রবীন্দ্রবীক্ষায় স্নাত তিনি; মানবচর্চার শুদ্ধ ও প্রাকৃতিক জ্ঞানের অনুসারী। ‘ছায়ানট’ একটা প্রদীপ। ‘ছায়ানট’ মূলত একটা মানবিক, সারলিক বিদ্যালয়। বাঙালি সংস্কৃতির লড়াকু সৈনিক তিনি। মৌলবাদের অহঙ্কার, অন্ধত্ব ও অচলায়তন ভেঙে রমনার বটমূলে গেড়ে দিয়েছেন বাঙালির চিরায়ত সহজাত সংস্কৃতি; মিল ও মেলার ঐকতান। উনার রবীন্দ্রচর্চা শুধু রবীন্দ্রনাথের অন্ধ অনুকরণ নয়; নয় প্রফেসরদের ঐকতানধর্মী প্রবন্ধ লেখার পরিসর। যে-জ্ঞানটা তিনি শান্তিনিকেতনে অর্জন করেছেন, সেটা সময় ও বাংলাদেশের আলোতে ছড়িয়ে দিয়েছেন। ১৯৬৭ সালে পাকিস্তানবাদীদের বিরুদ্ধে যে-আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তা শেষ হয়ে যায়নি। বাংলোদেশে জন্ম নিচ্ছে নিত্যনতুন পাকিস্তানি চ্যালা, বোধ ও সংকীর্তন। সেই বিরুদ্ধবাদী শনির বিরুদ্ধে একটা প্রজন্ম নির্মাণ করছেন তিনি। ‘ছায়ানট’ কিংবা ‘নালন্দা’ সেই ধীমান পাঠশালার রক্তবীজ।
মানুষের চিন্তাই মানুষের প্রতিভা। আপন চিন্তায় স্থির না থাকলে জীবনের লক্ষ্য ও প্রকৃতি নির্ধারণ করা যায় না। লোকলজ্জা ও পরচর্চার অসুস্থ পৃথিবীতে অনেকেই হারিয়ে যায়। চিন্তা ধরে রাখার অটল ও অবিচল ব্যক্তিত্ব সবার থাকে না। সময় ও প্রজন্মের দায় কাঁধে নিয়ে সবাই লড়াই করতে জানেন না। শিক্ষা ও শিক্ষকতার দায়ে পুরো জীবনটাই উৎসর্গ করেছেন তিনি। খ্যাতি ও প্রশংসার পৃথিবী নয়, তাঁর পৃথিবী দায় ও দার্শনিকতার। রাষ্ট্রের ভেতরেও দাপুটে ব্যক্তিদের একটা রাষ্ট্র থাকে। প্রত্যক্ষে কিংবা পরোক্ষে ওরা রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে। রাষ্ট্রের দৃষ্টি ও দর্শনকে গিলে খেতে থাকে। সন্জীদা খাতুনের মতো মহৎ শিক্ষকেরা রাষ্ট্রের এই খামোশ ব্যক্তিত্বদের বিরুদ্ধে লড়াই করেন। চেয়ারের ঐশ্বর্য ও অলঙ্কারে এঁরা বসে থাকতে চান না। এঁদের হৃদয় আযানের ধ্বনির মতো পবিত্র। পবিত্র মনে এঁরা সময় ও মানুষকে প্রকৃত সত্যের ছায়াতনে ডাকতে থাকেন। সময়ের শিক্ষক হয়ে একজন সন্জীদা খাতুন মানুষ ও মানবিকতার ছায়াতন নির্মাণ করে যাচ্ছেন। কালের ধুলায় লুটায় মানুষের অমরত্ব। কিন্তু শিক্ষক ও কর্মীমানুষের মন অমরত্বের নায়ে না-চড়ে সময়ের কাজটা করে যেতে চান।
খাঁটি মানবিক পৃথিবী নির্মাণে এখনও নিমগ্ন ও সচল তিনি। বক্তৃতাবাজির উর্ধ্বে তিনি কাজে বিশ্বাস করেন। তিনি বিশ্বাস করেন, সংস্কৃতি একটা শক্তি। এই শক্তিতেই শক্তিমান হয় একটা সমাজ। সংস্কৃতিচর্চাটা একটা রিলে দৌড়ের মতো। সবাই মিলে একসাথে এই পথে হাঁটতে হয়। একা একা গুহাবাসী থেকে মানুষের কাজ করা যায় না। তাই সংগঠন লাগে। প্রাকৃত জীবন ও বাঙালিত্বের বন্ধনে, সুর ও নান্দনিকতায় ছায়ানট এবং নালন্দা মানবিকতার সেই সংগঠন; নতুন দিনের মুক্তধারা।
আধুনিক বাংলাদেশ এবং মানবিকতার সাধনায় একটা অবিচল পথেই হেঁটেছেন এবং হাঁটছেন তিনি। চৈতন্যের গহন দরোজা খুলে মানুষকে ভালোবাসার অকৃত্রিম সুর শুনিয়ে যাচ্ছেন। ৮৭ বছর বয়স্ক একটা বৃক্ষের অনেক ছায়া। সে-ছায়ায় অনুজ অনুগামীরা শান্তি নিয়ে বসে বৃক্ষের কথাই বলে। প্রতিটা জীবনেরই যুদ্ধ থাকে। জন্মদিন সেই যুদ্ধটাকে মনে করিয়ে দেয়। জন্মদিন মানে রিডিংরুমের জানালাটাকে নতুন করে পাওয়া। নিজের জীবনটাকে ধন্য করার কিছু নেই। পরার্থপরতাতেই সন্জীদা খাতুনের অভিযাত্রা।
‘বাংলাদেশের হৃদয় হতে’ নামে একটি অসাধারণ পত্রিকা তিনি সম্পাদনা করছেন। একবার এই পত্রিকায় ‘জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর কবিতা’ শিরোনামে আমার একটি গদ্য ছাপা হয়েছিল। সম্পাদনা পষর্দের সদস্য শ্রদ্ধেয় অনুভাই-ই আমাকে দিয়ে গদ্যটি লিখিয়েছিলেন। লেখাটায় আমি কোনো রেফারেন্স কিংবা টীকা ছাড়াই জমা দিয়েছিলাম। কিন্তু লেখাটা ছাপার আগে অনুভাই কয়েকবার আমাকে ফোন করে লেখাটার রেফারেন্স চাইছিলেন। বলছিলেন, ছাপা হওয়ার আগে আপা প্রত্যেকটা লেখা পড়ে দেখেন। যেহেতু এটা গবেষণাধর্মী পত্রিকা — তাই রেফারেন্স ছাড়া কোনো লেখাই ছাপা হবে না। লেখার ব্যাপারে আপা নিখুঁত ও খুঁতখুঁতে।
অনেকদিন বন্ধ আছে বাংলাদেশের হৃদয় হতে পত্রিকাটি। সাতাশি বছর বয়স্ক একজন বৃক্ষ এই পত্রিকাটিকে আবার ছায়া দিবেন। আপার মতো নিখুঁত ও খুঁতখুঁতে সম্পাদক এই পত্রিকাটিকে আবারো ছায়া দিবেন — এটাই প্রত্যাশা। শুভ জন্মদিন আপা!
পুনশ্চ : প্রিয় অনুভাই, আমার জানালার পাশে টগর ও গন্ধরাজ। জানি, সাদা ফুলের ঘ্রাণ আপনি পছন্দ করেন। সাদা ফুলের সাথে এই লেখাটার ঘ্রাণও যেন আপনার কবরে পৌঁছায়।
… …
- ভরা চান্নির উপত্যকায় কাব্য ও কথকতা || সরোজ মোস্তফা - October 30, 2024
- নূরুল হকের দুটো অপ্রকাশিত কবিতা || সংগ্রহ ও ভূমিকা : সরোজ মোস্তফা - July 28, 2021
- মুক্তস্বরের মানুষ || সরোজ মোস্তফা - April 20, 2021
COMMENTS