বত্তিরিশ শিরালায় নাগপঞ্চমীর মেলা || শক্তি চট্টোপাধ্যায়

বত্তিরিশ শিরালায় নাগপঞ্চমীর মেলা || শক্তি চট্টোপাধ্যায়

নাগপঞ্চমীর দিনে বৃষ্টি হবেই। স্বতঃসিদ্ধ। কেন হবে তা যেমন কেউ বলতে পারে না বুঝিয়ে, তেমনি আমাদের রথের দিনটাও। যুক্তিতক্কের বাইরে। দূরে হয়ে এই পর্যন্ত। আগস্টের ৩১ তারিখে নাগপঞ্চমী তিথি পড়েছিল। আমরা সকাল থেকে মিরাজের আকাশে মেঘের যাওয়া-আসা দেখছি কেবলই। দূরে সহাদ্রি পর্বতমালা ঝাপসা। মাঝেমধ্যে এক-আধপশলা বৃষ্টি যে ঝাঁট দিয়ে যাচ্ছে না, এমন নয়। কিন্তু, তা ধর্তব্যের মধ্যেই পড়ে না। অভিজ্ঞ ও শোনাকথার চাপ এখানে অনেক। প্রায় মুখে মুখে।

মিরাজ শহরটা কর্ণাটক আর গুজরাটের চাপে পড়ে মহারাষ্ট্রের মধ্যে সুড়ুৎ করে ঢুকে পড়েছে। সেই মিরাজের জেলা সাংগলি। বত্তিরিশ শিরালায় নাগপঞ্চমীর মেলা দেখতে যেতে হলে, প্রথমেই আমাদের সাংগলি ছাড়িয়ে কোলাপুর এবং এই কোলাপুর জেলার পশ্চিমভাগে পড়ে বত্তিরিশ শিরালা। সেখানেই নাগমেলা। মহারাষ্ট্র কেন, গোটা ভারতে এমন এক সুন্দর ভয়ঙ্কর মেলার কথা শুনিনি পর্যন্ত। দেখা তো দূরের কথা!

মিরাজ থেকে মেলাপ্রাঙ্গণ চল্লিশ কিমি। পথ ভালো নয়। গাড়িঘোড়া আর মানুষের ভিড়ে তার ওপর অগম্য। তবু যেতে হবে। এত কাছে থেকে এমন এক মেলা আঙুলের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে যাবে — তা হবে না। ফলে, যেতেই হবে। বাস মেলা থেকে বেশ দূরে থামবে। তারপর একহাঁটু কাদা। কাদায় কাদাময় গোটা মেলা। তার ওপর যদি বর্ষে, বিশ্বাস বর্ষাবেই, তাহলে তো সোনায় সোহাগা! পাঁঠাভেজা যাকে বলে, তেমনি ভিজতে হবে। হবে, হবেই। তবু, যাওয়া চাই।

যারা জানে বা শুনেছে এই মেলার কথা, তারা কাছে-দূরের গাঁ ভেঙে আসছে। আসছে পুনে থেকে সরাসরি বাস — অবশ্যই চার্টার্ড। রুট থেকে বেশিরভাগ বাসই উঠে গিয়ে আজকের জন্যে হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘মেলাবাস’।

নাগপঞ্চমী — নাগ ধরে সর্বচক্ষে প্রদর্শন করানোর মেলা। ভয়ঙ্কর খেলা। যারা ধরে এবং ধরে খেলা দেখায়, তারা কেউই সাপুড়ে বা বেদে সমাজের কেউ নয়, সাধারণ চাষিবাসী গৃহস্থ। গৃহ বা গৃহের আশপাশ থেকে মোক্ষম নাগ, রাজনাগ, গোখরো ধরে এই দিনটির জন্যে মটকা বা মাটির কলসিতে পুরে রাখে। সময়কাল পঞ্চমীর আগ পর্যন্ত একসপ্তা থেকে দুসপ্তা। যে নাগ ধরতে পারল না, সে ভাগ্যহীন বলে গাঁয়েগঞ্জে ধিক্কৃত হয় শুনেছি। ধরে মটকার পর মটকায় পুরে রেখে, সাজিয়ে গরুর গাড়িতে পতাকা বেঁধে মেলায় আসে। গরুর গায়ে জরি-চুমকি-সলমা বসানো চাদর। শিং-দুটো সিঁদুরে রাঙানো। কখনো-বা শিং ভরতি লাল-নীল কাগজ। গাড়ির ওপর দাঁড়িয়ে খেলা দেখাচ্ছে। সাপের অর্ধেকটা খেলোয়াড়ের হাতে লেজসুদ্ধ। বাকি অংশটা ফণা তুলে চাদরের ওপর গর্জমান। ফণার সামনে অথচ মোটামুটি দূরত্ব বজায় রেখে আরেকজন খালি কলসির সাইজের হাঁড়ির ভেতর কড়ি দিয়ে ‘ছন্দরেখে’ এপাশ-ওপাশ করছে। কড়ির বাদ্যি থামলেই ছোবল। ছোবল এড়াতে প্রতিমুহূর্তে কলসি পাশে সরিয়ে নিতে হচ্ছে। ছোবল পড়লে আর রক্ষে নেই। কলসি চুরমার। তবে তেমন-একটা অবাককাণ্ড দেখিনি। সাজানো গাড়িবলদের সামনে-পিছনে তাসা পার্টি, নয়টঙ্গিরও দেখা মিলল। আমাদের দুটো ছাতার তলায় বত্তিরিশজন মানুষ মাথা বাঁচাতে। দু-থাবড়া মেলালে তবে গোক্ষুরফণা। ফণার আশেপাশে টাকাপয়সা পড়ছে লুটের বাতাসার মতন। আমার মনে হলো সোনারূপোর চাকতি পড়লেও ক্ষতি ছিল না। এ যে কী ধরনের ভয়ঙ্কর ভয়াবহ ধরনের খেলা — যিনি না দেখেছেন, তিনি কল্পনাতেও আনতে পারবেন না। শুনলাম, প্রতিবারই দু-একজন ছোবল খেয়ে মারা যায়। অর্থাৎ অত্যুৎসাহ! অনেকক্ষেত্রে কাগজপত্রের আলোকচিত্রীও মারা গেছেন বলে শুনেছি নানা লোকের মুখে। স্থানীয় রিপোর্টারও দু-একজন মারা গেছেন। গাড়ির কাছে যেভাবে হুমড়ি খেয়ে পড়ে, তাতে এমন অঘটন ঘটা মোটেই বিচিত্র নয়।

মেলার মধ্যে এমন ধরনের সারি সারি গোটা-কুড়ি গরুর গাড়ি। প্রতি মটকায় খলবলে সাপ। সাপ মানে জাতসাপ। কুলোপানা চক্কর প্রত্যেকের। কারোরই বিষদাঁত ভাঙা হয় না। বিষ আহরণ করা হয় না। বোধকরি সেজন্যেই এ-বছর প্রথম পঞ্চায়েত অফিসে সাপের সংখ্যা নথিভুক্ত করা হয়। একদিনের মেলাফেরত নথি মিলিয়ে সাপ যেখান থেকে ধরা হয়েছে সেখানে ছেড়ে দেওয়া হয়। অনেক সময় সেদিন সন্ধ্যাতেই নয়, এক-আধদিন দেরিও হয়। মটকার ন্যাকড়াবাঁধা মুখ খুলে চুয়া চিটকেনা দেওয়া হয় খাদ্য হিসেবে। দুধ দেওয়া হয়। পাশেই জীবননাগ মন্দির। সেই মন্দিরেই পুজো। জীবননাগ শিব স্বয়ম্ভু। লক্ষ্মী প্রতিমায় আছে। কিন্তু, তাঁর মাথায় সাপের ফণাতোলা। বহু লোক নারকোল ভাঙে, সেই জলে জীবননাগের স্নান।

চতুর্দিকে বাড়িঘরে বারান্দায় লোক গিজগিজ করছে। অভিভূত দর্শনার্থী। গলি ধরে ফাগ-আবির খেলা চলছে। চারদিকেই এই ভয়ঙ্করতার মধ্যে মেলার ধুম।

এর মধ্যেই বসে গেছে অন্তত একশটি ফটোর দোকান। সেখানে ঢোঁড়া-ঢ্যামনা গলায় জড়িয়ে কত-যে মানুষবীর (!) ফটো তুলছে তার লেখাজোখা নেই। জিগ্যেস করে জানা গেল — সেদিনের দোকানপিছু রোজগার পাঁচ-সাতশ টাকা। এরই ফাঁকে ফাঁকে বসে গেছে মেলার আকর্ষণ তেলেভাজা মশলামুড়ি প্রভৃতি নানাধরনের ভাজাভুজির দোকানপাট। একদিনের বত্তিরিশ শিরালা মেলা সন্ধের মুখে-মুখেই খতম। সব দেখে মনে হলো, যেন মানুষজনের তুলনায় সাপই বেশি। সাপ এর কাঁধে, ওর গলা জড়িয়ে। এদের বিষ নেই।

গোসাপ যে সাপের মাসি এখানেই জানতে পারলুম। গাড়ির গায়ে একটা লাঠিতে আপাদমস্তক বেঁধে রাখা হয় তাকে — যতক্ষণ মেলা, ততক্ষণই। মেলা শেষে তার মুক্তি। বত্তিরিশ শিরালা মানে বত্তিরিশ গাঁ। জানি না, বত্তিরিশ গাঁ থেকে এ-বছর সাপ সংখ্যায় কত এসেছে। তবে, এই ভয়ঙ্কর মেলা রেকর্ড করতে খাস লন্ডন থেকেও ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিঙের লোক এসে গেছে দেখে আরো অবাক লাগল। বত্তিরিশ শিরালা কোথায় পৌঁছে গেছে আজ!

গানপারটীকা : নাগপঞ্চমীর মেলা নিয়ে এই নিবন্ধটা আহৃত শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘গদ্যসংগ্রহ-৪’ থেকে। ‘দেজ পাবলিশিং’ কলকাতা থেকে এই সংগ্রহ ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে বেরিয়েছে। এই খণ্ডে লেখকের কিশোরসাহিত্য সংগৃহীত হবার পাশাপাশি গৃহীত হয়েছে ব্যাপক পরিমাণে অগ্রন্থিত রচনা। নাগপঞ্চমী মেলা নিয়ে এই রিপোর্টধর্মী নিবন্ধটা অবিকল বর্তমান শিরোনামে শক্তিগদ্যসংগ্রহের অগ্রন্থিত রচনাংশে অ্যাভেইল করা যায়।

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you