মাধবকুণ্ডের বারুণীমেলা

মাধবকুণ্ডের বারুণীমেলা

মাধবকুণ্ডের জলপ্রপাত দেখতে দেশের ভ্রমণতৃষ্ণ লোকেদের আনাগোনা লেগেই থাকে বছরভর। বিশেষত শীতের সিজনে পিক্নিকপার্টির ভিড়ে এলাকাটা সরগরম থাকতে দেখা যায়। বছরের অন্য সময়েও পর্যটকপদপাতে বেশ মুখর থাকে মাধবকুণ্ডতল্লাট। তবে দেশের পর্যটনস্পৃহ অনেকেই হয়তো খবরটা জানেন না যে এইখানে চৈত্রমাসে বারুণীর স্নান অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে। এবং যেখানেই তীর্থস্নান, সেখানে মেলা তো অবধারিতই। মাধবকুণ্ডের বারুণীস্নানস্থলে যে-মেলা, তা আকারে এবং প্রকারে এখনও উল্লেখযোগ্য।

মৌলভীবাজার জেলার অন্তর্গত বড়লেখা উপজেলার পাথারিয়া পাহাড়ে গেলে এই মাধবের কুণ্ডটা পাওয়া যাবে। ন্যাচারাল বিউটির দিক থেকে এই মাধবকুণ্ড ও এর চারপাশের নৈসর্গিক দৃশ্যপুঞ্জ নয়নাভিরাম। প্রায় দুইশ ফুট উঁচা থেকে নেমে এসেছে পানিধারা। প্রাকৃতিক ম্যাজিক যেন। সবাই মাধবকুণ্ডে যেয়ে এই পানিপ্রপাত ঘিরেই দাপাদাপি করে দিন ফুরিয়ে ফেলে। এর চারপাশের টিলাতল্লাট ঘুরে দেখার ফুরসত হয় অল্প লোকেরই। কিংবা স্থানীয়জনদের সঙ্গে খুচরা আলাপে কেউ খুব-একটা যায় না, যদি যেত তবে এর লোকেদের কলা ও কালচার নিয়া জানতে পারত।

জনশ্রুতি আছে এমন যে এক-সময় সিলেটের প্রতাপান্বিত রাজা গোবর্ধন মৃগয়ায় বের হন। ঘুরতে ঘুরতে এসে পড়েন পাথারিয়া পাহাড়ে। এবং মাধবকুণ্ডের শোভা দেখে এইখানে একটুখানি জিরিয়ে নেবার ইচ্ছায় লোকলস্করদেরে বলেন একটা বিশ্রামাগার বানাইতে। রাজার লোকজন ভবন বানাইবার জন্য খুঁটি ইত্যাদি বসাইতে যেয়ে মাটি খুঁড়তে শুরু করলে এক-সময় দেখে যে মাটির নিচে এক সন্ন্যাসী গভীর ধ্যানমগ্ন। উনার ধ্যান তো ভাঙানো যায় না কোনো কসরতে। এদিকে রাজার তো সন্ন্যাসীসান্নিধ্য না হলে চলছে না একেবারে। শেষে রাজা গোবর্ধন শুরু করেন সন্ন্যাসীকে স্তবস্তুতি নিবেদন।

অবশেষে অটল সন্ন্যাসপাথরের মন গলে। রাজা গোবর্ধনের কায়মনোবাক্যনিবেদনে সন্ন্যাসী প্রসন্ন হয়ে ধ্যান থেকে জেগে নিবেদনকারীর দিকে মুখ তুলিয়া তাকান। বহু মুসিবতে জেরবার রাজার প্রতি কিছু উপদেশবচন আর আশীর্বাদ রেখে সন্ন্যাসী আজ্ঞা করেন যেন প্রত্যেক বছর এই কুণ্ডে মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশী তিথিলগ্নে পিণ্ড বিসর্জনের মাধ্যমে সন্ন্যাসীনির্দেশ পালন করা হয়। এরপর সন্ন্যাসী পরপর তিনবার ‘মাধব … মাধব … মাধব’ আওয়াজ দিয়া হাওয়ায় মিলাইয়া যান। সেই থেকে শুরু। কুণ্ডের নাম মাধবকুণ্ড, জনশ্রতিমতে এইটুকুই ইতিহাস।

ষোড়শ শতাব্দী থেকে একবিংশ অব্দি মাধবকুণ্ডে সেই সন্ন্যাসীর আওয়াজের লীলা চলছে। প্রতিবছর মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশী তিথিতে এইখানে হিন্দু পুণ্যমনস্কামীরা বারুণীস্নানে এসে জমায়েত হন। কুণ্ডসংলগ্ন একটা প্রাচীন মন্দির। শিবের মন্দির। লোককথা থেকে জানা যায়, নাগাবাবা নামে আরেক সন্ন্যাসী কুণ্ডের উত্তরদিকের গভীর জঙ্গলে আস্তানা গেড়েছিলেন। মাধবেশ্বর শিব একরাতে সেই সন্ন্যাসীর স্বপ্নে দেখা দেন এবং বলেন, আমি এই কুণ্ডে তলিয়ে আছি, আমারে তোমরা একটা-কোনো মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করো। স্বপ্নোত্থিত নাগাবাবা মাধবেশ্বরের খোঁজে কুণ্ডতল্লাশি শুরু করেন। অনেকদিনের পরিশ্রম ও সাধনার পরে একদিন নাগাবাবা তার স্বপ্নে-দেখা শিবের সন্ধান পান মাধবকুণ্ডের তোলপাড় ঝর্ণাজলরাশির ভিতর এবং কৌপিনে বেঁধে এনে তার আরাধ্য দেবতাকে এই শিবমন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেন। এইভাবে নাগাবাবা তার স্বপ্নাদেশ পালন করেন।

আগে তো অকথ্য দুর্গম ছিল মাধবকুণ্ডযাত্রা। আজকাল তো সংযোগব্যবস্থা আশাতীত উন্নত হয়েছে। হ্যাপা নাই আগের মতো গমনাগমনে। এখন পরিবহনসুযোগ-সুবিধাদিও অনেক বেড়েছে। এই একদশক আগেও পর্যটকদের জন্য খুব-একটা আপদবিপদের নিরাপত্তা ছিল না বলতে গেলে। এখন জেলা পরিষদের উদ্যোগে ব্যবস্থাদি যা আছে তা মন্দ নয়। একটা পান্থশালাও গড়ে উঠেছে। এবং মাধবকুণ্ডের মেলা আজকাল বেশভূষা খানিকটা পাল্টে হলেও বড় হচ্ছে। লোকসমাগমও অনেক বাড়বাড়ন্ত। বহুবৈচিত্র্যের মনোহারী জিনিশপত্রাদি মেলায় বিকিকিনি হয়। গ্রামীণ খেলাধুলা, কাঠের নাগরদোলা আর ঘোড়ায় চড়ার ব্যবস্থা থাকায় বাচ্চাকাচ্চাদেরও মেলায় নিয়ে যেয়ে দেশজ ঐতিহ্যপরিচয় এবং নিজের শেকড়ের এক্সপোজারটাও ঘটানো যায়।

লেখা : সুবিনয় ইসলাম

সহায়ক তথ্যসূত্র / * ধানশালিকের দেশ, বর্ষ ২৫ সংখ্যা ২, এপ্রিল-জুন ১৯৯৭, বাংলা অ্যাকাডেমি, ঢাকা
* আনন্দভুবন, বর্ষ ২ সংখ্যা ২২, এপ্রিল ১৯৯৮, বেক্সিমকো মিডিয়া লিমিটেড, ঢাকা
* বিভিন্ন লোককথা ও জনশ্রুতি

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you