সিয়াম সাধনার গোপন কথা ও আমাদের পেটুক ভ্রষ্টাচার || মাকসুদুল হক

সিয়াম সাধনার গোপন কথা ও আমাদের পেটুক ভ্রষ্টাচার || মাকসুদুল হক

“যা জানো না তা স্বীকার করো, তোমার জানা নিয়া তুমি বিনয়ী হও, তুমি আজকে যা জানলে তা ধারণ করো, সবসময় যে সচেষ্ট ও সত্যনিষ্ঠ সে-ই তোমার জন্য শ্রেষ্ঠ।”

রামাদান বা রমজান হচ্ছে ‘সোয়ম’ পালনের মাস, বাংলায় আমরা বলি সিয়াম সাধনার মাস, যখন মাসব্যাপী সংযম রক্ষার ঐশী নির্দেশ রয়েছে। এই মাসে অনেকেই আমরা আহ্নিক মেনে উপবাস করি, খাদ্যগ্রহণ থেকে বিরত থাকি। দীর্ঘ উপোস করার ব্যাপারটা চৌদ্দ ঘণ্টা বা তারও বেশি হয়ে থাকে যেটা নির্ভর করে বিশ্বের কোন গোলার্ধে আপনি বাস করছেন তার ওপর এবং বেশিরভাগ মুসলিমের কাছে এই উপবাস থাকাটাই সিয়াম/সোয়ম হিশেবে গ্রাহ্য।

উপবাস বা ‘রোজা’ পালনের পাশাপাশি সালাত বা নামাজ ও অন্যান্য অনেক উপাসনা-আরাধনার মাধ্যমে আমরা আল্লাহর ‘সন্তুষ্টি’ লাভের চেষ্টা করে থাকি এবং সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ আমাদের উপর করুণা ও কৃপা বর্ষণ করেন বলেই বিশ্বাস করি।

কাজেই, উপবাস করা ছাড়াও রোজার দিনের পালনীয় আচারকৃত্যের তালিকা অনেক দীর্ঘ। ভোরের আগে জেগে উঠে সেহরি, দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায়, কোরান তেলাওয়াত, রাতের বেলায় বিশেষ তারাবি নামাজ এবং অন্যান্য অনেক ইবাদত-বন্দেগি।

এবং এইসবের মাঝখানে একটা আকর্ষণীয় অংশ হচ্ছে সন্ধেবেলা ব্যয়বহুল বিচিত্র খানাপিনার ইফতার যার মধ্য দিয়ে সারাদিনের দীর্ঘ উপবাস আনুষ্ঠানিকভাবে ভাঙা হয় এবং পরবর্তী সেহরির আগ পর্যন্ত অবারিত খানাপিনা চালানো যায়।

এখানে উল্লেখ্য যে বেশিরভাগেরই ধারণা রোজা পালনের মাধ্যমে আমরা আল্লাহকে খুশি করি বা আল্লাহর ‘সন্তুষ্টি’ লাভের চেষ্টা করি, কিন্তু রোজার তাৎপর্যপূর্ণ দিকটা হচ্ছে যে এর মাধ্যমে গরিবের অনাহারজনিত কষ্ট উপলব্ধি করবার এবং এর থেকে হতদরিদ্রের সহায় হবার শিক্ষা অর্জন করা।

যা-ই হোক, উপোস করা বা রোজা পালন ব্যতিক্রমী কিছু নয়, এমনও নয় যে এটা খালি ইসলাম ধর্মেই আছে, একেশ্বরবাদী বিশ্বাসে বলীয়ান প্রায় সমস্ত ধর্মে এই আচারকৃত্য অবশ্যপালনীয় হিশেবে বিভিন্ন ধরনে বিভিন্ন মেয়াদে জারি আছে।

বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে এই কৃত্যাচারটি কেবল কয়েকটি দিনের বা মাসের মেয়াদি জিনিশ নয়, এটা তাদের কাছে অত্যন্ত কঠোর একটি শৃঙ্খলা এবং নানান নিয়মে বছরব্যাপীই প্রায় চালু। বৌদ্ধ ধর্মে সংযমের শিক্ষা অনেক পরিব্যাপ্ত। কয়েক দিন বা কয়েক মাস কেবল নয়, এমনও হয় যে বৌদ্ধ ভিক্ষুগণ মাসের পর মাস দিনের পর দিন তাদের সংযমসাধনা চালিয়ে যাচ্ছেন এবং আহার ও অন্য সমস্ত জাগতিক আয়েশ-বিলাস পরিহার করে চলছেন, শুধুমাত্র পানি খেয়ে বেঁচে থাকছেন দিনের পর দিন এমন বৌদ্ধ ভিক্ষুগণের উদাহরণ আমরা জানি।

বিশ্বাস করা হয় যে উপবাস তথা পানাহার থেকে বিরত থাকার নির্দিষ্ট সংযম পালনের দ্বারা মানুষ ধ্যানের এমন স্তরে উন্নীত হতে পারে যেখানে অন্য কোনোভাবেই উন্নীত হওয়া যায় না। যার ফলে, এই ধ্যানের মাধ্যমে, মানুষ লাভ করে অসীম স্রষ্টায় লীন হবার সুখ, পরমের সাহচর্য অর্জনের উপায়।

বৈজ্ঞানিকভাবে দেখা গেছে যে, নিয়ৎ সহ যদি বিশেষভাবেই নির্দিষ্ট কতিপয় অনুশাসনপ্রক্রিয়া মান্য করে উপবাস অব্যাহত রাখা হয় তাহলে মানুষের শরীরবৃত্তীয় পরিপাক-বিপাক ইত্যাদির প্রতিক্রিয়া প্রশমিতকরণের মাধ্যমে আমাদেরকে এমন দিকে ধাবিত করে যেদিক দিয়ে গেলে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় — এবং এভাবে এমন একটি জীবনে প্রবেশ করা সম্ভব যেখানে কেবলই নতুন নতুন আবিষ্কারের উদ্ভাসনে উজ্জ্বল হতে পারে আমাদের দুনিয়া। আবিষ্কারগুলো, বলা বাহুল্য, শুধু শরীরবৃত্তীয় প্রশান্ত উদ্ভাসনেই সীমাবদ্ধ নয় বরং অনেক বেশি মানসকেন্দ্রী।

ঠিকঠাক নিয়ৎ ও ঐকান্তিক ইচ্ছা দ্বারা চালিত হয়ে কেউ যদি রোজা রাখে তাহলে তার মানসজগতে পরিবর্তন আসে। মস্তিষ্কে এর প্রভাব বহুমুখী এবং অত্যন্ত তাৎপর্যগভীর; হাজার হাজার বছর ধরে তপস্বী ঋষি ও সুফিদের মধ্যে এই পানাহারনিবৃত্ত সংযমসাধনার উদাহরণ আমাদেরকে এই ইঙ্গিতই দেয় সুস্পষ্টভাবে।

মুসলমানদের কাছে সোয়ম বা সংযম হচ্ছে এমন এক তপস্যা যা ধার্মিক তাৎপর্যমণ্ডিত, এছাড়াও এর ফলে মানবদেহ ও মানবমন পরিশুদ্ধ হয়, এর মাধ্যমে মানবিক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র চৈতন্য ও সঙ্কীর্ণতা থেকে মুক্ত হয়ে মানুষ বৃহতের দিকে ধাবিত হয়, বা আরেকভাবে বলা যায় যে এর মধ্য দিয়ে মানুষ ‘স্রষ্টার চৈতন্য’ বা ‘তাকওয়া’ লাভের পথে অগ্রসর হতে পারে।

‘রামাদান’ বা রমজান মাসেই নবি মুহাম্মদ (সা.)-এর নিকট কোরান অবতীর্ণ হয়েছিল। যদিও কোরান নাজেলের সময় হেরা পর্বতের নির্জন গুহায় নবিজির তপস্যা, ধ্যান ও ধৈর্য-কৃচ্ছতার ব্যাপারে আমরা অতি অল্পই জানি; কিন্তু আন্দাজ করতে পারি যে এইভাবে সংযম বা সোয়মের অনুশীলন শুরু হয়েছিল আজ থেকে প্রায় পনেরোশ বছর আগে, এবং এটা হচ্ছে আরব-অঞ্চলের সেই মরুভূমির রুক্ষ পাথুরে গরমে অসহনীয় আবহাওয়ায় হেরাপার্বত্য গুহার নির্জনতায় নবি মুহম্মদের কঠোর কৃচ্ছসাধনার সামান্য নজির মাত্র, সম্পূর্ণ সংযমচিত্র নয়।

আল্লাহর ‘ওহি’ বা বাণী অবতরণকালে ফেরেশতা জিব্রাইল নবিজির নিকটে এসে তাঁকে নিয়মিত প্রস্তুত করছিলেন যেন পরম স্রষ্টা ও পালনকর্তার বাণী তিনি বিন্যাস্তরূপে গ্রহণ করতে পারেন এবং স্রষ্টার কথাসমগ্র প্রচার করেন কুলমখলুকাতের কল্যাণকল্পে। এই কথামালা আদৌ শুধু ‘মুসলিম’ বা নির্দিষ্ট কোনো ধর্মগোষ্ঠীর জন্যই নিবেদিত তা নয়, এই নির্দেশনামালা ও বাণীমঞ্জরি সমগ্র মানবজাতির উদ্দেশ্যে বলা আল্লাহর বার্তা।

তবে ধ্যান বা সাধনার অন্যতম পূর্বশর্ত উপবাস বা রোজা মোটেও নতুন কিছু নয়, এমনও নয় যে ইসলামের আগে এর প্রচলন ছিল না। আদিকাল থেকে একেশ্বরবাদী নবি-রসুল সকলেরই সাধনার ক্ষেত্রে উপবাস বা রোজা কার্যকর দেখা যায়; ইব্রাহিম, মুসা, ইসা ছাড়াও উনাদের অনুসারী পয়গম্বর ও সর্বসাধারণের জন্য কতিপয় নিয়মের ভিত্তিতে উপবাস করা ধার্য ছিল এবং সবই ছিল সাধনভজনের নিমিত্তে কৃচ্ছতার অংশ। যুগে যুগে নবি-রসুলদের মাধ্যমে প্রচারিত বাণীর বিভিন্নতা থাকলেও উপাসনার অংশ হিসেবে সংযমসাধনা তথা উপবাসের চর্চা ছিল অভিন্ন।

প্রশ্ন জাগে, কেন?

স্রষ্টা তথা আল্লাহ বা ঈশ্বর বা ‘গড’ নামের একটি অদৃশ্য নির্দিষ্ট অস্তিত্বকে ‘সন্তুষ্ট’ করতে একদল মানব-মানবী নিজেদেরকে অভুক্ত রেখে কেন কঠোর কৃচ্ছতা পালনের পথ অনুসরণ করে আসছে? সেইসঙ্গে এই প্রশ্নও ওঠে যে ‘আল্লাহর সন্তুষ্টি’ লাভের জন্যে যে-রোজা বা উপোস, এর ফলে বান্দাদের তথা আমাদের সরাসরি সুফল মিলছে কোথায়? আরও প্রশ্ন ওঠে, একমাসের এই দীর্ঘ রোজা পালনের পর ‘আল্লাহ সন্তুষ্ট হয়েছেন’ কি না তার কোনো প্রমাণ কি আমরা পাই?

প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ, উক্ত-অনুক্ত উত্তরের আশায় আমরা নানাবিধ ধর্মগ্রন্থ পর্যালোচনা না করেও, ধর্মীয় কিতাব-কালামের কথানিহিত রূপক-প্রতীকের দ্যোতনা পাঠান্তরের জন্য গলদঘর্ম না হয়েও, সংলগ্ন বা দূরবর্তী হুজুর-পিরসাহেবদের নিকট দৌড়ঝাঁপ না করেও শধু যদি নিজেদের সাধারণ ধ্যানধারণা বা কাণ্ডজ্ঞানটাকে ঠিকঠাকভাবে আমরা কাজে লাগাই, নিশ্চয় একটা কার্যকর উত্তর পেয়ে যাই কিছুমাত্র সচেষ্ট হলে। এই কাজটা করার সময়, বিভ্রান্তি লাঘবের আশায় উত্তর তালাশের সময়, ‘আল্লাহর সন্তুষ্টি’ অর্জনের ধারণাটার মধ্যে যে-ভ্রান্তি আছে তা আগে লাঘবের জন্য সচেষ্ট হওয়া আবশ্যক। এইভাবে এগোলে যে-উত্তরমালা আমাদের হাতে আসবে তা হবে অনেক বেশি মানবিক ও মানবীয় কল্যাণগুণসম্পন্ন।

যেহেতু কোরান অবতীর্ণ হয়েছিল মানবজাতির কল্যাণসাধন ও করণীয় সম্পর্কে নির্দেশনা জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে, যেখানে মানুষের মঙ্গলের উপরেই নিশ্চিতভাবে জোরারোপ করা আছে, বলা হয়েছে ‘আশরাফুল মখলুকাত’ বা যার কাছাকাছি অর্থ হয় ‘স্রষ্টার সেরা সৃষ্টি’ এবং তাদেরই কল্যাণকল্পে এই গ্রন্থের সমস্ত কথামালা। এমন যদি হতো যে এই পবিত্র গ্রন্থের কেন্দ্রে মানবকল্যাণ থাকত না, তাহলে কেমন হতো?

যদি মানবকল্যাণের ধারণাটা কোরানের কেন্দ্রীয় কথা না-ও হতো, তখনও, তারপরও অন্তত তিনটি বিশেষ ক্ষমতা বা ক্রাইটেরিয়া থাকত স্বয়ং স্রষ্টার হাতে, যে-ত্রয়ী আমাদের অস্তিত্বের তিন প্রধান ও জরুরি নিয়ামক।

এই তিনটাই নিঃসন্দেহে ‘অ্যাক্টস্ অফ গড’; যথাক্রমে — জন্ম তথা ‘হায়াত’ বা আয়ু, ‘মউত’ বা মৃত্যু, এবং ‘রিজিক’ বা জীবিকা।

হায়াত, মউত, রিজিক — এই তিনে মিলেই জীবন, অপরিমেয় অস্তিত্বের বাস্তবতা আমাদের। যাপিত জীবনের বাস্তবতা সর্বত্র সময়সাপেক্ষী, নির্দেশ করছে এমন এক সময়/কাল যা মানুষের উদ্ভাবিত কালগণনার উর্ধ্বে। এই তিনের মধ্যে কেবল তৃতীয় বর্গটি, রিজিক বলা হচ্ছে যেইটাকে, যার মাধ্যমে আমরা আমাদের নিজেদের এবং সংসারের সকলের জন্য অন্নসংস্থান করি, রিজিকের মাধ্যমেই আমরা আহার যোগাই, বর্ণিত তিন বর্গের ভিতর শুধু এই রিজিকটা আমরা নিজের আয়াসে এবং নিজেদের কর্মফলের সমীকরণ হিসেবে খানিকটা নাড়াচাড়া করতে পারি।

রিজিকের জন্য আমরা আকাশের দিকে হা করে চেয়ে থাকতে পারি, রিজিকের জন্য ফরিয়াদ করতে পারি আল্লাহর দরবারে, কিন্তু সত্যি কথাটা হচ্ছে এর প্রত্যুত্তরে বেহেশ্তি খানাদানার একটা কণাও আল্লাহ আমাদের মুখে এগিয়ে দেবেন না, তা আমরা পাপী কি পুণ্যাত্মা যা-ই হই না কেন। মুখের গ্রাস আর উদরপূর্তির জন্য মেহনত করা ছাড়া আমাদের গত্যন্তর নাই। শারীরিক ও মানসিক উভয় কিসিমের মেহনত করা লাগে উদয়াস্ত আমাদের যার যার রিজিক অন্বেষণের জন্য। পরিশ্রম, মেহনত, মজুরখাটা যা-ই বলি না কেন করতে হয় এই রিজিকের সন্ধানে। একেকজন একেক পেশায় নিয়োজিত হই এই কারণেই। কিন্তু কতটুকু পরিশ্রম করলে কেমন পরিমাণে রিজিক জুটবে, মেহনতের ফল সবার ক্ষেত্রে সমান স্বাদু হবে কি না, তা আমরা হলফ করে কেউই বলতে পারি না।

মানুষ হিসেবে এইখানেই আমরা ব্যর্থ হয়েছি যে জীবনের অত্যাবশ্যক তিন বর্গের যে-একটি আল্লাহ আমাদেরকে জুটিয়ে নেবার দায়িত্ব দিয়েছিলেন তাতে আমাদের গাফিলতির সীমাশুমার নাই। এবং শুধু নিজেদের খাবারটা হাসিলের জন্যই রিজিকের দায় আমাদের কাঁধে বর্তেছিল তা নয়, গোটা মানবজাতির রিজিকের দায় আল্লাহ আমাদের কাঁধে ন্যাস্ত করেছেন। মোদ্দা কথাটা খাবার জোটানো, এবং নিজেরটা ছাড়া বাকি কারো অন্নসংস্থান নিয়া আমরা ভাবছি না কেউই, খালি আল্লাহর ভয় এবং পাপের নিন্দায় মুখর থাকছি, রিজিকের সমীকরণে ব্যর্থ মানুষ শুধু দুরাচার-ভ্রষ্টাচার করে বেড়াচ্ছে দুনিয়া জুড়ে, নিজের আখের গোছানোর বাইরে সকলের রিজিক নিয়ে একতিলও ভাবছে না।

পৃথিবীর প্রথম মানবটির কথা একবার কল্পনা করা যাক। তবে আল্লাহ কাকে প্রথম পৃথিবীতে পয়দা করেছিলেন, আদম না হাওয়া — লৈঙ্গিক এই দ্বিকোটিক কূটতর্ক অবশ্যই মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে হবে প্রথমেই। বরং জিজ্ঞাস্য হতে পারে যে কে সেই আদি মানবসুরতটিকে রিজিক যুগিয়েছিল বা কীভাবে তার গ্রাসাচ্ছাদন জুটেছিল। আদি মানবটি কী খাবার খরিদ করে খেয়েছিল? না, তা তো নয়। কারণটাও সহজেই অনুমেয়, কারণ তখন তো কোনো মহামুদিখানা বা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর ছিল না যে সেখানে গাদাগুচ্ছের খাবার মজুদ থাকত। তাহলে? ভেবে দেখা যাক।

আদি মানবের সময় থেকেই পৃথিবী একটা অতিকায় বায়োলোজিক্যাল ল্যাবরেটরি বা জৈবিক উৎপাদন কারখানা হিসেবে জীবনধারণের পর্যাপ্ত রিজিক নিয়েই বিরাজ করছিল এবং আজও তা-ই করছে। স্রষ্টার তৈরি-করা খাদ্যশৃঙ্খল এমনভাবেই বিরাজিত যা মানুষ তো বটেই, মানুষ সহ সর্বজীবের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্যসম্বলিত। সেই খাদ্য যতটা প্রাণিজগতের, উদ্ভিদের, পোকামাকড়ের, জীবজন্তুর, পশুপাখির জন্য বরাদ্দ, ততটাই মানুষের। কম বা বেশি কিছু নয়। প্রাকৃতিক ভারসাম্যপূর্ণ এক মহা খাদ্যশৃঙ্খল। শুধু কোথাও একটা বড় ধরনের ব্যত্যয় বা ‘ঘাপলা’ ঘটে গেছে এই শৃঙ্খলের মধ্যে কালক্রমে।

দৈবদুর্বিপাকে তথা আল্লাহর ইচ্ছায় বা যেভাবেই হোক প্রাকৃতিক বৈরী কিছু ঘটনায়, যেমন হতে পারে বন্যায় বা খরায়, বিকট কোনো ঝড়ে কি জলোচ্ছ্বাসে বা মহামারীতে আল্লাহ্প্রদত্ত প্রাকৃতিক খাদ্যশৃঙ্খলে টান পড়েছে এবং এই সময় থেকেই মানুষের উপর আল্লাহ কর্তৃক দেয়া দায়িত্ব আরও বেড়েছে সর্বজীবের জন্য বরাদ্দ খাদ্যগুদামের রিজিক বণ্টনবিন্যাসের।

আল্লাহ আমাদেরকে ‘সৃষ্টির সেরা’ আখ্যা দিয়েছেন কারণ আমাদেরকে ‘চৈতন্য’ দান করা হয়েছে, যে-চেতনা বা চৈতন্যগুণের কারণে আমরা ভালো ও মন্দ আলাদাভাবে বিচার করতে পারি, নৈতিক ও অনৈতিক ফারাক করতে পারি, ন্যায় এবং অন্যায়ের ভেদ করতে পারি, সমতা ও অসমতার বিবেচনায় বিচারবুদ্ধি খাটাতে পারি, — এবং এই বিবেচনাবোধগুলোই হচ্ছে সেই বিশুদ্ধ ও দয়াশীল স্রষ্টার সত্তাজাত গুণ, যা মানুষকে দেয়া হয়েছে, পরম সত্তার এই বিশুদ্ধ বৈশিষ্ট্যগুলোই মানুষকে শ্রেষ্ঠ অভিধায় চিহ্নিত করেছে।

যা-ই হোক, পশু ও মানুষের মধ্যে পার্থক্য খুবই ক্ষীণ; যদিও পরিহাস এখানেই যে মানুষই নিয়েছে পশুবৈশিষ্ট্য রপ্ত করে কিন্তু উল্টাটা ঘটে নাই, মানে পশুরা মানুষবৈশিষ্ট্যে অভিযোজিত হয় নাই। সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে পাওয়া মানুষের আরেকটি বড় আশীর্বাদ হচ্ছে সে সৃজনশীল, সৃষ্টি করবার সামর্থ্য তাকে দেয়া হয়েছে। এই সৃজনী গুণ ব্যবহার করে মানুষ কৃষিতে দক্ষতা বাড়িয়েছে, পশুদেরে শিকারের মাধ্যমে নিকেশ করেছে, এবং এই সৃজনশক্তি ব্যবহার করেই সে জীবজগতের যাবতীয় আহার্য শুধু বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পর্যবসিত করে গেছে।

বেনিয়া মানুষের এই বেনেবৃত্তির ফলে স্রষ্টার দান প্রাকৃতিক খাদ্যশৃঙ্খল হয়ে উঠেছে দিনকে-দিন ক্ষীণকায় আরও। হোক তা মানুষের কেড়ে-নেয়া দস্যুতার কারণে বা আর-কোনো দুর্ভাগ্য-দুর্যোগের কারণে, আহার্য খাদ্যের সঙ্কট এবং লেলিহান ক্ষুধা মানুষের অনন্য পরিচয় মানবতাকে করে তুলেছে উত্তরোত্তর অধিকতর সঙ্গিন। ফলে যেসব পশুপাখি, জীবজন্তু, উদ্ভিদ, পোকামাকড় ও অন্যান্য জৈবপ্রাণ রয়েছে খোদার দুনিয়ায়, তারা আরও কোণঠাসা হয়েছে মানুষ কর্তৃক তাদের খাদ্যভাণ্ডার লুণ্ঠনের কারণে। এর অনিবার্য ও অবধারিত দুঃখের ফল ফলেছে একটাই যে এই পৃথিবী গ্রহের অধিবাসী মানুষই একমাত্র অস্তিত্ব যাদেরকে ন্যুনতম বেঁচে থাকার খাবারটুকুও কিনে খেতে হয়, তার আর কোনো উপায় নাই কিনে খাওয়া ছাড়া। আর এই কাণ্ডটা যখন ঘটছে তখন তলে তলে আরেকটা ভয়ঙ্কর কাণ্ড সংঘটিত হয়ে গেল, জন্ম নিলো মানুষের শব্দভাণ্ডারে ‘গরিব’ ও ‘ধনী’ এই দুই শব্দের।

মনে করিয়ে দেই যে দয়াময় সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে দুইটা খাবার মানুষ পেয়েছিল সম্পূর্ণ নিখর্চায়, বিনিময়মূল্য ছাড়াই, সেই দুই জরুরি খাদ্যদ্রব্যের একটা হচ্ছে বাতাস ও অন্যটা পানি।

আজকে যে-সময়টাকে আমরা ডাকছি ‘জ্ঞানদীপ্তির সময়’ নামে, এই সময়ে এসে আমরা অন্তহীন কথা বলে চলেছি ‘দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র’ দূরীকরণ নিয়ে এবং এইটা বাস্তবায়নের জন্য আমরা দারিদ্র্য নিরসনকল্পে ‘গরিবদের ঋণসহায়তা’ দানের কাজ করছি অত্যন্ত ঘটা করে, এমনকি আমাদের মধ্যে কেউ কেউ ‘দারিদ্র্য করে তুলব জাদুঘরের দর্শনীয় দ্রব্য’ বলে সাড়ম্বর ঘোষণা হাঁকছি, কিন্তু একবারও ভেবে দেখছি না যে এর ফলে আমরা আমাদের আত্মার দারিদ্র্য ও দূষণ প্রকট-বিকটভাবেই প্রকাশ করে চলেছি শুধু। আমরাই আমাদের আজকের দুর্ভোগের জন্য দায়ী, বিপদের আমরাই হোতা, আল্লাহ বা ঈশ্বর আমাদের উপর প্রতিশোধপরায়ণ কখনোই নন বা দানবসুরতে এইসব গজব তিনি নাজিল করছেন না। আচারসর্বস্ব ধর্মকৃত্য দিয়া আল্লাহকে ‘সন্তুষ্ট’ করার কারণেই যে তিনি আমাদেরকে দয়াদাক্ষিণ্য করছেন ব্যাপারটা তা না।

মানুষই অতএব মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু এবং ‘মানবাধিকার’ বা মানুষের জন্মগত অধিকার হিশেবে ‘ঋণ’ দানের মাধ্যমে দারিদ্র্য দূর করার কাজটা কেবল প্রহসনই নয় উপরন্তু মানুষের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করার শামিল। ‘ঋণ’ কোনো দাতব্য কম্ম নয় এবং আজকের দিনে প্রান্তবাসী মানুষগুলোকে স্রেফ গ্রাহক বানিয়ে ঋণ দেয়া হচ্ছে, যেন সর্বরোগহর ওষুধ এই ঋণ এমন একটা ভাব ফলানো হচ্ছে, এই ঋণদান বহরেগতরে ব্যবসা বাড়াইবার আরেকটা উপায় মাত্র — লুচ্চা বাণিজ্যবেসাতি আর শোষণের একটা হাতিয়ার হিসেবে এই ঋণকর্মসূচি বিস্তার লাভ করেছে এবং দুনিয়ায় বিরাজমান কোনো ধর্ম কোনো বিশ্বাসব্যবস্থাই এহেন খতরনক ঋণবাণিজ্য অনুমোদন করে না।

কাজেই রমজানের প্রকৃত শিক্ষাটা আমরা কীভাবে গ্রহণ করব এবং মুসলমানেরা রামাদান বা রমজানের এই সোয়ম বা সিয়াম সাধনার অনুশীলন থেকে কোন ফলটা পেতে পারে, এই প্রশ্নের উত্তর আমরা খুঁজতে চেষ্টা করতে পারি। জিনিশটা কী এমন যে আমরা আগ-ভোর থেকে সারাদিন না খেয়ে থাকি সন্ধেবেলা আজানের সঙ্গে সঙ্গে পেট ফাটিয়ে খাবো আর খেতেই থাকব রাতভর সেহরির শেষ ক্ষণ পর্যন্ত? যদি জিনিশটা হয় যে গরিব ক্ষুধার্ত মানুষের মর্মযন্ত্রণা আমরা হাড়েমজ্জায় উপলব্ধি করব বলেই রোজা রাখি, তাহলে ভেবে দেখেছি কি যে গরিবেরা খানাখাদ্যের বিলাসিতায় রাতভর মেতে থাকে কি না? আর এইভাবে দিনভর চৌদ্দঘণ্টা পানাহার পরিহার করে রাতভর খানাখাদ্যে ফেঁপে থাকার মধ্য দিয়া আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করতে পারব?

আমাদের মানবীয় অনুভূতির কোনো তকলিফ না হলেও তথাকথিত ‘ধর্মীয় অনুভূতি’ নামের জিনিশটার থোতামুখ ভোঁতা হয়ে যায় মুক্তবুদ্ধির প্রশ্ন মোকাবেলা করতে গেলেই। অন্ধবিশ্বাস আর আজগুবি বিশ্বাস বা কুসংস্কার ইত্যাদির ব্যাপারে ইসলাম অনেকটাই নীরব বলা যায়, তারপরও অস্বীকার করা যাবে না যে সংযমব্রতের কঠোর সাধনা প্রবর্তনের মাধ্যমে এই নীরবতার বিরুদ্ধেই ইসলাম একটা আলতো অবস্থান নিয়েছে। এইসব বিষয় নিয়া আমরা দৈনিক সংবাদপত্রিকায় লেখাজোখা পড়ি, টেলিভিশনে আলেম-উলামাদের আলোচনা অনুষ্ঠান দেখি, কিন্তু সবখানেই আলোচিত হতে দেখব রোজায় কি কি করা যাবে আর কি কি করা যাবে না আচার-সংস্কার সংক্রান্ত কথাবার্তা যার সঙ্গে কোরানের বিধান বা ইসলামের সেভাবে কোনো সম্পর্কই নাই।

বিভিন্ন মাধ্যমে এইসব আলোচনার যা বিষয়বস্তু তা আসলে এক আজব খিচুড়ি, কি করে ফেললে উপোস হবে না বা কাদের রোজা কবুল হবে না, স্বাস্থ্য ও শরীরগতরের নানাবিধ জটিলতা নিয়া আলাপ, অথবা আরও উল্টাপাল্টা হাস্যকর জিনিশ যেমন উপোস করার সময় আমরা পাব্লিকলি পাদ মারতে পারব কি পারব না, বা রোজারমজানের মাসে স্বামীস্ত্রীর বা নারীপুরুষের শরীরিক মিলন তথা সংগম-সোহবত জায়েজ কি না ইত্যাদি বিতিকিচ্ছিরি নিয়া আলেম-উলামাগণ কথাপাণ্ডিত্যের পসরা বসান।

সত্যি বলতে, খেয়াল করলে দেখতে পাবো, দুনিয়াবি কিংবা জাগতিক যত তুচ্ছাতিতুচ্ছতা নিয়া আলেম-উলামা-মাশায়েখদের অসুস্থকর অপচিন্তার হযবরল বাজার বসেছে এইখানে এবং এসবের সঙ্গে আধ্যাত্মিকতার ছিঁটেফোঁটা সম্পর্কও গরহাজির, আধ্যাত্মিকতার সম্পূর্ণ বিপরীত আমাদের কথিত আলেমদের কথাবার্তা।

আর এইভাবেই রমজান মাস এলে আমরা পাপাচার আর ভ্রষ্টাচারের যেন বাজার বসাবার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হই। রমজান মাস যেনবা আমাদের উত্তাল লোভ-লোলুপতা আর আত্মার দারিদ্র্য প্রকাশের এক উলঙ্গ প্রদর্শনী যা আমাদেরকে এক বল্গাহীন ভোগবাদের দিকে ধাবিত হবার জন্য প্ররোচিত করে এবং অকল্পনীয় এক অর্থলিপ্সা আর প্রকাণ্ড জটপাকানো দর্শনগত দরিদ্রতার ভিতর নিমজ্জিত করে, এসবের জন্য স্রষ্টা আল্লাহর উপর দোষারোপ করবার কোনো যৌক্তিকতা আমি দেখি না।

আদর্শিকভাবে সিয়াম বা রোজা রাখা আমাদেরকে সেই খাদ্যশৃঙ্খল পুনরায় স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনবার জোর তাগিদ দেয় যে-খাদ্যশৃঙ্খল আমরা ইতোমধ্যে লেজেগোবরে করে ফেলেছি। সিয়াম হচ্ছে শোধরাবার জন্য ব্রত, মানবজাতির বিরুদ্ধে যে-একটা অপরাধ আমরা করে ফেলেছি কিংবা করে চলেছি সেই অপরাধের বোঝা খানিকটা হাল্কা করে নেবার একটা ব্যবস্থা, আর এই কারণেই ইসলামে মুসলমানদের উপর এই একমাসকাল সংবিধিবদ্ধ উপোস ফরজ করা হয়েছে।

একটাবারের জন্যও যদি পৃথিবীর কোটিকোটি মুসলমান রোজার মাসে উপলব্ধি করতে পারে যে কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি নয় বরঞ্চ রোজা মানবকল্যাণের গুরুত্ব অনুধাবনের একটা সাধারণ উপায়, আমার ধারণা তাতেই বিশ্বাস ও ধর্মের গায়ে গেঁড়ে-বসা হাজার উদ্ভটতার নিরসন হয়ে যেত। রোজার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন যদি করতেই হয় তাহলে সেটা হবে এই শিক্ষাটা আত্তীকরণ করার ভিতর দিয়ে যে এই একটা মাসের আওতায় একটি বিশেষ ধর্মগোষ্ঠীর অনুসারীরা তাদের অতিরিক্ত ভোগ পরিহার করে যে-খাদ্যশস্য দুনিয়ার বাকি জীবপ্রাণউদ্ভিদমানুষগোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দ রাখল, তাতে করে এই একমাসে বেঁচে-যাওয়া খাদ্য দুনিয়ায় বাকিদের অভাব খানিক হলেও পূরণ করল, এইভাবেই কিছু হলেও অর্জিত হলো আজকের ভাষায় যেটাকে বলি আমরা ‘খাদ্যনিরাপত্তা’। আর এই উপায়েই মানুষসৃষ্ট গজব তথা দুর্ভিক্ষ, খাদ্যের অভাবে প্রাণের আহাজারি ও বিনাশ, দূরীভূত হতে পারে এবং মানুষ যেতে পারে এক অনাবিল কল্যাণমূলক জীবনের দিকে। এছাড়া বাঁচার রাস্তা নাই।

মানবকল্যাণ বলতে কেবল মুসলমানদের কথা কখনোই বোঝানো হচ্ছে না, বলা হচ্ছে সর্বমানবের সর্বজীবের কল্যাণ, মুসলিম হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ইহুদি কিংবা আস্তিক ও ‘নাস্তিক’ সকলের শান্তিকল্যাণ। অতএব আল্লাহ সন্তুষ্ট হবেন শুধুমাত্র এই উপায়েই, মানবজাতি টিকে থাকলে এবং ক্রমোন্নতির কল্যাণমূলক পথে এগোতে পারলেই আল্লাহ সন্তুষ্ট হবেন অন্যথায় নয়।

দ্ব্যর্থহীনভাবে কোরানে এই কথা বলা হয়েছে যে “একজন মানুষকে খুন করা মানে গোটা মানবজাতিকেই খুন করা” (৫:৩২), কাজেই নিকেশ করা বা খুন করা বা হত্যা করা যা-ই বলি না কেন, ক্ষুধায় কাৎরাতে কাৎরাতে যে মারা গেল তার মৃত্যুর কাছে খুনের অপরাধও তো কম মনে হয়।

কেবল পানাহার পরিহার করে দিনটা কাটালাম আর হয়ে গেল রোজা তা তো নয়, এর সঙ্গে ওতপ্রোত যুক্ত সংযমের সুনির্দিষ্ট সংবিধিমালা। সোজা কথায়, সিয়াম হচ্ছে অসুর কোনোকিছু দেখা, শোনা এবং করা থেকে নিজেকে বিরত রাখা। খারাপ কিছু দেখা থেকে দূরে থাকা, খারাপ কিছু শোনা থেকে দূরে থাকা, খারাপ কিছু করা থেকে দূরে থাকা — এই তিন নির্দেশ শুধু-যে দুনিয়াবি ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষাগুলো দমিয়ে রাখার জন্যই জারি হয়েছে তা কিন্তু নয়, বেশিরভাগ মানুষেরই ধারণা তা-ই যদিও; — নিষেধাজ্ঞাগুলো মূলত লোভলালসার মূলোৎপাটনের জন্যই এসেছে, এবং সোজা বাংলায় পেটুকদের উদরসর্বস্ব অতিভোগ নিবৃত্ত করার জন্যই সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে এই নির্দেশত্রয়।

আমাদের জীবনে যা-কিছু দুর্দশা তার মূলে এই অতিভোজনের বিকৃত বাসনা তথা ভ্রষ্টাচার। এর ফলে এক অনপনেয় দুষ্টচক্র খাড়া হয় যেখান থেকে ঈর্ষা, অসূয়া, হিংসা, লালসা-লাম্পট্য ও দুর্নীতির জন্ম হয়।

কেমন সংযমের নজির আমরা রাখছি রোজার সময়, এর যদি উদাহরণ দিতে যাই, ইফতারের সময় কী যে বেহুঁশ খানাখাদ্য আমরা সাবাড় করি ঘরে ঘরে একেকজনে (আর সরকার ও বিরোধী সকলপক্ষের ইফতার পার্টিগুলোতে) এর হিসাব বের করলেই বোঝা যাবে আমাদের সংযমের ঠ্যালা, ভয়াবহ বল্গাহারা বিকৃতিতে মেতে উঠি ইফতারের সময়, অশ্লীল উদরপূর্তির আর অর্থবিত্ত ও আত্মার অপচয়ের যেন রাক্ষুসে এক প্রতিযোগিতায় মেতে উঠি আমরা, যার ফলে এই সংযম পালনের শিক্ষা অর্জনের মাসে উল্টো অসংযম যেন উৎসাহ পায় এবং ভোগবাদের প্রাতিষ্ঠানিকতা আরও শক্তপোক্ত হয়।

রমজানের মাসে এত উদগ্র ভোগে মেতে উঠি আমরা যার ফলে বাজারে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্য থাকে আকাশছোঁয়া। বাজারের ভোজ্যপণ্যগুলো সবাই মিলে একসঙ্গে অহেতু অতিব্যবহারের ফলে এই মাসে যোগান ছাপিয়ে চাহিদা থাকে অকল্পনীয় বেশি। বছরের বাকি এগারো মাস রোজা থাকি না আমরা, তারপরেও বাজারে জিনিশপত্রের দাম রমজান মাসের মতো অভাবনীয় চড়া থাকে না — আর এতেই প্রমাণ পাওয়া যায় সিয়াম সাধনার নামে আমরা এই একমাস উলঙ্গ ভোগোন্মত্ত থাকি।

বস্তুতপক্ষে সমগ্র মানবজাতির খাদ্যশৃঙ্খলে অবদান রাখব কি, উল্টো বরং নারকীয় সঙ্কট ও চাপ তৈরি করি এই একমাসে এবং যে-কারণে দেখা দেয় খাদ্যসঙ্কট। করার কথা ছিল খাদ্যশৃঙ্খল হৃষ্টপুষ্ট এই একমাসে পরিমিত ও সংযত ভোগচর্চার মাধ্যমে, এর উল্টা আমরা খাদ্যশৃঙ্খল অধিকতর দুবলাপাতলা আর সঙ্কটাপন্ন করে ফেলি।

সিয়াম সাধনার নামে একমাস ধরে যে পেটুক ভ্রষ্টাচারের নমুনা আমরা দেখাই তাতে কেবল রমজানের মূল শিক্ষা ‘ভুখা মানুষের ক্লেশযন্ত্রণা উপলব্ধি’ করবার ধারণাটাই হাসিতামাশার বিষয় করে ফেলি তা নয়, এরচেয়েও বেশি অপরাধ যা করি তা হচ্ছে আমাদের একদম মজ্জাগত সহজাত ‘ভদ্রতা-বিনয়ের ভণ্ডামি’ প্রদর্শনের বেলেল্লা নজির স্থাপন করি এবং তা বংশপরম্পরায় প্রবাহিত হতে দেই।

আল্লাহর নির্দেশিত পথ ও পন্থার বিরুদ্ধাচরণই করে চলি আমরা বছরের এই বিশেষ মাসটায়। শালীনতা আর সুবোধ পরার্থপরতার যে পুণ্য গুণ প্রত্যেকে উপলব্ধি করবার কথা এই মাসে, কেবল অল্পে তুষ্ট থাকা আর নিজে যথাসম্ভব কম ভোগ করে অপরের জন্য বরাদ্দ রাখার কল্যাণচিন্তায় নিবিষ্ট হবার যে শিক্ষা ইসলাম আমাদেরকে নিতে বলেছে — এইটাই আমরা বছরের পর বছর ধরে স্রেফ ভুলে থেকে উল্টা কাজটাই করছি।

স্রষ্টার ‘সন্তুষ্টি’ অর্জনের নামে বাস্তবে আমরা রামাদানের মাসজুড়ে অসার-অসার্থক যত সৃষ্টিছাড়া কাণ্ড করে বেড়াই, নিজের ইন্দ্রিয় পরিতৃপ্তির ফিকির করি দিনরাত উদাম উন্মাদ, যার পরিণামে কেবল লোভ আর লাম্পট্যের পাহাড় গড়ে ওঠে, নিজেদের উঁচা সামাজিক অবস্থান প্রদর্শনে ব্যাপৃত রই প্রত্যেকে এবং মুখভরে খিস্তি চালাই নির্বিচার নির্বিকার আর ভান বজায় রাখি সৃষ্টিকর্তাকে সন্তুষ্ট করছি।

বিকট বীভৎস এই-সমস্ত আচরণ দিয়া আমরা ইসলামের অভিপ্রেত শিক্ষা যথা ধার্মিকতা, বহুজনের ভালো করবার ভাবনা তথা পরার্থপরতা, সার্বিক সংযম, সহিষ্ণুতা প্রভৃতি হীন প্রতিপন্ন করি। কিছু সংবেদনহীন সাংস্কৃতিক প্রথা পালন ছাড়া রোজার মধ্য দিয়া আমরা ‘তাকওয়া’ হাসিলের ছিঁটেফোঁটা কাজটাও করি না, আর যা যা করি তার সঙ্গে আল্লাহ বা কোরান কি নবি মুহম্মদ (সা.)-এর কোনো সংযোগ নাই।

উপরন্তু, স্রষ্টাকে ‘সন্তুষ্ট’ করবার রাস্তায় এতটাই নির্মম আমরা যে এর প্রমাণ রমজানের শেষদিকে একদম উদোম হয়ে বেরিয়ে পড়ে। একমাস উপাস করবার নামে বাজারের বস্তা বস্তা খাবারদাবার খালি করে গান্ডেপিন্ডে গিলে ঈদের আগের কিছুদিন বাতিকগ্রস্তের মতো শপিং করতে থাকি, শপিংমাতাল মুসলমানের এমন নজির ভূপৃষ্ঠে বিরল। ‘অবিশ্বাসী বিধর্মী’ বলে গালাগাল করি আমরা যাদেরকে সেই পাশ্চাত্য দুনিয়ায় কিংবা আমাদের প্রতিবেশী ‘হিন্দু ইন্ডিয়া’-য় শারদীয় পূজায় কি ক্রিসমাসে এত শপিং-উন্মত্ত ধর্মপালনকারীর দেখা পাওয়া কল্পনার বাইরে। সেসব দেশে যে-কোনো ধর্মীয় উৎসবের সময় বাজারের দোকানপাটগুলায় যে-মূল্যহ্রাস হাঁকা হয় তা অভাবনীয়। বছরভর ‘আল্লাখোদা না-মানা মুনাফা’ করবার যে-ধুম চলে সেইসব দেশে, ধর্মীয় উৎসব-অনুষ্ঠানের সময় তাদেরকে প্রায় ঘড়ির উল্টাদিকে নামমাত্র মুনাফায় মানবিক হতে চেষ্টাশীল থাকতে দেখা যায়।

বাংলাদেশে এই চিত্র পুরাটাই বিপরীত। প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য থেকে শুরু করে পোশাকপণ্য সমস্তকিছুর দাম ঈদের বাহানা সামনে রেখে চতুর্গুণ হয়ে যায়। বাজারি ‘ঈদ ফ্যাশন’ দেখে দেখে লোকে পাগলের মতো জুতাজামা টুপি-আচকান কুর্তাকামিজ শাড়ি-লেহেঙ্গা খরিদের উলঙ্গ উন্মাদনায় মেতে ওঠে। একবারও ভেবে দেখে না যে এইসব জুতাজামায় কিংবা আরবি আতরে কি পাঞ্জাবি-টুপিতে আল্লাহ খুশি হবেন কিসের জন্য এবং কোন কল্যাণ সাধনের জন্য তিনি আমাদেরকে পুরস্কৃত করবেন। এইগুলা আর কিছুই না আমাদের বল্গাহারা আকাঙ্ক্ষা, উদগ্র ভোগবাসনা আর আমাদের ব্যক্তিক স্বার্থান্ধ অভিপ্রায় ছাড়া।

আসুন আমাদের অভিপ্রায়গুলা, আমাদের আকাঙ্ক্ষাগুলা করে তুলি বেহেশ্তি বিশুদ্ধ, স্রষ্টার সৃষ্টিমুহূর্তের মতো সুন্দর ও বাহুল্যমুক্ত। যদি পারি, সৃষ্টির কল্যাণভাবনার মধ্য দিয়েই আমরা পারব রমজানের অশেষ সওয়াব অর্জন করতে। এছাড়া আর কোনো পন্থায় সৃষ্টিকর্তাকে সন্তুষ্ট করা যাবে না।

আমাদের সিয়াম সাধনা যেন সুখের হয়, আমাদের ভোগের বাসনা যেন হয় মানবিক ও পরার্থপরতায় মিচাচারী।

অনুবাদ / জাহেদ আহমদ


অনুবাদকের নোট  : রচনাটা ইংরেজি ভাষা থেকে বাংলায় অনুবাদ করবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে বেশকিছু কারণে। একটা কারণ হচ্ছে যে ধর্মের পারত্রিক বা পারলৌকিক পাওনাগণ্ডার বিবরণ পড়বার চেয়ে ঐহিক বা ইহজাগতিক তাৎপর্যসন্ধিৎসু রচনা পাঠের দিকে ব্যক্তিগত ঝোঁক, যেসব রচনায় হিতকরী চিন্তার আলোকে পৃথিবীর আদি রিলিজিয়াস নির্দেশনামালা প্রাণিজগতের বিকাশ ও বৈচিত্র্য সুরক্ষায় সিদ্ধ করে নেবার স্বাভাবিক প্রণোদনা থাকে সেইসব রচনা আখেরে ধর্মকে প্রথানুগত অনুশাসনের বাইরে এনে প্রাণবান্ধব করে তোলে। যেমন ধরা যাক অনূদিত এই রচনায় সিয়াম সাধনার ধারণাটাকে একটা জায়গায় ব্যাপক গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে, যেখানে কেবল মানুষ ও মানুষ ছাড়াও জৈবজাগতিক যাবতীয় প্রাণের আহার্য সংরক্ষণের সম্ভাবনা আর তা না করতে পারার ফলে উদ্ভূত সঙ্কট নিয়ে লেখকের আলোকপাত নতুন করে ভাবতে পথ দেখায়। আজকের দুনিয়ায় খাদ্যশৃঙ্খল ব্যাহত হওয়া এবং খাদ্যনিরাপত্তা মারাত্মক হুমকির মুখে পড়ার কারণে এই দিক দিয়ে দেখার চোখটা আমাদেরকে অবিলম্বে তীক্ষ্ণ করা ছাড়া উপায় নাই। সিয়ামের শিক্ষা ইসলামের অনুসারীদের সারাবছর মিতাহারী-মিতাচারী রাখবার কথা ছিল, প্রত্যেকটা একেশ্বরবাদী ধর্ম যার যার ব্রত-উপবাস-রোজা পালনের মাধ্যমে দুনিয়ার খাদ্যশৃঙ্খল অব্যাহতকরণে অবদান রাখবে কথা ছিল, যদিও বল্গাহারা পেটুকপনা আর ভ্রষ্টাচার ছাড়া চোখে পড়ে না কিছু। রচনাটায় এমন কথাগুলো অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে হাজির করা হয়েছে। এই রচনা অনুবাদের আরেকটা কারণ হচ্ছে, এর রচনাকার মাকসুদুল হক বাংলাদেশের প্রথিতযশা জ্যাজ-রক মিউজিশিয়্যান এবং যিনি কোনো প্রকারের ড্রেসকোডের নিগড়মুক্ত খোলাচোখে ধর্মকে দেখেন, ঐহিক চৈতন্যের সঙ্গে পরমার্থের চৈতন্য সমন্বয় করতে সবসময় সচেষ্ট থাকেন, ইহকালের গালাগাল আর পরকালের নেশায় মাতাল ভ্রষ্ট ধর্মপেশাজীবী গোষ্ঠীটাকে এই রচনাতেও হক ক্রিটিক করেছেন, যেমন করে আসছিলেন তিনি লিরিকের মাধ্যমে বিগত চার দশকেরও অধিক কাল ধরে এবং সেজন্য জোর আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও হকের কণ্ঠ লাউড হয়ে যায়নি মোটেও। রচনাটি ইংরেজিমূলে ছিল Secrets of Swam & Our Gluttonous Depravity শিরোনামে, এইটা ২০১৩ সনে প্রকাশিত হয়, যে-কেউ আগ্রহী হলে লেখাটা অ্যাভেইল করতে পারবেন। মূল লেখার ধার ও ধক অবিকল রাখা অনুবাদকের কমজোরির কারণে সম্ভব না হলেও মূলানুগ থাকবার চেষ্টাটি ছিল সবসময় এবং মূল রচনাকারের অনুমোদন নিয়ে এই অনুবাদটা পাব্লিকলি প্রকাশ করা গেল।

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you