আগম্যস্ব কথা || সজলকান্তি সরকার

আগম্যস্ব কথা || সজলকান্তি সরকার

হাওরের ‘হা’-করা মুখটা যে-পরিমাণ গিলে খায়, তার চেয়ে অধিক ‘অক্লায়’। তার মানে — হাওরের প্রাণ আছে এমন কথা আমি বলছি না, তবে হাওর ‘প্রাণদাতা’। তারে প্রাণেশ্বর বলা যায়। নিরাকার ঈশ্বরের সমতুল্য না-হলেও জাত-পাত, পাপ-পুণ্য, স্বর্গ-নরক লইয়া তার অদৃশ্য খেলা নাই। তার খেলা ফুটবলের মতো স্পষ্ট। তার নাই কোনো উজির, নাজির কিংবা কট্টুয়াল। সে উপরে বসে অদৃশ্য সংবিধানে জগৎ শাসন করে না। মাটির সাথে তার মিতালি। তাই অদৃশ্য স্রষ্টার চেয়ে দৃশ্যমান হাওরই আমার গুরু।

তবে হাওরের ভাবের কোনো অন্ত নাই। সারাক্ষণ লীলা খেলে। ক্ষণে কাঁদায়, ক্ষণে হাসায়। বড়ো বৈচিত্র্যময় তার স্বভাব। যে সঙ্গ পায়, সে টের পায়। মৃত্যুর মতো আপন করে কাছে টানে। স্বভাব বদলানোর কারিগর। হাওরের ‘বাউর‍্যা’ স্বভাব কিংবা ‘মরমিভাব’ মাইনষের ভিতরে কেম্নে ঢুকলো তা জানতে হইলে বিদ্বান হওয়ার চেয়ে তার দীক্ষা নিয়া ‘হাওইর‍্যা’ হওয়া জরুরি।

আমার পরম সৌভাগ্য, জন্ম আমার হাওরের আঁতুড়ঘরে। তাই বাঁচার লড়াইয়ে তাবিজ-কবজের অজুহাত দিয়েই নিজেকে ঠিকে থাকতে হয়েছে। যেখানে বাঁচা-বাড়ার একমাত্র অবলম্বন ছিল মায়ের দুধের ‘কোল’ আর ‘বুল’। সাপ-কেঁচোর লেজ মাড়িয়ে হাঁটতে শিখিয়েছে বাবার আঙুল। অতিদূর্গম জনবিচ্ছিন্ন জলারণ্য ছিল আমার জন্মমেদিনী। তাই প্রকৃতিপাঠে উত্তীর্ণ হতে পারাটাও ছিল বেঁচে থাকা। ফলে ‘নানাইয়া-বিনাইয়া’ রস-কষ লাগাইয়া লেখার মতো বাল্যশিক্ষা আক্কল থাকলেও তথাকথিত পুঁথিয়া-বিদ্যা আমার নেই। তবুও লিখি; কারণ, জন্মের পর থেকে বিয়ানের জলখাবারের মতো সহজ গ্রাসে ঘরে-বাইরে পাতে-পাতে গিলে খাওয়া ‘ভাত’-এর দায়গুলো যখন গলায় ‘মান্দার’-এর কাঁটার মতো লেগে থাকে তখন ছাই দিয়ে দাঁত মাজার এই ফড়িং ধরা আনাড়ি আঙুলেই কলম ধরতে বাধ্য হই। আর তখনই গেঁয়ো মগজের ভিতরে শুরু হয় নানা ‘হাওইর‍্যা ক্যাচাল’!

উঠান কেটে ঘরের ‘ভিটা’ কিংবা কুঠিরের ভিতর ‘দালান’ নির্মাণ বা ‘কুপিবাত্তি’-এর আলোতে ‘হ্যাজাক’ জ্বালানো অথবা ‘পাঁজিপুথি’ থেকে ‘মহাগ্রন্থ’’ লিখার প্রবণতা আমার নেই। সাহিত্যের মগডাল ‘আঙটাকুটা’ দিয়ে নিচে টেনে এনে ডাল ভেঙে তার পাকনা ‘গুলটুম’ ফল খাওয়াও আমার মজা লাগে না। বরং মাটিতে এলে পড়া গাছের নিচু ডালগুলো ‘ডিক্কা’ দিয়ে তাকে ফলবতী হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া আমার ‘কামলাগিরি’। মূলত ‘কামলা’-গৃহে ‘কামলা’ হতে ‘মুঞ্চায়’ না। গিরস্তবাড়িতে পেটে-ভাতে জাঙালে মাটি কাটতেই মজা লাগে। কথায় আছে না, ‘চাছা চটি চাছ্যিঅ না, আনা-চাছা চটি চাছ্অ।’

লিখতে গেলেই শিখার অভাব বোধ করি। অকলম-বকলমে কাউয়ার-ঠ্যাং বগার-ঠ্যাং লিখেই তখন ভাবনাগুলো প্রকাশ করি। কিন্তু যতই লিখি না কেন, নাইকাম ছাড়া কামের-কাম কিছুই হয় না — এই অভাব এখনও আমাকে ‘তাউড়ায়’। কারণ চ্যাংড়া বয়সে বাড়ির উঠানে গামছায় মাছ ধরে ‘ছোটোগাঙ-বড়োগাঙ’ কইতে-কইতে খেলন্তি খেইল-খেলা ‘গাবড়’ মাথায় তো আর ‘গঙ্গা-যমুনা’ আসে না।

শুধু তা-ই নয়, ‘ডাঙর’ হয়েও তো বাড়ির পুবের এই মনাই নদীকেই এক ঈশ্বরের মতো জানতাম। নদী বলতেই তো দেখেছি কেবল মনাই! বলতে পারেন এ আমার ‘দেউড়ি’-দেওয়া জীবনের অল্পতা। তারপর একদিন শহর থেকে আয়েশে কিনে আনা পদ্মার ইলিশ খাইয়া জানতে পারলাম — পদ্মাও আরেকটি নগরের নদীর নাম।

পাঠশালায় ‘মাস্টরমশাই’ বইয়ের পাতায় শিখালেন বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। তিনি বলতেন — মানুষের যেমন মা আছে, তেমনি আমাদের দেশেরও মা আছে। আর সে হচ্ছে নদী। আমার যৌবনে যখন হৃদয়ে প্রেম আসে, সুর আসে, তখন বুঝলাম নদী মানে প্রেম। বাবা বলতেন, নদী মানে কৃষিপ্রাণবৈচিত্র্য রক্ষার শক্তি। আর মা বলতেন, সে তো সাক্ষাৎ জগদ্ধাত্রী।

এখানেই শেষ নয়! একদিন মনাই নদীর কূল ছেড়ে বিদ্বান হতে যখন আতারে-ফাতারে ঘুরে কিছু অসভ্যতা দেখলাম, তখন বুঝলাম নদী মানে সভ্যতা। আর তখনই মনে হয়েছে — জীবন আমার সার্থক হলো বুঝি, জনম আমার ভাটির দেশে মনাই নদীর কূলে। হাওরের এই মনাই নদীর জলেই তো আমার আঁতুড়ঘরের জন্মজঞ্জাল ফেলে আমি শুচিত হয়েছি।

মূলত ভাটির ময়ালেই কেটেছে আমার চ্যাংড়া ও ডাঙর কাল। বিশাল জলাশয়, তাল-মাতাল কিংবা চানকপালী ঢেউ, তালনিরাই জলের নীরবতা, শীত-বসন্তের দিগন্তমাঠ, চৈতের তাপদাহ, ঘাস-জড়ানো আঁকাবাঁকা মেঠোপথ, কুয়াশা-ভেজা সবুজ, বিরাট আসমান, হাঞ্জা-হতা কাউয়া-কুলির কলরব, গিরস্তালি কাম, কাদামাটির গন্ধ, তমালগুটি আর কুত্কুত্ খেলার উঠান, ঠাম্মা-কর্তার কিচ্ছা, গলা ভরা গান ও অপুঁথিয়া গানের সুরই আমার বেড়ে-ওঠার মেদিনী।

মূলত জীবনঘনিষ্ঠ এসব নানা অনন্ত জিজ্ঞাসা থেকেই এই ‘গ্রন্থ’ রচনার প্রয়াস। যেখানে পুঁথিহীন অ-বিদ্বান জ্ঞানীদের তথ্য-কথার সহযোগিতা নিয়ে মলাটবন্দি হয়েছে ‘হাওরের কথকতা-২’। বইটির প্রকাশনায় ও শৈল্পিক রূপকারের ভূমিকায় কাণ্ডারি হয়েছে ‘গাঙুড়’। আর পাঠক তার বিচারক।

সজলকান্তি সরকার রচনারাশি


সজলকান্তি সরকার
নগদাপাড়া, মধ্যনগর, সুনামগঞ্জ
মোবাইল : ০১৭১৬৮২৬১৩০

COMMENTS

error: