গবেষক ও নাট্যকার সাইমন জাকারিয়ার আহ্বানে সিলেটের ওসমানীনগর উপজেলায় আসা। সেদিন ছিল ২০১১ সালের ৬ ডিসেম্বর। খুব সকালে তাঁর ফোনকল পেয়ে ঘুম ভাঙে। তিনি জানান, তাঁর ও নাজমীন মুর্তজার যৌথভাবে লিখিত এবং প্রকাশিতব্য ফোকলোর ও লিখিত সাহিত্য : জারিগানের আসরে ‘বিষাদ সিন্ধু’ আত্তীকরণ ও পরিবেশন পদ্ধতি গবেষণাগ্রন্থের কাজে জারিগান প্রত্যক্ষ করতে সিলেট আসছেন। এ কথা শোনার পর তাঁকে সঙ্গ দিতেই ওসমানীনগর উপজেলার এওলাতৈল গ্রামের উদ্দেশে যাত্রা।
সন্ধ্যা সাতটার দিকে ওসমানীনগরগামী গাড়িতে চেপে বসি। ভাঙা জানালা দিয়ে ঠাণ্ডা বাতাস আসছে। কেউ একজন বিড়ি জ্বালাতেই পেছন থেকে এক লোক হাঁকিয়ে উঠলেন, ‘এই, বিড়ি জ্বালাইছে কেডা?’ ঠিক এ সময় সাইমনভাইয়ের ফোন। জানালেন, তিনি ওসমানীনগর বাজারে পৌঁছে গেছেন। আমি তাঁকে জানালাম, আধাঘণ্টা অর্থাৎ রাত ১০টার মধ্যে আমিও পৌঁছে যাব। ঠিক সময়ে ওসমানীনগরে সাইমনভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়। এরপর দুজন মিলে খাওয়াদাওয়া সেরে একটি অটোরিকশা ভাড়া নিই। মিনিট দশেকের মধ্যে নির্দিষ্ট গন্তব্য এওলাতৈল গ্রামে পৌঁছই।
এওলাতৈল পৌঁছে তো আমার চক্ষু রীতিমতো চড়কগাছ! এত বর্ণিলভাবে সিলেট অঞ্চলে মহররম পালিত হয়ে আসছে – সেটা আমার এতদিন ধরে অজানা ছিল। বিষাদে-বেদনায় ভারাক্রান্ত মানুষের আর্তনাদে ভারী হয়ে ওঠে চারপাশ। চারিদিকে নীরব গাম্ভীর্য আর শোকের মাতম। আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার নির্বিশেষে বিলাপধ্বনি – ‘হায় হোসাইন, হায় হোসাইন…।’ এ যেন কারবালা প্রান্তরে ইমাম হোসেনের শাহাদাতবরণের শোকাবহ সেই ক্ষণ, সেই মুহূর্ত! প্রায় ৪০ বছর ধরে নানা বর্ণিল আয়োজনের মধ্য দিয়ে সিলেটের ২০টি গ্রামে মহররম মাসের ১ থেকে ১০ তারিখ পর্যন্ত শোকাবহ আশুরা পালিত হয়ে আসছে।
যে-বিশটি গ্রামে মুসলমান সুন্নি সম্প্রদায়ের ধর্মপ্রাণ মানুষজন ‘মহররমের জারি’ পালন করে আসছেন, সেই গ্রামগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হচ্ছে : ওসমানীনগর উপজেলার ব্রাহ্মণগ্রাম, এওলাতৈল, নিজ-করনসি পূর্বপাড়া, মাঝপাড়া, গজিয়া, মোতিয়ারগাঁও, বঢ়ই শিবপুর, খসোরতৈল, চাতোলপাড়া, জয়পুর, কামারগাঁও, ইছুরপুর সাববাড়ি, মাটিয়াল আওলি, বেড়ায়ায় এবং কুনাপাড়া। এসব গ্রামের ‘পাক পাঞ্জাতন মোকাম’ প্রাঙ্গণে কারবালার মর্মান্তিক ঘটনার স্মরণে মহররম মাসের প্রথম দিন থেকে জারিগানের আয়োজন করা হয়েছিল। জারিগানের পাশাপাশি কারবালার যুদ্ধবহ পরিবেশ ফুটিয়ে তুলতে একই সঙ্গে লাঠিখেলা ও তরবারি খেলাও হয়েছে। প্রায় সবকটি স্থানে গ্রামীণ মেলাও বসেছিল। ঐতিহ্যে রূপ নেওয়া বহুবর্ণিল এ উৎসব প্রত্যক্ষ করতে প্রতিদিন হাজারো মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয়।
এলাকাবাসী জানিয়েছেন, ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে আরবি মহররম মাসের চন্দ্র উদয়ের প্রথম দিন থেকে আশুরা পর্যন্ত টানা ১০ দিন পরিবারের সকল সদস্যদের নিয়ে সম্মিলিতভাবে অংশ নিয়ে মহররমের জারিগান পরিবেশন করা হয়। এ সময় প্রতিটি পাক পাঞ্জাতন মোকামে জমা হয় বিভিন্ন গ্রামের ভক্তপ্রাণ মুসলমানদের মানত শোধ উপলক্ষে নির্মিত বেশকিছু তাজিয়া, ঘোড়া ও নিশান। এ সময়ের মধ্যে প্রায় সবাই রোজা রাখার পাশাপাশি রাতের বেলা নিরামিষ-ভাত আহার করেন এবং খালি পায়ে চলাফেরা করেন। পাশাপাশি তাজিয়া মিছিলও অনুষ্ঠিত হয়।
জারিগানে অংশ নেওয়া বয়াতি ও দোহারেরা জানান, জারিগানের লিখিত পদগুলোতে হাসান-হোসেনের বীরত্ব, জয়নবের বিলাপ, ইয়াজিদবাহিনীর চরম ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের পাশাপাশি সে-সময় কারবালার ঘটে-যাওয়া নানা নিষ্ঠুরতার বর্ণনা থাকে। ওই সময়ের মধ্যে প্রত্যেকটি স্থানে পৃথকভাবে বিভিন্নজনের লেখা প্রায় চারশ জারিগান পরিবেশিত হয়।
ব্রাহ্মণগ্রাম গ্রামের শত বছরের প্রবীণ ব্যক্তি পির ওয়াছিদ আলী জানান, তাঁর লেখা প্রায় পাঁচ শতাধিক জারিগান রয়েছে। সেগুলো মহররম মাসে বিভিন্ন পাক পাঞ্জাতন মোকামে বয়াতি ও দোহারেরা গেয়ে থাকেন। জায়ফরপুর গ্রামের বয়াতি সুহেল মিয়া (২৭) বলেন, ‘টানা তিন বছর ধরে জারিগানের পুথি পড়ে আসছি। প্রতিবছরই ঘটনার মর্মস্পর্শী বিবরণ পড়তে গিয়ে আবেগাক্রান্ত হয়েছি। এত নিষ্ঠুরতার বর্ণণা পঠনকালে প্রতিবারই কণ্ঠ রুদ্ধ হতে থাকে। কারবালা প্রান্তরে ত্যাগের যে মহিমা হজরত হোসাইন আমাদের দিয়ে গেছেন, তা অনুসরণযোগ্য।’
সাইমন জাকারিয়া সিলেট অঞ্চলের মহররম প্রত্যক্ষ করে আমাকে সেদিন বলেছিলেন, ‘সিলেট অঞ্চলের জারিগানের বেশকিছু স্বতন্ত্র চরিত্র লক্ষ করেছি। এই অঞ্চলের পাক পাঞ্জাতনের মোকামে নারী-পুরুষের সম্মিলিত অংশগ্রহণে জারিগান পরিবেশিত হয়েছে। এছাড়া সিলেট ব্যতীত অন্যান্য অঞ্চলে জারিগানের আসরে সরাসরি হাতে লেখা ও মুদ্রিত পুথি ব্যবহৃত হতে দেখিনি। সিলেটে এসে জারিগানের আসরে সরাসরি লিখিত সাহিত্যের ব্যবহার দেখে বিস্মিত ও মুগ্ধ হয়েছি।’
তিনি আরও বলেছিলেন, ‘ঢাকার হোসেনী দালান, মানিকগঞ্জের গড়পাড়ার ইমামবাড়া ও কিশোরগঞ্জের আটপাড়ার কথা বাংলাদেশের অধিকাংশ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের জানা থাকলেও বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের আশুরার বর্ণিল অনুষ্ঠানের কথা অনেকেরই জানার বাইরে রয়ে গেছে। জারিগানের আসরে বাংলাদেশের অন্য কোথাও নারীরা অংশগ্রহণ করে কি না, তা আমাদের জানা ছিল না। সিলেটে এসে দেখছি পুরুষ শিল্পীদের জারিগান পরিবেশনার পাশাপাশি স্বতন্ত্রভাবে নারীশিল্পীদের দ্বারা জারিগান পরিবেশিত হচ্ছে।’
সারারাত এওলাতৈল গ্রামে দুজনে মিলে জারিগান দেখে ভোররাতে মাটিতে বিছানা পেতে একটু ঘুমিয়ে নিই। ঘণ্টাখানেক পর যখন দাঁড়কাক আর মোরগ নিজেদের ভাষায় শব্দ করে সকাল হওয়ার জানান দিচ্ছিল, তখন আমরা উঠে হাতমুখ ধুয়ে নিই। এরপর রওয়ানা দিই পাশের আরেকটি গ্রামে জারিগানের খোঁজে। আমরা খেতের আঁকাবাঁকা আলপথ দিয়ে সকালের শিশির মাড়িয়ে সামনে এগোচ্ছিলাম। কানে অবিরত ভাসছে – ‘হায় হোসাইন, হায় হোসাইন…।’
… …
- রবীন্দ্রনাথের দুটি গান : ব্যক্তিগত পাঠ || সুমনকুমার দাশ - May 8, 2020
- লোককবি গিয়াস : কয়েকটি স্মৃতিটুকরো || সুমনকুমার দাশ - January 23, 2020
- কোকা পণ্ডিত ও তাঁর ‘বৃহৎ ইন্দ্রজাল’ || সুমনকুমার দাশ - January 8, 2020
COMMENTS