আমাদের পৃথিবী : আমরাই ডিম, আমরাই হাট্টিমাটিম টিম || আনম্য ফারহান

আমাদের পৃথিবী : আমরাই ডিম, আমরাই হাট্টিমাটিম টিম || আনম্য ফারহান

১.
জায়গা দেখার থেকে জায়গায় গিয়ে বসে বসে ঝিমানোর মারফতে দেখা, সেটা হয় গিয়ে হলো কল্পনার বাইরে। কল্পনা এবং বাস্তবের মধ্যকার মিলন খুব ফাস্ট। ঝিমায়ে ঝিমায়ে একটু স্লো করে, ঘুমায়ে ঘুমায়ে পার্থক্য কমিয়ে এনে, গোসল করে করে আত্মীয়তা ঘনিষ্ট করে তখন দৃশ্যের চাপ, শব্দের চাপ ধরতে হয়। চাপের চেয়েও রাজনীতিজ্ঞান, ক্রিটিক্যল দৃষ্টি সবমিলিয়ে অ্যান্টেনাতে বসে এইসব।

পৃথিবীকে ভালবাসা বা না-বাসা, জীবনকে পছন্দ করা বা না-করা; এসবের বাইরে শুধু অখন্ড মানুষ বা দুনিয়া, বা শিল্পবিপ্লবের বর্তমান দশা, বা উন্নত জীবন অনুন্নত জীবন — এইসব কিছুর বিচিত্রতা যা অফার করে, তার মধ্যে জীবনের প্রতি মনোযোগ ছাড়াই, বা জীবন যেন তার গোড়াহারা একটা সিউডো কারসাজির সমষ্টি; প্রবলভাবে দেখা যায়।

এতসব ট্র্যাপড জীবন, ছোটো ছোটো ট্র্যাপড ইউরোপ সবখানে, অ্যান্ড কলোনিজ অব দেয়ার ট্র্যাপড সিভিলাইজেশন, ইকোনোমিক সাফোকেশন, স্টিমড ব্রিথিং — দেখা মানে আরও সমষ্টিজাত করা এইসব অ্যালাইনড ডাটা। ফুঁসে ওঠার কথাও ইনজেক্টেড বা স্ট্রে-ডগের মতো ভুলে যাওয়া দেখতে খুবই অসহনীয় লাগে। স্লেভ মরালিটির সামনে এত দ্বান্দ্বিকভাবে মানুষের গ্লানি, পরাজয়, নমিত মুখের ততোধিক নমিত চোখ, ক্লান্ত শরীর দেখতে আলাদা প্রস্তুতি লাগে। দেশে দেশে, শহরে শহরে।

বুদ্ধিজমের শিক্ষা, সেক্যুলারিজমের শিক্ষা, উদারতাবাদী অর্থনীতির কানাগলি, সব পার হয়ে মানুষের টোটালিটারিয়ান কনসেপ্ট ধরে যেই প্রগতির কথা আঁকা হয়েছে, তাতে মানুষ নেই। ওই কনসেপ্ট বা কনসেপ্টগুলি আছে। সাবালক হওয়ার পথে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবও সামাজিক শেইপ নেয়ার ক্ষেত্রে স্থানিক কালচারের প্রতি ততটা মুখ ঘুরিয়ে নেই যতটা সে গ্লোবাল হতে চায়। গ্লোবাল হওয়ার এই-ই ঝুঁকি, তা কিছু একইরকমের প্রণোদনা চায়। তাতেও সমস্যা নেই, সমস্যা হচ্ছে সে অন্যদের প্রকাশ ও ভাষাভঙ্গির প্রতি রিলেটেড থাকতে চেয়ে নিজেকে রি-ডিজাইন করার প্রত্যয় ধারণ করে। তা হয়েই হয় বিশেষ ঝুঁকিটা।

জৈব প্রযুক্তির কল্যাণ আর মানবের কল্যাণ, শেষে সভ্যতা যেই কল্যাণবাদিতার কথা সর্বাগ্রে বলে; তা সবচেয়ে সিভিলাইজড সোসাইটিরও পলিসি হিসাবে খুব চমৎকার। তবে পলিসি গ্রহণ করাই হয় সমস্যাকে অ্যাড্রেস করে। তার আবার ইউজার গ্রুপ বায়াসনেসও আছে। ফলে আজকের বিশ্বের মহান সিভিলাইজড দেশগুলিও ইকোনোমির জন্য মুক্তবাজার দাঁড় করিয়েছে বটে বাট সুফলভোগীদের সংখ্যা ও অবস্থার দিকে তাকালে এর ব্যাপকতার একটা বিধ্বংসী চেহারা চোখে পড়বেই পড়বে। সুখবর হচ্ছে, তাতে মানুষ আপাত ট্র্যাপড, কিন্তু তার অন্বেষণ থামেনি। জাতিগত ও ছোট ছোট এইসব অসংখ্য দেশ বা শহর নামক ইন্ডাস্ট্রিগুলি একইরকমভাবে ক্লান্ত এবং পর্যুদস্ত। একইরকমভাবে। খাদ্য বা বাসস্থানের নিরিখে, কমোডিটির কনজাম্পশনে, চেষ্টা করতে করতে থিতু হতে হতে ভগ্ন স্বপ্ন আবার দাঁড়ায় কখনো কখনো।

কিন্তু জীবনের যেই অতি সাধারণ দিকগুলি, সেইগুলির প্রতি ঝুঁকে থেকে মানুষের আটকে-পড়া মুখ দেখা কী যে বিভৎস।

জেন ধর্মের অনুসারীদের নতুন চিন্তাভাবনা আমার পড়া হয় নাই। তাদের প্রস্তাব তো থাকা উচিত। জায়নবাদীদের নতুন চিন্তা উন্মোচিত হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। সনাতনী হিন্দুদেরও বিবেকানন্দ পর্যন্ত ঠিক আছে। তারই বিস্তারের পথে তারা এখন সবচাইতে আগুয়ান। মুসলিমদের টাইম আদি খ্রিশ্চিয়ানিটিকে চ্যালেঞ্জ করেই যেহেতু জয় লাভ করা, তার আধুনিকতার বিকাশ ও এস্ট্যাব্লিশমেন্টকেও কিন্তু ওইগুলা নব্যউদারতাবাদী পথকে কনটেন্ট করার রাস্তা ধরেই করতে হবে। সেক্ষেত্রে তত্ত্বগত দিক দিয়ে এশিয়ায় বাংলাদেশ আগানো আছে মনে করি। কিন্তু সেটা সম্পূর্ণ মুসলমানীয় এক্সেপ্টেন্স অন্য মুসলিমদের কাছে পায় না। মিডল-ইস্ট মডেলেও সেটা কার্যকর কিন্তু ওদের দেরি হয়েছে অনেক। এবং এখনও দোদুল্যমানতা রয়ে গেছে কারো কারো।

প্রাচীন সম্প্রদায়গুলির নতুন ধর্মচিন্তা, রাষ্ট্রচিন্তা ও সংস্কৃতির পথ তাদেরই হাত হয়ে আমাদের শুনতে পারা উচিত। শুধুই স্কলার বা তাত্ত্বিকদের কাছ থেকেই নয়। সেরকম চিন্তাপত্র এই এখনই অনেক জায়গা থেকে একত্র হতে পারলে বা হাজির থাকতে পারলে লাভ হতো।

আফ্রিকা থেকে ভ্রমণের দাগ আমাদের কারও উঠানোর দরকার নেই। মিসর, গ্রিস, দানিয়ুবের তীর, ভোলগা, আটলান্টিক ও অ্যান্টার্কটিকা বা পলিনেশিয়ার কারও তার দাগ সম্পর্কে অসচেতন হওয়ার কিছু নেই। আবার নতুন সভ্যতাগুলিরও তার নবতর হওয়ার যাত্রায় শংকিত কোনো দাগের কথা ভুলে যাওয়ার সুযোগ নেই। দেখা যাবে যে, সব ফ্রন্টিয়ারে তাদের সকলের কথাই প্রায় এক। বিচারপদ্ধতিও এক। নন্দনতত্ত্বও সিমিলার। মানে স্পিরিটের জায়গাটুকু।

তাদের সংঘর্ষ যেমন অনিবার্য তেমনি তাদের কারো কারো ধ্বংস হওয়াও। আর তাই সহাবস্থানও প্রেডিক্টেবল।

২.
দুইটি বিশ্বযুদ্ধের পরের পৃথিবীর মানুষের যেই ক্ষমতা ও বিকাশের বিন্যাস, তার অভিজ্ঞতা সাথে নিয়ে ৩য় বিশ্বযুদ্ধ/যুদ্ধগুলোর সাথে পরবর্তী নতুন বিন্যাসের থিসিস লেখা হয়ে গেছে। ওইখানে মানুষের জন্য, কল্যাণকামী রাষ্ট্র যেহেতু থেকেই যাবে, তাই তার মানুষের জন্য তারা উৎপাদন করবে ওই সেই ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্ট্রাকচার। যেটা মানবের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত টোটাল হিউম্যান জিনিসটাকেও ইন্ডাস্ট্রি ধারণায়ই পর্যবসিত করে। যেন সবই কোনো না কোনো লেবার মার্কেট। হায়ারার্কি অব লেবারস অ্যারাউন্ড দ্য গ্লোব।

এই থিসিসের পরবর্তী দশা ভেঙে মানুষের হাতে যত প্রকারের সুযোগ আছে তা সব অ্যাভেইলেবল করার বাইরেও আরেকটা কথা থাকে। তাকেই প্রাইম এনটিটি হিসাবে সভ্যতায় কাউন্ট না করা। এই চিন্তা একদম নতুন না হলেও অনেকটাই ভালো চিন্তা। কিন্তু মানুষকে রিসোর্সের অধীন রেখে কর্মময়তার স্বাদ দেয়া প্লাস কর্মহীনতার ব্যাপ্তির মধ্যে রেখে জগৎসংসারের সাথে যুক্ত রাখার বুদ্ধি যে-কোনো বয়সেই অ্যাডপ্ট করার প্রসেস রাখা। সমগ্র বিশ্ব যদি রিসোর্স হয় তাহলে সেখানে মানুষ সবাই মিলে আজীবন পরিশ্রম করে কী এগিয়ে নিচ্ছে? মানবসভ্যতা?

নাহ। একটা ইউটোপিক কনসেপ্ট সে আগায়ে নেয় বটে, যাতে তার জীবনের সহজ সরল দিকগুলো মূলত বিনষ্ট হয়। বিকাশ বিনষ্ট হয়। তা সব কেন তার সভ্যতার অংশ হতে পারে না? মানুষের তো এত্তসব অহেতুকতার দরকার নাই।

নিরর্থকতার আমদানি করাই হয় কি মানুষকে স্বস্তি জিনিসটা থেকে মুখ ফিরায়ে রাখতে?

সুস্থ স্বাভাবিক কর্মময় এবং কর্মহীন রিসোর্সভিত্তিক জীবন যে-কোনো মানুষের জীবনের গভীর অর্থ। পৃথিবীতে থাকাই একটি দার্শনিক অর্থ। স্পিরিচুয়ালিটি তারপর। কালচার তারপর। বাদবাকি সবকিছু তারপর। তা কেন পৃথিবী নামক রিসোর্সফ্যুল এলাকায় জন্মগতভাবে তার অর্জন করা হবে না?

কি অর্জন করবে সে, আসলে? এত্ত পরিশ্রমের পর? এত্ত ক্লান্তি জমিয়ে জমিয়ে পৃথিবীরই বুক ভারী করে করে? এবং পৃথিবীর অনেক কোমল শিল্পীর বুকও ভারী করে করে?

—৮/১১/২০২৩


আনম্য ফারহান রচনারাশি

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you