১৯৯৬ সালের কথা। তখন সারাদেশে অবরোধ, বিক্ষোভ, অস্থির। আব্বার হুট করে এমন অস্থির সময়ে আমেরিকায় সরকারিভাবে যাওয়ার নাম আসে। আমরা তখন বগুড়ায়, আর উনি ঢাকায়। তখন তো মোবাইলের যুগ না, ল্যান্ডফোনের যুগ। আমাদের বাসায় ল্যান্ডফোনের লাইন তখনো আসেনি, এসেছে আরো পরে। মা আর আমরা দু-বোন আব্বার সাথে ল্যান্ডফোনে কয়েকদিন কথা বললাম যাওয়ার আগে, উনি অনেক চেষ্টা করেছিলেন যাওয়ার আগে আমাদের সাথে দেখা করে যাওয়ার, পারেননি। শেষের দিন কেঁদে ফেললেন। আম্মাকে বললেন — তুমি বাসায় যত ছবির অ্যালবাম আছে, লোক আসবে, পাঠিয়ে দাও। আম্মা, আব্বার এই আব্দার রক্ষা করলেন, দিলেন পাঠিয়ে অ্যালবাম। সেই বিয়ের পরের স্মৃতি থেকে শুরু করে আমাদের দু-বোনের ছোটবেলার অনেক স্মৃতি। আব্বা যেদিন আমেরিকায় যান, কীভাবে যেন এয়ারপোর্টে ওনার সব জিনিস হারিয়ে যায়, সেইসাথে হারিয়ে যায় আমাদের পারিবারিক সব স্মৃতি। পরে আব্বা অ্যাপ্লিকেশন করে এরজন্য কমপেনসেশন পান কিন্তু যে অমূল্য জিনিস হারিয়ে যায়, সেটা আর ফিরে পাওয়া হয়নি। উনি চারমাস পরে আমেরিকা থেকে ফিরলেন, আমার জন্য স্টেথোস্কোপ বিপি সেট নিয়ে, একটাই উদ্দেশ্য মেয়েকে ডাক্তারী পড়াবেন। আমি তখন অনেক ছোট, তবে আমার স্বপ্ন ছিল আমি পাইলট হব।
আমাদের দু-বোনের আরো একটা মজার স্মৃতি ছিল মেলার স্মৃতি। বগুড়ায় সব পুজোতে খুব ধুমধাম করে মেলা হতো। আব্বা আমাদের দু-বোনকে নিয়ে মেলায় যেতেন। আমরা ব্যাগভর্তি করে মাটির সব হাড়িপাতিল, ফলমূল নিয়ে আসতাম। মনে হতো দু-বোন রাজ্য জয় করা কোনো রাজার দুই রাজকন্যা। সাথে আনতাম ইয়া বড় বড় থালার মতো ভাজা পাপড়, আর আম্মার জন্য গুড়ের জিলাপি। আম্মা আমাদের তিনজনের ফেরার অপেক্ষায় থাকত। আমরা বাসায় ফিরে আমাদের ব্যাগ খুলে দু-বোনের সম্পদ দেখাতাম আম্মাকে খুব আনন্দ নিয়ে, আব্বা-আম্মা হাসত আমাদের খুশি দেখে।
একসময় আমাকে স্কুল পরিবর্তন করানো হলো। আম্মা দেখল আমি পড়ালেখা করছি কিন্তু অত সিরিয়াসলি না। এই স্কুলবদলই আমার জীবন পুরোটা বদলে দিয়েছিল। আমি আমার আগের পাড়ার স্কুলবান্ধবীদের থেকে আলাদা হয়ে গেলাম। প্রচুর পড়ার চাপ থাকত ক্যান্ট পাবলিকে। হোমটাস্ক, পড়া সব মিলিয়ে আমি ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়লাম, সেইসাথে বন্ধুবান্ধবহীন নিঃসঙ্গ। দিনশেষে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম।
’৯৮ সালের বন্যার কথা ভীষণ মনে পড়ে। ঐ সময় আব্বার চাকরিতে কী যেন একটা ঝামেলা হয়েছিল এবং পোস্টিং ছিল ঢাকায়। আম্মা ছোট দুটা মেয়ে নিয়ে অত বড় বাড়িতে একা। এক রাতের কথা মনে পড়ে। বাসায় কারেন্ট নাই কদিন ধরে, ওদিকে চার্জারলাইট, মোমবাতি, ঘরের খাবার চাল, সব্জি সবই প্রায় শেষ। হাঁটুর উপরে পানি। কী ভয়ঙ্কর অবস্থা! আম্মার মুখটা শুকনো হয়ে আছে, দোয়াদুরুদ পড়ছেন। আমরা পাশে বসে আছি। এমন সময় সালাউদ্দিনকাকা, আমাদের পরিবারের একান্ত দুঃসময়ের বন্ধু একজন, কোত্থেকে সেই পানি ভেঙে হাজির। এসে বললেন — ভাবী আপনাদের দেখতে আসলাম, এই অন্ধকারে বাগানবাড়িতে ছোট দুটো মেয়ে নিয়ে আছেন, কিছু কি লাগবে? আম্মার মনে হলো, আল্লাহতালা একজন ফেরেশতা পাঠিয়েছেন, কারণ পরদিন দুপুরে রান্না করার চালও ছিল না। আম্মা কাকাকে বলল — ভাই, আপনি এই রাতে এত পানি ভেঙে কীভাবে আসলেন? কাকা হাসলেন। কি কি লাগবে, আম্মা বলল। কাকা কিছুক্ষণ পর আবার সেই পানি ভেঙে ঐ রাতে জিনিশগুলি দিয়ে গেলেন। এর চারবছর পর কাকা হুট করেই মারা যান, — খুব বেশি বয়স হয়েছিল, তা না। সালাউদ্দিনকাকাকেও খুব মনে পড়ে।
ধীরেধীরে আমার এসএসসি পরীক্ষা এগিয়ে আসতে লাগল। টেস্ট পরীক্ষার পরে দাদা মারা গেলেন, পড়ালেখার কারণে দাদাকে শেষ দেখা দেখতে পারলাম না। দাদা বাসায় আসলে যখন আমি খুব ছোট, প্রতিদিন আমাকে নিয়ে বেড়াতে বের হতেন আর বলতেন — ও, বাবলী দাদু, চলো পুরি খেতে যাবে না? পুরি কিনে দিতেন একটা আর উনি খেতেন একটা। সেবার পরীক্ষা দিয়ে অপেক্ষা করলাম রেজাল্টের, আমার এসএসসি রেজাল্ট অনেক ভালো হয়েছিল।
ছকবাঁধা নিয়মে আরো কঠিন দিন আসলো, এইচএসসির জন্য আরো পরিশ্রম করতে থাকলাম। পরীক্ষা এগিয়ে আসতে থাকল, শীতের এক প্রচণ্ড শৈত্যপ্রবাহের সকালে প্রাইভেট পড়ে বাসায় ফিরতেই শুনলাম, দাদি মারা গিয়েছেন। ওনাকেও দেখতে যেতে পারলাম না পরীক্ষার জন্য। পরীক্ষা এসে গেল। পরীক্ষা দিয়ে মেডিকেলের অ্যাডমিশন পরীক্ষার জন্য কোচিং করা শুরু করলাম। ওদিকে বাবা চাকরি থেকে রিটায়ার্ড করলেন। পেনশন পেতে দেরি হচ্ছিল, ওদিকে আমার নানা জায়গায় অ্যাডমিশন, ছোটবোনের পড়ার খরচ, সংসারখরচ। সে-বছরও আমরা ভয়ঙ্কর কষ্টে পড়লাম টাকাপয়সার, যা বলার মতো না। সব কষ্টেরই একটা শেষ থাকে, আমাদেরও তাই হলো। বাবা প্রাইভেট একটা জব পেলেন। এর ভিতরেই এক ভোরে আমি নামাজ পড়ে কোরআন পড়ছিলাম, তখনই আমার ছোটবোন জোরে চিৎকার দিয়ে বলল — আপুনি, পেপার দিয়ে গিয়েছে, মেডিকেলে চান্স পাওয়াদের রেজাল্ট দিয়েছে। আমার মনে হচ্ছিল, আমার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, হার্টটা কেউ চেপে ধরে আছে। আমি অ্যাডমিট কার্ডটা নিয়ে রোল নাম্বার মিলাতে বসে গেলাম পত্রিকায়, একের পর এক মেডিকেল পার হয়ে যাচ্ছে, কারো মুখে কোনো কথা নেই। আমি, মা আর ছোটবোন গভীর মনোযোগ দিয়ে পত্রিকা দেখছি, অবশেষে আমার রোল নাম্বার পাওয়া গেল — শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, বরিশাল … সেখানে। বারবার রোলটা চেক করে দেখছিলাম, ঠিক আছে কি না। হুম অবশেষে আমি চান্স পেলাম মেডিকেলে। সবকিছুই সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক পূর্বনির্ধারিত। এবং এরই সাথে শুরু হলো আমার জীবনের এক নতুন অধ্যায়, শেষ হয়ে গেল আমার বগুড়ার অধ্যায়।
স্মৃতিগন্ধা রুমাল,তুমি আসলে কার?
লেপ্টানো চোখের কাজলই সম্বল যার।
কেনো ফিরে এসে কাদাও বারবার?
আমরা কি শুধুই দুজন দুজনার!!!
… …
- স্মৃতিগন্ধা রুমাল ৬ || সানজিদা শহীদ - September 12, 2020
- স্মৃতিগন্ধা রুমাল ৫ || সানজিদা শহীদ - September 4, 2020
- স্মৃতিগন্ধা রুমাল ৪ || সানজিদা শহীদ - August 26, 2020
COMMENTS