সিআরবি শিরিষতলা : একটি খোলা চিঠি || কুমার প্রীতীশ বল

সিআরবি শিরিষতলা : একটি খোলা চিঠি || কুমার প্রীতীশ বল

প্রিয় বীরপ্রসবিনী চট্টলা,
তোমারই এক তরুণ তুর্কী আবৃত্তিকর্মী অনুজ প্রণব চৌধুরীর বিনীত নিবেদন, আকূল আহাজারি, সকরুণ আর্জি, যে যার অবস্থান থেকে যেন সবাই সবর থাকি। বেহাত হতে চলেছে সিআরবির শিরিষতলা, যা ছিল বাকি, আর সব গেছে বেনো জলে ভাসি — শুধাতে কি পারো আজ একুশ শতকে আসি? — আজি হতে শতবর্ষ আগে রেলওয়ের সেই উন্মত্ত প্রাঙ্গণে কে করল রোপন সিরিষের চারা থরে থরে? এক-দুই নয়, শয়ে শয়ে, সারি সারি। কি ছিল উদ্দেশ্য তাঁর? কে রাখল নাম সিরিষতলা?

প্রিয় চট্টলা, ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল ইংরেজ গোরাদের রেলওয়ে আম্মারি আক্রমণের আগে বীরপুত্র লোকনাথ বল সদলবলে সহযোদ্ধা অনন্ত সিং, গনেশ ঘোষের এই নির্জন প্রান্তরে শেষ সাক্ষাৎ করেছিল। তখন ছিল গোধূলি লগ্ন, সূর্য পশ্চিমাকাশে অস্তমিত হয়েছিল। মনে কি পড়ে না? মনে কি পড়ে না? অদূরে সূর্যসমরের বীরকন্যা প্রীতিলতা ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করে সফল হয়েও ইংরেজ গোরাদের হাতে ধৃত হয়ে নির্যাতিতা না হওয়ার শপথে আত্মাহুতি দেন। এসব ঘটনা কি অতীব জরুরি ছিল না বলা?

প্রিয় চট্টলা, মনে কি পড়ে না? মনে কি পড়ে না? ১৯৭১ সালে চাকসুর জিএস আবদুর রব কানুনগোপাড়ায় প্রিয় শিক্ষক সমাজবিজ্ঞানী অনুপম সেনের সঙ্গে শেষ সাক্ষাৎ করে মাতৃমুক্তি পণে বেরিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে শহিদ হন তাঁর প্রিয় সিআরবির শিরিষতলায়। কি ছিল তাঁর মনে এখানে এসে প্রাণ দিল অবশেষে! জানা হলো না যা ছিল কথা না-বলা।

প্রিয় চট্টলা, শতবর্ষের প্রথম পঞ্চাশ কাটলো পরাধীনতার শেকল পরে। পরের পঞ্চাশে এসে দেখলাম, নাগরিকজনের সংস্কৃতিচর্চার এক অভয়ারণ্য হয়ে গেল তাঁদের প্রিয় সিআরবির শিরিষতলা। নববর্ষে, পহেলা ফাল্গুনে, রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তীতে নাগরিক মানুষের পদভারে গমগম করে। নাগরিক জনতার সকালে অথবা দুপুরে স্কুলপালানো তরুণ-তরুণী কিংবা শীতের বিকালে কপোত-কপোতির জন্য আর কি কোথাও রেখেছ ফুরসত দু-দণ্ড নীরবে মুখোমুখি বসিবার? নাগরিক জনতার শতবর্ষী এই প্রিয় শিরিষতলা কত-না সাক্ষী প্রণয়-বিরহ-ভালোবাসাবাসির। যদি জীবনসায়াহ্নে আরেকবারের জন্য ফিরে আসে ওরা এখানে এখন, এর কি কোনো স্মৃতিচিহ্ন খুঁজে পাবে সেসব যুগলবন্দী কিংবা পাতাকুড়ানিয়ার দল? ভালোবাসা কোথায় ভালোবাসা জানাবার! পরীর পাহাড়, চেরাগী পাহাড়, বাটালি হিল, টাইগারপাস, সার্কিট হাউজের সামনের সবুজ উদ্যান, ফয়েজ লেক, জামবুরি মাঠ, লালদিঘী ইত্যাদি ইত্যাদি কিছুই তো অবশেষ থাকলো না আর। এনাফ ইজ এনাফ। কম তো হলো না আর ছলাকলা! উন্নয়ন উন্নয়ন খেলাধুলা!!

প্রিয় চট্টলা, শহিদ মিনার নিয়েও কী-সব হচ্ছে কানাঘুষা! প্রবর্তক পাহাড় নিয়ে কাড়াকাড়ি হচ্ছে। বিবৃতি, পাল্টা বিবৃতি, হামলা, মামলা চলছে। কী আশ্চর্য সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য সবই কি চলে যাবে বাণিজ্যের কবলে! যেদিকে তাকাই শুধু টাওয়ার আর টাওয়ার। সবুজ অরণ্য নেই। পাহাড়-নদীঘেরা চট্টগ্রাম কোথায়? চাটগাঁর অর্ধেক মাটির মালিক নাকি বন্দর আর রেলওয়ে। কেন তাহলে হাসপাতাল কিংবা যা-কিছু গড়তে হবে তা নাগরিক জনতার প্রিয় ঐ শিরিষতলায়? কেন নয় অন্য কোথা? রেলওয়ের নিজের যে হাসপাতাল রয়েছে, তার কি অবস্থা জানার সুযোগ কি আছে? যদি এতই দরদ নাগরিক মানুষের লাগি, তবে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপে সেই হাসপাতালটিকে দিয়ে দিতে কেন নারাজি? দুষ্টুরা বলে শুনি, হাসপাতালের ঔষুধ বেচা, খাবার বেচা থেকে আয় আসে। আসে মাসে-মাসে ইনকাম। পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ হাসপাতাল দেবে ‘এককালীন পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ পেনশান’। সত্যি সেলুকাস! কী বিচিত্র!! আছে নাকি টাকার আদান-প্রদান? কালো টাকা সাদা করার কারবার? পর্দার আড়ালে কে নাড়ে কড়া, কে করে বাতাস আওলা-ঝাউলা!

প্রিয় চট্টলা, হাসপাতালে সিডিএ সাফ না-রাজি। নগর পরিকল্পনাবিদেরা না-রাজি। সংস্কৃতিজন, নাগরিক সমাজ বিক্ষুব্ধ। তারাও না-রাজি। আজাদীর ভাষ্য, কোনো এক নেতা নাকি নিমরাজি!! কে নেবে কৈফিয়ত? ফরিয়াদ জানাবে কোথায় নাগরিক জনতার প্রিয় সিআরবির শিরিষতলা?

প্রিয় চট্টলা, মনে কি পড়ে না, সুচরিত চৌধুরীর লালদিঘী  গল্পে আছে লালদিঘীকে বাঁচাতে ‘দিগভোলা প্রান্তরে গর্জে উঠলো এক উদাত্ত কণ্ঠস্বর, ভাইসব এখনো কি তোমরা বুকের ব্যথা নিয়ে ঘুমিয়ে থাকবে? মুখ কি তোমাদের কথা বলতে শেখায়নি? তোমাদের শ্রম নিয়ে গড়ে উঠেছে সভ্যতা আর তোমরা এখনো ডুবে আছো অসভ্য বর্বর যুগের অন্ধকারে। জাগো, জাগাও, জেগে পৃথিবীকে শ্রম দিয়ে প্রেম দিয়ে গড়ে তোলো।’ তেমন করে একটি নয়, দুটি নয়, লক্ষ-অযুত কণ্ঠস্বর আজ সরব, প্রতিবাদমুখর। মুখে মুখে আজ রব, — হাসপাতাল চাই না। আমাদের সিআরবিতেই থাকুক আমাদের প্রিয় শতবর্ষী শিরিষতলা। হাসপাতাল চাই না চট্টলা, বীরপ্রসবিনী চট্টলা!

কুমার প্রীতীশ বল রচনারাশি

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you