প্রজন্মের বিদ্রোহ নিয়ে কিছু কথা || মাকসুদুল হক

প্রজন্মের বিদ্রোহ নিয়ে কিছু কথা || মাকসুদুল হক

বছর দুই আগের কথা। আজ থেকে ঠিক দুই বছর আগে, শেষ-জুলাই/অগাস্ট-শুরু ২০১৮ সালে, এই বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল যাকে নানান নামে ডেকে চিহ্নিত করার চেষ্টা লক্ষ করা যায়। ‘কিশোর বিদ্রোহ’ হিশেবে এর একটা ব্যাপক পরিচয় থাকলেও ঘটনাটা কৈশোরক অবুঝ অপরিণত মস্তিষ্কের কিছু মোটেই নয়। আবেগের উৎসার মাত্র নয়। এর একটা অভিঘাত সরাসরি আমাদের রাষ্ট্রীয় বাস্তবায়নকাঠামোয় পড়েছিল তখন। যথা খাসলত শাসকগোষ্ঠী এইটা নিয়া নানা টালবাহানা করেছে। দমনপীড়নের প্রকাশ্য ও চোরাগোপ্তা নানান ন্যাক্কারজনক ঘটনাও লক্ষ করে গেছি আমরা লাগাতার। সবই ইতিহাস আজ। সমস্তই ইতিহাসের অংশ। গরিমার ইতিহাস সন্দেহ নাই।

মিউজিশিয়্যান মাকসুদুল হক বাংলাদেশের প্রবাদপ্রতিম সংগীতব্যক্তিত্ব হয়েও মনুষ্যসংশ্রবহীন নক্ষত্রলোকে দিন গুজরান না করে গণসংলগ্ন থাকেন সবসময়, এ আমরা বরাবর লক্ষ করে আসছি। বাংলাদেশের রাজধানীতে যে-বিদ্রোহের সূত্রপাত, অচিরে যা দেশজোড়া আন্দোলনে রূপ নেয়, যেখানে গণপরিবহন সেক্টরের নৈরাজ্যকর খুনখারাবি-হার্মাদি নিয়া ন্যায্য দাবিভিত্তিক বিদ্যালয়গামী শিক্ষার্থীরা দুর্দান্ত ভাষায় এবং শরীরী অভিনব উপস্থাপনায় আন্দোলন সূচনা করে এবং ধারাবাহিক চালিয়ে যায় অকুতোভয়, এমন নজির যে-কোনো সময়ের ইতিহাসেই বিরলদৃষ্ট। গৌরবজনক তো বলা বাহুল্য। ‘প্রজন্মের বিদ্রোহ’ অভিধায় ভূষিত করে ম্যাক তথা মাকসুদুল হক সেইসময় সোচ্চার ছিলেন বরাবরের মতো। এই লেখাটা ম্যাক সামাজিক সংযোগ মাধ্যমে তার নিজের পাতায় লিখেছিলেন এবং অন্যত্র কোথাও দলিলায়িত হয় নাই এর আগে। গানপার  থেকে ম্যাকের অগ্রথিত সমস্ত রচনা আর্কাইভ করা হচ্ছে খুঁজে খুঁজে। এই লেখাটা আর্কাইভ করার গরজে লেখকের সঙ্গেও যোগাযোগ এবং যথারীতি অনুমোদন গ্রহণ করা হয়।

এমনিতে এ-মুহূর্তে এই লেখা প্রাসঙ্গিক অতটা না মনে হলেও ঐতিহাসিক পরম্পরায় এ-ধরনের লেখা নানা কারণেই সিগ্নিফিক্যান্ট। আর মনে রাখতে হবে যে গানপার  মৌহূর্তিক বিবেচনায় লাইক-শেয়ার পাবার নিমিত্তে লেখা পাব্লিশ করে না। মাকসুদুল হকের শুধু নয়, আরও একাধিক ব্যক্তির অগ্রথিত রচনা গানপার অঘোষিত উদ্যোগে আর্কাইভ করে আসছে, এইটা গানপারের নিয়মিত লক্ষকারীরা নিশ্চয় নজর করেছেন।  — গানপার

প্রজন্মের বিদ্রোহ নিয়ে কিছু কথা || মাকসুদুল হক
গত চারদিন ধরে যে-কথাটি আমি বলে আসছি তা-ই আবার সবাইকে রিমাইন্ড করিয়ে দিতে এই লেখা। আমরা আজ যা দেখতে পাচ্ছি তা কেবল সরকারের নীতিনির্ধারক ও আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধেই আন্দোলন চলছে বলে অনেকের ধারণা। এ-ধারণাটা কেবল ত্রুটিপূর্ণ নয়, এটা  মস্ত বড়  ভুল ও বিপজ্জনক। ইনফ্যাক্ট আমরা সরকারের ন্যারেটিভটাকে  প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উভয়ভাবেই  সমর্থন করছি।  কিছু উদহারণ :

১. অনেক বলার পরেও খেয়াল করছি আমাদের অভিভাবকশ্রেণির মানুষ ঠিকই  রাষ্ট্রের সুরেই গান করছেন। সরকারের পছন্দের শব্দগুলো হলো : কোমলমতি, শিশু, বাচ্চা … ইত্যাদি; এবং পথঘাটের মানুষের পছন্দের শব্দগুলো হলো : পোলাপান, সোনামনি  … ইত্যাদি। এগুলো যে অ্যাবিউসিভ শব্দ ও তারুণ্যকে অসম্মান ও খাটো করে দেখা বা ছোট করে দেখা হচ্ছে তা কিন্তু অনেকেই এই অব্দি আমলে নিচ্ছেন না। ফলে যা ঘটছে তা হলো : ঢালাওভাবে না হলেও ক্ষেত্রবিশেষে আজকের তারুণ্য তথাকথিত বড়দেরকে তাদের আন্দোলনের ধারেকাছেই ভিড়তে দিচ্ছে না। তারা ভালো জানে সমর্থনের নামে আমরা তাদেরকে করুণা করছি। করুণা করা এ-প্রজন্ম ঘৃণা করে তা আমরা ক’জনই-বা জানি?

২. আমাদের অভিভাবকশ্রেণির  মানসিকতা ও নিম্নগামী চিন্তাচেতনার অন্যতম কারণ  আমাদের ঐতিহাসিক ব্যর্থতা। আমরা মনস্থির করেছি অনেক আগেই যে আমাদের কাঁচাপাকা কেশধারী  কিছু বুদ্ধিজীবী, কিছু শিল্পী, কিছু বিশেষজ্ঞ, কিছু ছাত্রসংগঠন, কিছু স্বঘোষিত অ্যাক্টিভিস্ট, ফেইসবুকসেলিব্রিটি, ইউটিউবার, এবং  কিছু সুশীলতন্ত্রের মাতব্বররাই দেশকালরাজনীতি সম্পর্কে সবচেয়ে সুন্দর জ্ঞান রাখি, বুঝি ও এ নিয়ে আমরা কাউকে স্পেস দিতে চাই না বা দেবো না। গতকাল একজন মুক্তিযোদ্ধাকে কীভাবে হেনস্থা করা হলো তা দেখে লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে গেল। তারুণ্যের একটা প্রশ্ন বারংবার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। ভদ্রলোককে প্রশ্ন করা  হলো, “আপনারা এতগুলো বছরে কী করলেন?” একই প্রশ্ন আমারও। বুকে হাত রেখে বলুন তো, কী এমন আমরা করতে পেরেছি যার কারণে  এই নব্য প্রজন্ম আমাদের বাহবা দেবে বা আমাদের কথা  শুনবে? সত্যি কথা বলতে যেখানে আমরাই তাদের সম্মান করছি না, এই অব্দি ওরা যে সম্মান রেখে আমাদের সাথে কথা বলছে এটাই আমাদের সৌভাগ্য| একবার ভেবে দেখুন পুলিশ তাদের সাথে কী ভাষা ব্যবহার করছে এবং প্রতিউত্তরে তাদের ভাষার নমুনাটাই-বা কি? কখনো জীবনে পেরেছেন পুলিশকে সামনাসামনি এই ভাষায় গালি দিতে? কিন্তু ওরা পারছে এবং এখানেই তার শেষ না| এও বলে রাখি, একই ভাষায় আমাদের এই ‘বুইড়া’ প্রজন্মের বিরুদ্ধে যে ব্যবহার করবে তা কেবল সময়ের ব্যাপার। আমাদের যদি হুশ না হয়ে থাকে তা এখনই হওয়াটা অতি জরুরি

৩. সরকারের গতকালের রিঅ্যাকশন আমাকে সত্যি খুব বিচলিত করেছে। ওয়ার্দিহীন ও ওয়ার্দিপরা নিরাপত্তাকর্মকর্তাদের যুক্তি ও আহ্বান যা অভিভাবকদের দিকে ছুঁড়ে দেয়া হয়েছে তার সারমর্ম : “রাজনৈতিক অপশক্তি এই ন্যায্য আন্দোলনকে স্যাবোটাজ করতে পারে … সেইরকম আলামত পাওয়া যাচ্ছে বলে কিছু সূত্রে খবর আসছে।  তাই ‘বাচ্চাদের’ নিরাপত্তার জন্য স্কুল-কলেজ বন্ধ করা হয়েছে।” বাহ্! তাহলে সরকার কী আবারও ব্যর্থতা স্বীকার করল না? কোথায় আছেন আমাদের গোয়েন্দা সংস্থারা? যেখানে মাদক সহ জঙ্গি নির্মূলে আপনাদের প্রশংসা না করে পারা যায় না, সেখানে মামুলি দু-একটা ‘বিএনপি’ বা ‘শিবির’ ক্যাডার  আটক করার ক্ষমতা কি আপনাদের নেই? এসব যুক্তি কি বিশ্বাসযোগ্য? মোদ্দা কথা, ঠিক রাস্তাঘাটের ন্যায় আপনারা সমগ্র দেশটাকে আল্লাহর উপরে ছেড়ে দিয়েছেন।

৪. আমাদের এতগুলো বছরে আরেকটা বড় অর্জন : ‘মাইরের উপর ওষুধ নাই’ বা ‘ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করো’ সাংস্কৃতি। ধরে নিলাম গতকাল বিকেলে মিরপুরের লাঠিচার্জ ও বেদম পেটানোতে ছাত্রলীগ জড়িত না। তাহলে পুলিশের সামনে ওয়ার্দিহীন যে-সকল ছেলেপেলে লাঠি  হাতে আপনাদেরকেই নেতৃত্ব দিচ্ছিল, তারা কারা? কী কারণে এবং কোন সাহসে পুলিশ এসব নাম-না-জানা, অজানা লোক আপনাদের অ্যাকশনের সময় ‘নেতৃত্ব’ দেয়? কোনো সদুত্তর  পাবো কি?

শেষ কথা, এই প্রজন্মের বিদ্রোহ বা আন্দোলন যে-নামেই আখ্যা দেন না কেন হয়তো-বা কিছুদিনের জন্য আপনারা ‘ডান্ডা মেরে ঠান্ডা’ করতে পারবেন, কিন্ত নিশ্চিত থাকেন যদি এর শান্তিপূর্ণ ও সর্বজনগ্রহণযোগ্য সমাপ্তি না ঘটে, আর আপনাদের ভুলক্রমে একটি বা একাধিক শিক্ষার্থীর ‘লাশ’ পড়ে, এই প্রজন্মর বিদ্রোহ রূপ নেবে ‘নাগরিক বিদ্রোহ’-তে যা আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, বিএনপি বা শিবিরের জুজুর ভয় দেখিয়ে  দিয়ে থামানো বা দমন করা সম্ভব হবে না।

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you