কিংবদন্তি? নাকি রূপকথা?
বাংলা ব্যান্ড মিউজিকের কিংবদন্তি শিল্পী আইয়ুব বাচ্চু চলে গেছেন না-ফেরার দেশে। গত কয়েক দশকে কোনো সংগীতশিল্পীর মৃত্যু সাধারণ মানুষকে এতটা শোকার্ত করেছে কি না বলতে পারছি না। সর্বস্তরের মানুষ তাদের সাধ্যমতো ট্রিবিউট করেছে এই কিংবদন্তিকে বিদায় জানাতে। একসময় প্রায় অচ্ছুত ব্যান্ডসংগীতের একজন শিল্পী যে এত মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে গেছেন, তা এই সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে ভক্তদের শোকের বিলাপ না দেখলে বুঝতে পারতাম না।
আমরা যারা ৯০ এর দশকে শিশুকিশোর ছিলাম আমাদের মিউজিক অরিয়েন্টেশন শুরু হয়েছিল আইয়ুব বাচ্চু, জেমস, মাকসুদ এবং হাসানের গান শুনে। সে-সময় হয়তোবা তাদের গান সেভাবে বুঝতাম না, কিন্তু কানটা তৈরি হয়ে গেছিল রক মিউজিকের জন্য। পরবর্তী শূন্য দশকে মিউজিক নিয়ে বোঝাপড়া করার একটা ক্ষেত্র তৈরি হয় নতুনভাবে। কিন্তু আমার সংগীতরুচি নস্ট্যালজিয়ায় আক্রান্ত। নব্বইয়ের সেই সুর আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। নতুনভাবে বুঝতে শুরু করি, নতুনভাবে আবিষ্কার করতে থাকি সেই নস্ট্যালজিক সময়টাকে। সেই সূত্রে আইয়ুব বাচ্চু কিংবা ‘এলআরবি’-র প্রতি ভালোলাগা ভালোবাসা অটুট থেকে যায়। এখনও চেষ্টা করি আইয়ুব বাচ্চুকে অ্যাপ্রিসিয়েশন করতে, হয়তো পুরোপুরি সম্ভব না। বিশাল বৈচিত্র্যময় সৃষ্টি আইয়ুব বাচ্চুর। এর মধ্যে অধিকাংশই শোনার বাইরে থেকে গেছে, জানা হয়েছে খুব অল্পই।
রূপালি গিটারের প্রেমে
এই রূপালি গিটার ফেলে
একদিন চলে যাব দূরে, বহুদূরে
সেদিন চোখের অশ্রু তুমি রেখো গোপন করে
আইয়ুব বাচ্চুর সাথে প্রথম পরিচয় ঘটে ‘সুখ’ নামক ফিতার মাধ্যমে। ওই অ্যালবামের ‘রূপালি গিটার’ গানটা খুব বাজত আমাদের বাড়িতে। অদ্ভুত এক মায়াবী সুর তখনই আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। সেই যে মুগ্ধতার শুরু তা আজও বর্তমান। প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে শত অভিমান থাকার পরেও।
সেই তুমি কেন এত অচেনা হলে,
সেই আমি কেন তোমাকে দুঃখ দিলেম
কেমন করে এত অচেনা হলে তুমি
কিভাবে এত বদলে গেছি এই আমি
বুকেরই সব কষ্ট দু-হাতে সরিয়ে
চলো বদলে যাই…
এরপর ‘চলো বদলে যাই’-এর গল্প তো ইতিহাস। বাংলা ব্যান্ডসংগীতের ইতিহাসের বাঁক বদলে দেয় ‘চলো বদলে যাই’। এটা অনেকটা বাংলা ব্যান্ডমিউজকের জাতীয় সংগীত। আইয়ুব বাচ্চু এবং এলআরবি-র এক এবং অদ্বিতীয় সিগ্নেচার স্যং। এমন কোনো কন্সার্ট নেই যেখানে ‘চলো বদলে যাই’ না-গেয়ে আইয়ুব বাচ্চু মঞ্চ ছেড়েছেন। আমাদের বন্ধুদের গানের মজমাতেও আজও অপরিহার্য নাম্বার ‘চলো বদলে যাই’। সত্যিকার অর্থেই এ-রকম ক্রিয়েশন দ্বিতীয়বার হয় না। ‘চলো বদলে যাই’ স্বমহিমায় বেঁচে থাকবে আরও কয়েক প্রজন্মের মুখে মুখে।
একদিন ঘুমভাঙা শহরে
মায়াবী সন্ধ্যায় চাঁদজাগা এক রাতে
একটি কিশোর ছেলে, একাকী স্বপ্ন দ্যাখে
হাসি আর গানে, সুখের ছবি আঁকে
আহা কী যে সুখ!
এলআরবি-র প্রথম ফিতায় ‘ঘুমভাঙা শহরে’ আরেকটি অবাক-করার-মতো সৃষ্টি। বাংলা গানকে একঘেয়েমিভরা আমি-তুমি থেকে মুক্তির পথ দেখেয়েছিল এসব অদ্ভুত সুন্দর লিরিক। এই গানগুলো ওয়াকম্যান আর ক্যাসেটপ্লেয়ারে বাজিয়ে কত অলস দুপুর পার করেছি, কত নির্ঘুম রাত কাটিয়েছি এসব গান শুনে তা পিছনে ফিরে তাকালেই মনে পড়ে যায়।
এলআরবি-র গল্প
প্রায় এক দশকের ব্যান্ডসংগীতের অভিজ্ঞতা নিয়ে, নিজস্ব সংগীতভাবনাকে প্রকাশের জন্য ‘সোলস’ থেকে বেরিয়ে এসে আইয়ুব বাচ্চু গঠন করেন রকব্যান্ড এলআরবি। শুরুতে সঙ্গে ছিলেন টুটুল, জয় এবং স্বপন।
“এলআরবি সস্তা জনপ্রিয়তার স্রোতে গা ভাসাতে সম্পূর্ণ নারাজ। এলআরবি মনে করে সংগীত যে-ভাষারই হোক না কেন বা যে-কোনো দেশেরই হোক না কেন সে তো সবারই জন্য”(LRB দ্বৈত ফিতার ফ্ল্যাপ থেকে)।
দীর্ঘ ২৫ বছরের বেশি সময় এলআরবি টানা তাদের এই প্রতিশ্রুতি ধরে রেখে মিউজিক করে আসছে। এলআরবি কখনো গানের সাথে আপোস করেনি। শুরু থেকেই প্রথম সারির ব্যান্ড হিসেবে এলআরবি-র স্বপ্নযাত্রায় একে একে বের হয়েছে ‘এলআরবি’ (দ্বৈত), ‘সুখ’, ‘ঘুমন্ত শহরে’, ‘তবুও’, ‘ফেরারী মন’ (আনপ্লাগড), ‘স্বপ্ন’, ‘মন চাইলে মন পাবে’, ‘আমাদের বিস্ময়’ (দ্বৈত), ‘স্পর্শ’, ‘যুদ্ধ’ প্রভৃতি স্টুডিয়ো-অ্যালবামগুলো। এছাড়া মিক্সড অ্যালবামের মধ্যে ফিলিংসের সহযোগে ‘ক্যাপসুল ৪০০মিগ্রা’ এবং ‘স্ক্রুড্রাইভার’ অ্যালবামদ্বয় ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। এলআরবি-র গানের জন্য কয়েকজন বিশেষ গীতিকার ছিলেন। এরা মূলত গীতিকবিতা লিখতেন, পরবর্তীতে এলআরবি-র গীতিকার হিসেবেই তারা পরিচিতি পান। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য শহীদ মো. জঙ্গী, লতিফুল ইসলাম শিবলী, বাপ্পী খান, এনজেল শফিক, জায়েদ আমিন, নিয়াজ আহমেদ অংশু প্রমুখ। আইয়ুব বাচ্চু নিজেও অনেক শক্তিশালী লিরিক লিখতেন। এনাদের সবার প্রচুর কন্ট্রিবিউশন এলআরবি-র জন্য। এলআরবি শুরুতেই যে-ঘরানার মিউজিক পরিবেশন করত তা শোনার মতো সিরিয়াস শ্রোতাশ্রেণি তখন ছিল না। এলআরবি সেই জায়গায় ঝুঁকিই নিয়েছিল বলা যায়। সেইসময় ‘মাধবী’, হকার, পেনশন, ‘রিটায়ার্ড ফাদার’, ‘সাবিত্রী রায়’-এর মতো ব্যতিক্রমধর্মী লিরিক নিয়ে কাজ করা ঝুঁকিপূর্ণই বটে। এলআরবি তাদের মিউজিকের ক্ষেত্রে একাধারে ইউনিক এবং ভার্সেটাইল, যার জন্য শ্রোতাদের কখনো একঘেয়ে মনে হয়নি এলআরবি-কে। আজকে আইয়ুব বাচ্চুর প্রয়াণে এলআরবি-তে যে-শূন্যতা তৈরি হলো, তা পূরণ হবার নয়। মূলত এলআরবি এবং আইয়ুব বাচ্চু এক ও অভিন্ন সত্তা।
নিঃসীম অন্ধকার জন্ম দিয়েছে আমার
তাই ভয় নেই অন্ধকারের।
আমি কোনো অতীত চিনি না, চিনি না বর্তমান —
তাই ভবিষ্যৎ বলেও কিছু নেই।
আমার আছে শুধু মহাকাল
যে আমায় শিশুর মায়ায় ভালোবাসে,
যার শরীরে আমার ছায়া পড়ে
আমার স্বপ্ন বেঁচে আছে যার মাঝে।
(‘স্বপ্ন’ ফিতার ইনলে ফ্ল্যাপ থেকে)
কষ্ট কাকে বলে…
তারপর একদিন ভরা জোৎস্নায় আমিও চলে যাব — একমাত্র নিশ্চয়তাকে সঙ্গী করে চির-নবান্নের দেশে। জেনে যাব —সবকিছুই বড় দেরিতে আসে, বড় দেরিতে ধরা দেয়, হারিয়ে যায় সেও হঠাৎ করেই। শুধু কষ্টটা থেকে যায় — আসলে কষ্টটা এভাবেই ছিল —কষ্টটা এভাবেই থাকে। — আইয়ুব বাচ্চু
‘কষ্ট’ নামক ফিতার ফ্রন্ট-কাভারে এভাবেই কষ্টকে সংজ্ঞায়িত করেছেন বাংলা ব্যান্ডসংগীতের কষ্টের ফেরিওয়ালা আইয়ুব বাচ্চু। ব্লুজ সংগীতের সাধনা করেছিলেন গিটারের ছয়টি তারে। আইয়ুব বাচ্চু কোনো-এক সাক্ষাৎকারে ব্লুজ সম্পর্কে বয়ান দিয়েছিলেন এভাবে —
“প্রকৃত অর্থে ব্লুজ কিছুই না, তোমাকে সিম্পলিফাই করে দেই : ব্লজ হচ্ছে কান্না। কাঁদতে থাকো। অন্তর দিয়ে কাঁদতে থাকো। প্রাণ দিয়ে গিটার বাজাও, গান গাও। ব্লুজটা আমাদের কাছে হচ্ছে নিজেদের মাঝে বিলিয়ে দেয়া। আমাদের কাছে ব্লুজটা হচ্ছে নিজেদেরকে উৎসর্গ করা। যন্ত্রের সাথে, গানের সাথে, দর্শকের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করা।”
কোনো-এক সাক্ষাৎকারে তিনি সুখ বিষয়ে বলেছেন —
“সুখটা খুবই ক্ষণিকের। এই আছে তো এই নেই। সুখ, যেটার আশায় মানুষ মরে যায়। সুখ সুখ সুখ করতে করতে মানুষ একদম শেষ, কিন্তু দুঃখটা অবধারিত। জন্মলগ্নে কান্না, বিদায়লগ্নে কান্না। এর মাঝখানের বাকি জীবনটাও পুরোটা কান্না। দুঃখ অবধারিত, এটা মেনে নিয়েই চলতে হবে। সুখটা কদাচিৎ আসতেও পারে, না-ও আসতে পারে। একটা আম খেয়েও সুখী হতে পারো, একটা আইসক্রিম খেয়েও সুখী হতে পারো, একটা ঘুড়ি উড়িয়েও সুখী হতে পারো, একটা সাইকেল চালিয়েও সুখী হতে পারো, একটা মোটরসাইকেল চালিয়েও পারো, কিংবা একটা বিশাল নদী সাঁতরিয়েও সুখী হতে পারো। কিন্তু দুঃখ তোমার সাথে সাথে আছে। পদে পদে মানুষের জীবনে দুঃখ, ছায়ার মতো। দুঃখই একমাত্র মানুষের প্রকৃত বন্ধু।”
‘কষ্ট’ তার মিউজিকের অন্যতম অনুষঙ্গ। দুঃখবিলাসী এই অভিমানী মানুষটি নিজের ভেতরের সব কষ্ট ঢেলে গিটারের ছয়টি তারে তুলেছেন একের পর এক ব্লুজের নোট। তার ব্লুজসাধনায় উৎকৃষ্ট উদাহরণ — ‘এখন অনেক রাত’, ‘ফেরারী মন’, ‘তারাভরা রাতে’, ‘কেউ সুখী নয়’, ‘কষ্ট কাকে বলে’-র মতো গান, যেখানে ফুটে উঠেছে তার ভাঙা মনের করুণ আর্তনাদ।
আমার একটা নির্ঘুম রাত
নিজের হাতে তুলে নিলেই
বুঝতেই তুমি
কষ্ট কাকে বলে।
(এপিটাফ)
…
আমি যাব চলে
দূরে, বহুদূরে
গান শুধু রবে
আমার স্মৃতি নিয়ে
আইয়ুব বাচ্চু শারীরিকভাবে আমাদের মধ্যে নেই, আর তিনি গিটার হাতে মঞ্চ কাঁপাবেন না। বড্ড অকালেই তিনি চলে গেলেন। অনেককিছুই দেয়ার বাকি ছিল। তবুও প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে আইয়ুব বাচ্চু আর তার এলআরবি-র অমর সৃষ্টিগুলো থেকে যাবে। এর মধ্যেই অমর হয়ে থাকবেন আমাদের কষ্টের ফেরিওয়ালা।
- বিদায় কষ্টের ফেরিওয়ালা || মুনতাসির মামুন সজীব - October 30, 2018
- ডেথ অফ অ্যা রকস্টার || মুনতাসির মামুন সজীব - July 14, 2018
- ম্যাকের জন্য পঙক্তিগুচ্ছ || মুনতাসির মামুন সজীব - September 20, 2017
COMMENTS