চিরবাতাসের স্বর || চরু হক 

চিরবাতাসের স্বর || চরু হক 

আজ ২৫ নভেম্বর আমার বাবা কবি নূরুল হকের ৭৯তম জন্মদিন। শারীরিকভাবে তিনি আজ নেই, কিন্তু আমি মনে করি আমার এবং তাঁর সকল শুভানুধ্যায়ীর হৃদয়ে তাঁর শুভ্র হৃদয়ের সকল দীপ্তি নিয়ে প্রতিমুহূর্তে উপস্থিত থেকে তিনি তাঁর ভালোবাসার রেণু ছড়িয়ে দিচ্ছেন।

এ শুভদিনটি উপলক্ষ করে নিবেদিত হলো তাঁর কিছু কাব্যকুসুম। কবি নূরুল হকের অগ্রন্থিত তিনটি কবিতা। তার আগে জেনে নেই লোকচক্ষুর-অগোচরে-থাকা এই কবির জীবনের মূল সংকেতগুলো —

কবি নূরুল হকের মর্ত্যলোকে আগমন ২৫ নভেম্বর ১৯৪৪, নেত্রকোনার বালালী গ্রামে। পিতা আবু সাইদ মুন্সি, মাতা মজিদা খাতুন। প্রয়াত হন ২২ জুলাই ২০২১।

শিশুকাল থেকেই জ্ঞানপিপাসায় উন্মুখ নূরুল হক বেড়ে উঠেছেন হাওড় অঞ্চলের মাটি আবহাওয়ার সমৃদ্ধ আবহে। স্কুলজীবন থেকেই সাহিত্যচর্চায় হাতেখড়ি। শিক্ষক হিসেবে পেয়েছেন মনস্বী চিন্তাবিদ যতীন সরকারকে। অষ্টম শ্রেণিতে থাকাকালে তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় নেত্রকোনা থেকে প্রকাশিত নেত্র সাহিত্যসংকলনে এবং সে-সময়ই তৎকালীন সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক আহূত কবিতা প্রতিযোগিতায় তাঁর ‘সবুজ আলোর দেশ’ কবিতাটি প্রাদেশিক পর্যায়ে প্রথম স্থান লাভ করে। অতঃপর শিক্ষাগুরু যতীন সরকার কর্তৃক আয়োজিত ও আহূত স্বরচিত কবিতা প্রতিযোগিতায় তাঁর ‘রবীন্দ্রনাথকে’ কবিতাটি সারা পূর্ব-পাকিস্তানের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে। শিক্ষক যতীন সরকার ছাড়াও কবি নূরুল হকের সাহিত্যচর্চা আরও বহুবিস্তৃত হয়ে ওঠে মরমি কবি জালাল খাঁ-র বাড়ির শিল্পসাহিত্যের আসরগুলোতে।

কবি নূরুল হক ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ হতে প্রথম স্থান অর্জন করে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন এবং অতঃপর ত্রিশাল নজরুল কলেজে এবং পরবর্তীতে ১৯৭০-এ নেত্রকোনা কলেজে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন।

এর মধ্যে শুরু হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ। দেশমাতৃকার আহ্বানে কবি চলে যান মুক্তিযুদ্ধে এবং আসামের সেলুনবাড়িতে প্রশিক্ষণ নিয়ে ১৯৭১ সালে এগারো নম্বর সেক্টরের গেরিলা বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সরাসরি অংশ নিয়ে ছিনিয়ে আনেন এদেশের স্বাধীনতা।

যুদ্ধপরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশে অধ্যাপক হিসেবে পুনরায় কর্মজীবন শুরু করেন এবং দেশের বিভিন্ন সরকারি কলেজে অধ্যাপনা শেষে ২০০৪ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। জীবনের প্রায় শেষাশেষি, একেবারে প্রৌঢ়ত্বের উপান্তে এসে, কবি নূরুল হক তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সব আঘাত ছড়িয়ে পড়েছে রক্তদানায়’ প্রকাশ করেন ২০০৭ সালে। কবির বয়স তখন তেষট্টি। বইটি সম্পর্কে বিশিষ্ট কবি, সাহিত্যবোদ্ধা ও মনীষী জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী মন্তব্য করেন এভাবে —

“নূরুল হকের কবিতার সঙ্গে এই আমার প্রথম পরিচয় এবং স্বীকার করছি, অজানা ও নতুন কোনো কবির সঙ্গে পরিচয়ের আগ্রহ তেমন একটা করি না আজকাল। কবিতা যে মনোযোগ দাবি করে, সেই মনোযোগের স্রোতে পড়েছে ভাটির টান। নূরুল হক ও তাঁর কাব্য ‘সব আঘাত ছড়িয়ে পড়েছে রক্তদানায়’ আমার সেই অভ্যাসের বন্ধ দরজায় আঘাত করেছে। … (বইয়ের) প্রতিটি কবিতার তন্বী দেহে এত লাবণ্য বাঁধা আছে, কথার অতীত এত অকথিত ভাবনা আছে, স্পষ্টতার সঙ্গে এত রহস্য জড়িয়ে আছে যে আমি, এই কবিতার পাঠক, কতটা বুঝলাম আর কতটা বুঝলাম না সে-হিসেব মুলতবি রেখে, ওই লাবণ্যের দিকে চোখ ফেরাই।” — খেয়া সাহিত্য সংকলন, শ্রাবণ, ১৪১

এরপর কবি নূরুল হক কাছাকাছি সময়েই কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ বের করেন। এ হিসেবে এটি সহ তাঁর কাব্যগ্রন্থগুলো যথাক্রমে — সব আঘাত ছড়িয়ে পড়েছে রক্তদানায় (নিরন্তর, ২০০৭); একটি গাছের পদপ্রান্তে (বিভাস, ২০১০); মুক্তিযুদ্ধের অসমাপ্ত গল্প ও অন্যান্য কবিতা (নান্দনিক, ২০১২); শাহবাগ থেকে মালোপাড়া (খেয়া, ২০১৪; এ জীবন খসড়া জীবন (খেয়া, ২০১৫); শম্ভুনাথ চট্টপাধ্যায়, কবিতার দিকে একজন (বেহুলাবাংলা, ২০১৭, গদ্যগ্রন্থ)এবং কবিতাসমগ্র (চৈতন্য, ২০২০)।

১৪১৯ সালে বাংলা কবিতায় গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে প্রদান করা হয় খালেকদাদ চৌধুরী সাহিত্য পুরস্কার। ২০১৩ সালের সারাদেশের ঘটনাবলির মর্মধ্বণিসম্বলিত শাহবাগ থেকে মালোপাড়া কবিতাবইটির প্রথম সংস্করণ ২০১৪-র ফেব্রুয়ারিতেই নিঃশেষিত হয়ে যায়। বইটি সম্পর্কে কবি মারুফ রায়হানের মন্তব্য —

“স্বকাল স্বভূমির দীর্ঘশ্বাস ও দীর্ঘবাদন, অর্জন ও বিসর্জন এবং আর্তি ও আকাঙ্ক্ষার সাথে নিজের আত্মাকে সংযুক্ত করে নূরুল হকের মতো সত্যিকারের কবিতা লিখতে পারেন ক-জন? সত্তরোর্ধ সহজিয়া নিভৃতচারী এই কবি এখনও অপঠিত ও না-গৃহীত রয়ে গেছেন কবিতারাজনীতিতে বিশ্বখেতাব পাওয়ার যোগ্য এই অবাক বাংলায়।” — একুশের সংকলন, বইমেলার নির্বাচিত ৫০, ২০১৪


ক বি  নূ রু ল  হ ক  অগ্রন্থিত কবিতা


নৈঃশব্দ্য ঘুঙুর
কিছু হতে চাই না ত আর
কোনো চাঁদনি পুরুষ,
কোনো রোদের সংলাপ
নিই না অঞ্জলি ভরে।
দোলাই না সুখে
কাঞ্চনের মালা
রাজন্য সুবাসে,
শুধু এই মুহূর্তের তাপ
জেগে থাক সত্তার নির্জনে,
ঝরাপাতা
পোকাদের মাঝে
কিছুক্ষণ সময় ফুরাক
বাজুক-না নৈঃশব্দ্য ঘুঙুর।

চিরবাতাসের স্বর
সাগর পারের হাওয়া থেকে থেকে বয়ে যাচ্ছে শুনি
“অর্ধেক ডেকেছ তারে অর্ধেক ডাকোনি”
অইটুকু কথা নিয়ে জীবন
বাতাস ওড়ে চির-বিদেশের দেশে
উদাস পরম বাউল বিয়োগী স্বরে আর্দ্র, নরম।

খাইখোরাকির গান
কতই-না ভাবি
হাতের মুঠোয় আমি
ধরে ফেলবো ফুলেল জীবন।
পরক্ষণে চেয়ে দেখি
দুঃখের নিক্তি দিয়ে
ওজন করছি হায়
সওদাগুলি মনপবনের হাহাকারে।


নূরুল হক মূল্যাঙ্কন ও স্মৃতিচারণ

COMMENTS

error: