শেখশাহি, সাংবাদিকতা ও স্বাধীন বাংলা || সুমন রহমান

শেখশাহি, সাংবাদিকতা ও স্বাধীন বাংলা || সুমন রহমান

 

ফ্যাসিবাদ টেলিভিশনকে পুরোপুরি গিলে ফেলেছিল। টেলিভিশনের অর্ডিনারি সম্পাদকেরা তাদের মাথা বিকিয়ে পুরোদস্তুর দালালে পরিণত হয়েছিলেন। তাদের কেউ কেউ প্লট পেয়েছেন, কেউ ব্যাংক লোন নিয়ে ঋণখেলাপি, কেউ সরকারি পদ বাগিয়েছেন। বিনিময়ে তারা ২৪ ঘণ্টা টেলিভিশনে সরকারের গুণকীর্তনে জ্বলজ্বল করতেন। সরকারের পরিভাষায় কথা বলতেন, হুমকি দিতেন, উন্নয়নের গালগল্প শোনাতেন। তাদের নামধাম আমরা সবাই জানি। ফলে বলবার দরকার নাই। উইচ হান্টিং করা আমার উদ্দেশ্য নয়।

গুটিকয় সাংবাদিককে দেখেছি যারা টেলিভিশনের অজগরের পেটের মধ্যে বসেই সাহসী সাংবাদিকতা করেছেন। তৃতীয় মাত্রার জিল্লুর রহমান এবং ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভির খালেদ মুহি্উদ্দীন। জিল্লুর রহমান কনসিসটেন্টলি তার টকশোতে সমাজের ডিসেন্ট (dissent) ভয়েসগুলোতে স্পেস দেয়ার চেষ্টা করেছেন। পরবর্তীতে ইউটিউবচ্যানেলে নিজের কথাগুলো বেশি করতে বলতে থাকলেন। খালেদ তো ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভি  ছেড়ে ডয়েচভেলে  চলে গেলেন। কিন্তু সাংবাদিকতার এথিক্স থেকে সরেন নাই। আমি টিভি বেশি দেখি না, ফলে আরো অনেককেই হয়তো দেখতে পাই নাই।

টেলিভিশন জার্নালিজমের সবচে নিষ্ঠুর বলি হলো মাঠপর্যায়ের রিপোর্টাররা। জীবন বাজি রেখে তারা ভয়াবহ সব ইভেন্ট কাভার করেছেন। কিন্তু হাউজ এর সামান্যই ব্রডকাস্ট করেছে। আজকে যখন নানান টিভি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, সবার আগে চাকরি হারাবেন এই ফ্রন্টলাইনাররাই।

আদতে সোশ্যাল মিডিয়াই ছিল এই দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’। বহু সাংবাদিক এবং ভাষ্যকারকে আমরা দেখেছি এই হাইওয়েতে। পুরোপুরি পেশাদারি, রিভিলিং এবং ড্যাশিং সাংবাদিকতা করেছে নেত্র নিউজ। পরে কখনো সোশ্যাল মিডিয়া বেইজড সাংবাদিকতা নিয়ে লিখব।

প্রিন্ট মিডিয়াকে ফ্যাসিবাদ খুব একটা গিলতে পারে নাই। নিউ এজ-এর নুরুল কবীর এবং মানবজমিন-এর মতিউর রহমান চৌধুরী এক্স-ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করলেন। সবচে ইন্টারেস্টিং ছিল প্রথম আলো  এবং ডেইলি স্টার। ইনফ্লুয়েন্সিয়াল মিডিয়া হওয়ায় তাদের ওপর সরকারের চাপ খুব বেশি ছিল। তারা অনেকটা ব্রেখটিয়ান পদ্ধতিতে সেই চাপ মোকাবেলা করলেন। ইংরেজিতে এটাকে বলা হয় Slantwise Resistance। যেন মনে হবে তিনি আপনারই পকেটে, কিন্তু তিনি কেমন যেন অন্যদিকে হেলে আছেন। আপনি সরাসরি প্রমাণও করতে পারবেন না, আবার গিলতেও পারবেন না। আধাটা বেরিয়ে থাকবে। এই যেন মনে হবে, মরে গেছে, কিন্তু হঠাৎ করে জাইমা ইসলাম কিংবা রোজিনা ইসলামের মতো সাংবাদিকেরা চমকে দেয়ার মতো অনুসন্ধানী প্রতিবেদন হাজির করে ফেলেন।

এদের কথা বলে রাখলাম কারণ আমার বিশ্বাস এনারা রিজাইম বদলের সুবিধা নিতে ধেই ধেই করে নতুন সরকারের সাথে গলাগলি করতে বসবেন না। নীরবে নিভৃতে পেশাদারি সাংবাদিকতাই করে যাবেন। আজকে একজন ‘স্টার’ সাংবাদিককে দেখলাম একজন উপদেষ্টার সামনে বুম নিয়ে হাজির! আশপাশের লোকজনকে সরিয়ে দিতে দিতে বলছেন, তেলবাজির দিন নাকি শেষ!

আমার মনে হয় না। এই ফিল্ডে অসম্ভব স্কিল অর্জন করেছেন আমাদের ‘স্টার’ সাংবাদিকেরা। এখন গর্তে আছেন বটে, কিন্তু অচিরেই বুম নিয়ে এভাবে লাফ দিয়ে হাজির হয়ে যাবেন। সয়াবিন তেলের বদলে মে বি এক্সট্রা-ভার্জিন অয়েল ট্রাই করবেন।


জুলাই জেনোসাইড, লাল জুলাই : গানপার সংকলন
সুমন রহমান রচনারাশি

Support us with a click. Your click helps our cause. Thank you!

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you