
এইবার বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ কর

হাহ হাহ হা
হাহ হাহ হা

বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়বো না
জুলুম নির্যাতন ডরাই না
আমার ভাই লাশ কেন
খুনি সরকার জবাব দে
বৈষম্যমুক্ত জীবন চাই
স্বৈরাচারমুক্ত স্বদেশ চাই

*
সারা দুনিয়াতেই মজলুমদের, নিপীড়িতদের গণতান্ত্রিক শক্তি বিরাট এবং ব্যাপক।

বাংলাদেশে আমরা তো ভুলতেই বসছিলাম যে এমন দিন দেখা সম্ভব। অভিনন্দন ছাত্রসমাজ।

কালকে যখন আমি ঢাবিতে, ৭:৪০ মিনিটের পর থেকে আর নেটওয়ার্ক পাচ্ছিলাম না। ঢাকা মেডিকেল আর বুয়েটের ওইদিক থেকে ফেসবুকে আর পোস্ট দিতে পারতেছিলাম না। এত পুলিশ ছিল, ছাত্রলীগ ছিল যে, ভয় কেন আপনি পাবেন না সেইটাই হইত বরং বিস্ময়কর। তবে যেই স্বাভাবিক এবং অটল মানসিকতা দেখছি আমি ছাত্রদের, রোকেয়া হলের ছাত্রীদের, তা অভূতপূর্ব। এই দেশে অনেকদিন অনেকদিন পরে এত ভালো লাগছিল।

বিকালের দিকে, মাত্র অল্প একটু দূরত্বে রাজু ভাস্কর্য ভর্তি ছাত্রলীগ আর রোকেয়া হলের গেট যেন ফেটে পড়তেছে ছাত্রীদের স্লোগ্যান আর হুঙ্কারে। উনাদেরকে বাইর হইতে দেয়া হয় নাই। তাও ছাত্রলীগকে দেখলাম ওদের পিচ্চিবাহিনী এবং নিজেদের পোলাপানকে রোকেয়া হলের গেট থেকে সরায়ে নিচ্ছে। পিছু হটছে।

হল দখল এবং ছাত্রলীগ উৎখাতের এই উৎসব বাংলাদেশের নতুন দিন।

মনে রাখতে হবে, এর কন্সিকোয়েন্স আছে। সেইজন্য, কাজ কেবলমাত্র শুরু হইল।

*
হল ছাড়া যাবে না।

কিয়ের বিজিবি, কিয়ের rab, কিয়ের পুলিশ।

এরা সেই বিজিবি, যারা আমাদের সীমান্তে গুলি খাওয়ার বদলে পাল্টা গুলি করে না। এরা সেই মিলিটারি হত্যাযজ্ঞের সাক্ষাৎ দোসর।

এরা সেই rab, যারা ফ্যাসিবাদের গুম, খুন এবং বিচারবহির্ভূত হত্যার ফিনিশার।

আর পুলিশ তো জানেনই আমাদের সকল গণতান্ত্রিক কর্মকান্ডের প্রথম বাধা। এরা সেই ‘ছাত্রলীগ’ যারা মিছিলে গুলি করে। যারা পেতে দেয়া বুককেও রেহাই দিতে জানে না।

ভয় নাই, গণতান্ত্রিক উপায়েই ফায়সালা করতে হবে। ভয়-ডর, ভার্সিটি বন্ধের হুমকি, হল থেকে বাইর কইরা দেওয়ার ক্ষমতা দেখায়ে লাভ নাই। সারাদেশেই সকল ক্যাম্পাস এখন একাট্টা। গো ব্যাক ফ্যাসিস্ট।

*
সব রাজনৈতিক দল তার সুবিধা ক্যাশ করতে মাঠে আসতে চাইবে। ভালো কথা।

কিন্তু সরকার তো ওই প্রস্তুতি নিছে। ক্যামনে আন্দোলনের হোগা মাইরা দিতে হয়, আপনারা রাজনীতিবিদরা ওইটার সাক্ষি এই দেশে। আপনাদের বিভিন্নজনের নামেই নানাভাবে বিক্রি হইয়া যাওয়ার গুঞ্জন আছে আপনাদেরই সহযোদ্ধাদের কাছে। এখন ছাত্রসমাজের এই প্রতিরোধের হোগা মাইরেন না প্লিজ।

পারলে ওদের মতো ইন্টিগ্রিটি নিয়া আসেন। নাইলে ওদেরটাও খাইয়া ফালায়েন না। বা ডাবল অ্যাজেন্ডা চোদাইতে আইসেন না।

*
ইউনিভার্সিটিগুলোর অবস্থা ভালো না। সরকার প্রাণপণ চেষ্টা করতেছে ক্যাম্পাস ফাঁকা করতে। ছাত্রদের পাশে দাঁড়ান।
.

১৮ জুলাই ২০২৪
কালকে সরকার জাস্ট অ্যাম্বুশ চালাইছে ঢাবি, জাবি, রাবিতে।

*
কালকে রাতে বাহিনী ঢাবির, নটরডেমের আশেপাশের এলাকায় মেস, ছাত্রাবাসগুলিতে হানা দেয় এবং কোথাও কোথাও থেকে ছাত্রদের তুলে নিয়ে গেছে বলে আমরা খবর পাচ্ছি।

*
ধ্রুব রাঠী এক্সে (টুইটারে) আছেন আমাদের ছাত্রআন্দোলনের পাশে। উনাকে ধন্যবাদ। উনার পোস্টগুলাতে এনগেইজমেন্ট ভালো হচ্ছে।

তবে, ফ্যাসিস্টের সহযোগী হিসেবে তাঁর নিজের দেশের তথা দিল্লির নীতির এবং মোদির ভূমিকা নিয়ে এখনও কিছু বলেন নাই উনি।


আনম্য ফারহান রচনারাশি
লাল, চিরকাল
তাৎক্ষণিকা : ১৮ জুলাই ২০২৪

Support us with a click. Your click helps our cause. Thank you!

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you