পথের পাঁচালী : চলচ্চিত্রের প্রথম পাঠ || সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়

পথের পাঁচালী : চলচ্চিত্রের প্রথম পাঠ || সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়

২৪ মার্চই বলি। যদিও রাত এখন একটা। এই নিয়ে ন’-বার ‘পথের পাঁচালী’ দেখা হলো। ১৯৫৫-য় সেই প্রথম চোটেই তিনবার। দু’-বার টিভি। আরো দু’-বার টিভিতেই, ভিসিআর-এ। মাঝে দু’-বার বড় স্ক্রিনে। মাত্র নয়বার! ঠিক তাই। আমার বন্ধু দিল্লির অমিতাভ ভট্টাচার্য খুব অব্যর্থভাবে গুনতে গুনতে আঙুলের সব কড়গুলি ফুরিয়ে যাবার পর লাজুকভাবে দু’-হাতের আঙুলগুলো নাড়াতে থাকে কিছুক্ষণ। যেন অ্যাডাল্টরি কনফেস করছে। অর্থাৎ, অসংখ্যবার। সে তখন ছিল মুসৌরিতে। আর তার নিজের ভিসিআর আছে।

মনে পড়ে ১৯৫৫। বীণা সিনেমায় দ্বিতীয় দিনে ‘পথের পাঁচালী’ দেখে আসি ম্যাটিনি শো-তে। একা? না, ঠিক একা নয়। সঙ্গে ছিলেন আরো শ’-খানেক দর্শক। মেরে-কেটে। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনতলার ইংরেজির ঘরে আমাকে একটি ক্লাস নিতে আমি দেখি। জনা পাঁচেক ছাত্রছাত্রী। আমার বক্তৃতার বিষয় ছিল : বিস্ময়। ‘পথের পাঁচালী’ ছিল না।

সেদিনই কলেজ স্ট্রিট কফি হাউস। পূর্ণেন্দু পত্রী, সুধাংশুদা (পদবি?), দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিমল ভৌমিক, মিহির সেন, যুগান্তর চক্রবর্তী, অসীম সোম — এরা সব। শনিবারের জমজমাট আড্ডা। পূর্ণেন্দু প্রথম দিনেই দেখেছে। এবং পূর্ণেন্দুর কথা একটাই। সুবীর (হাজরা), তুই সত্যজিতের কাছে নিয়ে চল আমাকে। শুধু একটা প্রণাম করব। গড় হয়ে। কথা দিচ্ছি, আমি একটা কথাও বলব না।

দু-একদিনের মধ্যে ‘পথের পাঁচালী’ দেখে ফেলল সবাই। ঠিক হলো আমরা একটা রিসেপশন দেবো এর স্রষ্টাকে। এবং সেটা দিতে হবে সেনেট হলে। ভাইস চ্যান্সেলার এই নির্মল সিদ্ধান্তের কথা শুনে আক্কেল গুড়ুম। ফিল্ম ডিরেক্টর? সেনেটে? এখানে তো সংবর্ধনা পায় ইতিহাসের লোকজন।

পরিচালকের বংশপরিচয় জেনে তিনি কিছুটা আগ্রহী হলেন। তা, হিরো-হিরোইন — এরা সব কারা? হিরো স্যার? হিরো তো অপু। আর হিরোইন আপনার দুর্গা। জানেন তো আপনি। এছাড়া, কানু ব্যানার্জি, তুলসী চক্রবর্তী আর ইন্দিরা ঠাকরুন চুনীবালা দেবী। নব্বই বছর। ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিনিধি হিশেবে ডেপুটেশনে ছিল ধৃতীন চক্রবর্তী। ধৃতীন আমাকে বলল, ‘করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যাপারটা চেপে যাও।’ অবশ্য আমি বলতামও না। তাঁর বয়সটা নিঃসন্দেহে সন্দেহের ঊর্ধ্বে ছিল না। শ্রদ্ধেয় ভিসিকে ছোট করে দেখানো আমার উদ্দেশ্যও নয়। তখনো তো হালচাল এমনটাই ছিল। ‘অপরাজিত’ ভেনিসে পুরস্কার পেলে ইডেনের সংবর্ধনাসভায় দেবকী বসু বলেছিলেন, ‘এতদিন আমরা ছিলাম কুলাঙ্গার। আর আজ আমাদেরই একজন হলো কুলতিলক।’

শেষপর্যন্ত সেনেট হলে সংবর্ধনা হয়েছিল। এবং তৃতীয় ও শেষ সপ্তাহেই। বীণাতে জেমিনির ‘ইনসানিয়াত’ আসতে তখনো দু’-দিন বাকি। সেনেটের সিঁড়িশ্রেণির নিচে ফুটপাথের ওপর পূর্ণেন্দুর আঁকা আল্পনা। একপশলা বৃষ্টি এসে ধুয়ে দিয়ে গেল। পূর্ণেন্দু ফের আঁকল। আমি ছাতা ধরে দাঁড়াই। সেদিন সন্ধ্যায় থরোথরো আবেগে তার সেদিনের সেই স্বরচিত মানপত্র, না তো, মন্ত্রপাঠ ভোলার নয়। রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশে শরৎচন্দ্রের ‘তোমার দিকে চাহিয়া’-র চেয়ে ভালো হচ্ছে, শুনেই বোঝা যাচ্ছিল। ইউনিভার্সিটিতে একটি পোস্টার আর কাগজে তিনলাইন। ছাত্রছাত্রীরা ঝেঁটিয়ে এসেছিল। সেনেট আধাআধি ভরতি হয়ে গিয়েছিল। এসেছিলেন দেবকীকুমার বসু। হিরণ সান্যাল ও গোপাল হালদার এসেছিলেন।

একটি অসামান্য সুভেনিয়ের ওইদিন প্রকাশ করা হয়। কপি অংশ তৈরি করি আমি আর অসীম সোম। সে-পর্যন্ত প্রকাশিত সমালোচনা থেকে উচ্ছ্বসিত উদ্ধৃতি তাতে ছিল। ভিসুয়াল অংশ বলাবাহুল্য পূর্ণেন্দু পত্রীর। সুভেনিয়েরটির অসামান্যতা শুধু তার কারণেই। পুস্তিকাটিতে সে-ই ছাপিয়েছিল ‘পথের পাঁচালী’-র সেই অবিস্মরণীয় পোস্টারটি, যেখানে সর্বজয়া দুর্গার চুল আঁচড়ে দিচ্ছেন, পাশে অপু। ক্যাপশন ছিল : সত্যজিৎ রায়ের শিল্পপ্রতিভার আর-এক নিদর্শন। বলাবাহুল্য, ‘পথের পাঁচালী’-র শাদাকালো ব্যানার, পোস্টার, এসব, ছবির মতোই, আজও অনতিক্রমণীয়ভাবে শ্রেষ্ঠ। কিন্তু সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয় সেই প্রথম। সুভেনিয়েরটি আজও যদি কারও কাছে থেকে গিয়ে থাকে, দেখবেন, ওখানে মুদ্রক ছাড়া কারো নাম নেই। আমাদের তরুণ সাম্যবাদী যূথচেতনা তখন এত প্রবল যে প্রস্তুতকর্তাদের কারো নামই সেখানে ছিল না। এখন তাই বলা যেতে পারে যে সবচেয়ে দামি কার্টিজে নবাগত লাইনো হরফে ছাপা ব্যয়বহুল পুস্তিকাটির প্রকাশক ছিল সুরকার ও চলচ্চিত্রপ্রযোজক বীরেশ্বর সরকার।

‘পথের পাঁচালী’ নিয়ে আমাদের আবেগের জের আরো অনেকদিন চলেছিল। সে-বছরই পুজোসংখ্যা ‘সাঁকো’-তে ‘পথের পাঁচালী’-র সত্যজিৎকৃত অনেকগুলি ফ্রেমের ছবি সহ স্ক্রিপ্টের অংশ ছাপা হয়। সত্যজিৎ এমনকী একটি সসংকোচ ভূমিকাও লিখে দেন। পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন অসীম ঘোষ, প্রশান্ত গায়েন এবং আমি।

নবমতমবার দূরদর্শনে ‘পথের পাঁচালী’ দেখে এইসব কথা মনে পড়ল। এর প্রয়োজন ছিল কি না জানি না। ঝড় উঠলে গাছের পাতারা উড়ে আসে। এরা ঘরে ঢোকে। এরা কেন আসে তা আমি জানি না।

আর … আবার ‘পথের পাঁচালী’ দেখে কেমন লাগল সে-ব্যাপারে আমি চুপচাপ থাকাই শ্রেয় বিবেচনা করলাম। আজ ৩৭ বছর ধরে ‘পথের পাঁচালী’ চলচ্চিত্রের প্রথম পাঠ। এখন মায়ের কাছে মাসীর গপ্পো আর না করাই ভালো। নয় কী?

  • পুনর্মুদ্রণসূত্র : চলচ্চিত্র চঞ্চরী, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, প্রতিক্ষণ পাবলিকেশনস্ ১৯৯৫, কলকাতা

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you