রিপোর্টার্স ডায়েরি ২ / গবাদিপশুর খোঁয়াড়  || শামস শামীম

রিপোর্টার্স ডায়েরি ২ / গবাদিপশুর খোঁয়াড়  || শামস শামীম

২০১০ সালের নভেম্বরের শেষদিককার ঘটনা। দিরাই উপজেলার চরনারচর ইউনিয়নের লৌলারচর গ্রামে গিয়েছিলাম। বেসরকারি সংগঠন ‘ইরা’-র মৎস্যজীবীদের নিয়ে পরিচালিত একটি প্রকল্পের অনুষ্ঠানে ওই সংস্থায় কর্মরত বন্ধু শাহ কামাল নিয়ে গিয়েছিল। কোথাও গেলে নির্ধারিত প্রতিবেদনের বাইরেও আমি সাধারণত আরো বিভিন্ন বিষয়ে বা বিচিত্র বিষয় চেখে দেখার চেষ্টা করি। তাই চোখ-কান-নাসিকা সচল ও সচেতন রাখার প্রচেষ্টা থাকে। রাস্তায় এটা-সেটা দেখে দাঁড়াই, কথা বলি। এতে সঙ্গীরা বিরক্ত হলেও আমার কাজ থেমে থাকেনি। তাই পরবর্তীতে দেখা যায় এক সফরে গিয়ে একাধিক প্রতিবেদন ও বিচিত্র প্রতিবেদন বেরোয় আমার হাত দিয়ে।

সময়ের সঙ্গে এখন ব্যস্ততা বৃদ্ধি পাওয়ায় খোরাক থাকলেও সময় মিলছে না লেখা দাঁড় করানোর। তা, ওইদিন ফিরে আসার সময় আমার চোখ আটকে যায় গবাদিপশুর খোঁয়াড়ের দিকে। মানে পশুর হাজতখানায় আটকে যায় আমার চোখ। তখন হাজতখানায় কয়েকটি ভেড়া-ভেড়ি ছিল। বাঁশের খুটি দিয়ে গোলাকার খোঁয়াড় বানিয়েছেন হতদরিদ্র ইজারাদার। হাওরের কান্দাসংলগ্ন রাস্তার ধারের উন্মুক্ত স্থান। খোঁয়াড়ের উপরের অংশ সম্পূর্ণ খোলা। ইজারাদারের নাম নায়েব আলী। তার বাড়িও লৌলারচর গ্রামে।

কলোনিআমলের স্থানীয় সরকার আইনে এখনো ‘গরুর খোঁয়াড় ব্যবস্থাপনা আইন’ বহাল রয়ে গেছে। স্থানীয় সরকার আইনের ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের জন্য ‘ইউনিয়ন পরিষদের বিধিবিধান’ নামের সর্বশেষ সংশোধনীতে এ বিষয়টি দিব্যি বহাল আছে। সেখানে সপ্তদেশ অধ্যায়ের ৯৭ প্রবিধান প্রণয়নের ক্ষমতা বিভাগে গবাদিপশুর খোঁয়াড়ের বিষয়টি উল্লেখ আছে। এখানে গবাদিপশুর খোঁয়াড় ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে পরিষদকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। আইনে বহাল থাকলেও বর্তমানে সামাজিক কারণে খোঁয়াড় স্থাপনে ভাটা পড়েছে। কেউ আর আগের মতো ইজারা নিতে চান না। তাই গ্রামে গ্রামে খোঁয়াড় দেখা যায় না। তবে আইন যেহেতু আছে হঠাৎ কোথাও কোথাও এর অস্তিত্ব চোখেও পড়ে। যেমন গেলবার বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়নের সংগ্রামপুর ও দুলভারচর গ্রামে এ-রকম দুটি খোঁয়াড় দেখেছিলাম। তবে এইবার এই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বন্ধুবর রণজিৎ চৌধুরী রাজন জানালেন কোনো খোঁয়াড় ইজারা যায়নি, কেউ নিতে চায় না।

কোনো গবাদিপশু কারো ধানক্ষেত, ফসলি ক্ষেত বা বৃক্ষ নষ্ট করলে খোঁয়াড়ে এনে দিয়ে যান ক্ষতিগ্রস্থ ক্ষেত ও/বা ফসলের মালিক। গবাদিপশুর মালিক নির্ধারিত টাকা দিয়ে সেটা ছাড়িয়ে নেন খোঁয়াড় থেকে। তবে যারা খোঁয়াড়ে গবাদিপশু দেন তারাও কিছু টাকা পেয়ে থাকেন। মালিক দিনক্ষণ গুণে নির্ধারিত হারে ইজারাদারের হাতে টাকা বুঝিয়ে দিয়ে গবাদিপশু ছাড়িয়ে নেন। খোঁয়াড়ের গরু ছাড়াছাড়ির নিয়ম এমনটাই।

বৃটিশরা শাসন গুটিয়েছে প্রায় পৌনে-এক শতাব্দী হয়। কিন্তু অন্যান্য আইনের সঙ্গে গ্রামীণ জীবনব্যবস্থার সঙ্গে এই আইনটিও রয়ে গেছে। প্রশ্ন উঠেছে বর্তমান সময়ে খোঁয়াড়ের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে।

এখনো বিভিন্ন স্থানে ইউনিয়ন পরিষদ এসব গবাদিপশুর খোঁয়াড় ইজারা দিয়ে থাকে। অনেক পরিষদ ইচ্ছে করেই বিষয়টি এড়িয়ে যায়।

খোঁয়াড় ইজারা কেন কমে গেছে বা সংশ্লিষ্টদের কেন আগ্রহ নেই এ বিষয়ে সম্প্রতি কয়েকজন স্থানীয় সরকার প্রতিনিধির সঙ্গে আলাপ করেছি। তারা জানিয়েছেন স্থানীয়ভাবেই এ বিষয়ে ইজারাদারের আগ্রহ নেই। তাছাড়া গ্রামীণ বিচারব্যবস্থার অবনতি এবং গ্রামেও পলিটিক্স ঢুকে পড়ার পরোক্ষ প্রভাব পড়েছে খোঁয়াড় ব্যবস্থাপনায়। ইচ্ছে করলেও অনেকের পশু ফসল নষ্ট করলেও খোঁয়াড়ে এনে দেওয়ার সাহস রাখেন না ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ। তাছাড়া গবাদিপশু চুরি বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে খোঁয়াড় সংকটে পড়েছে। তাই এখন আগের মতো খোঁয়াড় ইজারা যায় না। অনেকে জানালেন, গ্রামীণ দুবৃত্তায়ন আগের চেয়ে কিছুটা কমেছে। এসব ছোটখাটো ক্ষতি মেনে নিচ্ছেন ক্ষতিগ্রস্তরা। যার ফলে বিচার-পঞ্চায়েতের নামে কোন্দল সৃষ্টিকারীরাও সুযোগ পাচ্ছেন না।

ওইদিন দিরাই উপজেলার খোঁয়াড়-ইজারাদার নায়েব আলীর সুখদুঃখের গল্পও শুনে নিয়েছিলাম পলকে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তিনি খোঁয়াড়ে থাকতেন। দিনে ২-৩টি পশু নিয়ে আসতেন ক্ষতিগ্রস্ত মানুষজন। এলাকার গবাদিপশুর মালিকরা ছুটে আসলেও বাইরের এলাকার কোনো গবাদিপশু ভুল করে অন্য এলাকায় এলে খোঁয়াড়ে দিয়ে যাওয়া তাদের গবাদিপশুর সন্ধান পেতে অনেক সময় বিলম্ব হয়। তখন ইজারাদার অনিশ্চয়তায় থাকেন। যদিও বিলম্বের কারণে তার বেশি টাকার প্রাপ্তিযোগ আছে। কিন্তু এগুলোর সুরক্ষা নিয়েই তটস্থ থাকেন তিনি। তাই মালিকের সন্ধান না পেলে খোঁয়াড়ের বদলে বাড়িতে নিয়ে রাখতে হতো। এতে নির্ঘুম কাটাতে হতো রাত।

নায়েব আলী জানিয়েছিলেন ২০১০-২০১১ অর্থবছরে তিনি ১২শ টাকায় খোঁয়াড় ইজারা এনেছিলেন। একটি গরুর জন্য তিনি দিনে ৫০ টাকা এবং ছাগল ও ভেড়ার জন্য ২৫ টাকা পেতেন। এই আয়েই চলে যেত তার সংসার। ২০২০ সালে এসেও খবর নিয়ে জানলাম যেসব স্থানে খোঁয়াড় ইজারা হয় তার ইজারামূল্য এখনো ৫০০-৭০০-১০০০-২০০০ টাকায়।

সময়ের পরিবর্তনে গরুর খোঁয়াড় ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণ আইন বহাল থাকবে কি না তা নিয়ে খোদ স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাই প্রশ্ন তুলেছেন। এটা কি আদৌ রাখার প্রয়োজন আছে?

  • প্রতিবেদনে ব্যবহৃত খোঁয়াড়ের আলোকচিত্রগ্রহীতা শামস শামীম

 

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you