প্রিয় খেজুরভাই ও তাঁর শাখাবরাক || উজ্জ্বল দাশ

প্রিয় খেজুরভাই ও তাঁর শাখাবরাক || উজ্জ্বল দাশ

বাংলাবাজার পত্রিকার চিঠিপত্র কলামে ছাপা হয়েছে ছোট্ট একটি স্লিপ : ‘বিদ্যুতের জ্বালায় অতিষ্ঠ নবীগঞ্জবাসী’। ক্লাস সেভেন পড়ুয়া সেই কিশোরকে খবরটা দিলেন স্থানীয় জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক এটিএম নূরুল ইসলাম খেজুর; সাথে আরও যোগ করলেন প্রশংসার বাণী, ভালো লিখেছ। এলাকার সমস্যার কথা তুলে ধরতে হবে! আরও লেখো!

কিশোরের বুকের ছাতি ফুলে ওঠে, ভৌঁ দৌড় — কোথায় মিলবে সেই কাগজ। আহা রে! নিউজ এককলাম দুই ইঞ্চি কিন্তু শেষে বড় হরফে নামটা জুড়ে দিয়েছে — উজ্জ্বল দাশ, নবীগঞ্জ, হবিগঞ্জ। নিউজের চেয়ে নামটাই খালি বারবার দেখেছি। কাগজ-হাতে পাড়াপড়শির বাড়িতে ঢোঁ, যেচে পড়ে দেখানো আর প্রশংসাসূচক কথা শোনার অপেক্ষা।

খেজুরভাইয়ের দেয়া সাহসটা মফস্বলের সেই কিশোরের জন্য বিশাল সাহস ছিল; ২৩ মে ২০১৫ প্রিয় মানুষটা না-ফেরার দেশে পাড়ি দিয়েছেন। খবরটা শুনেই থমকে গেছি। কিছুদিন আগে ফেসবুকে খেজুরভাই জিজ্ঞেস করেছেন, — ‘পিচ্চিটা কেমন আছে? — দেখতে দেখতে বড় হয়ে যাবে। — তোমরাও নাই, নবীগঞ্জে অনুষ্ঠানের তোড়জোড় নাই!! আসবা নাকি দেশে?’

চোখে ভেসে উঠছে ২০১৩-র অক্টোবর; খয়েরি রঙের পাঞ্জাবি পরে খেজুরভাই তাঁর কন্টিনেন্টালে ঢুকছেন। এসেই তাঁর চেনা ডাক, — জাকির, দুইটা লিকার চা কও! অনেক কথা হয়। বিলেতের খবর; স্থানীয় টুকিটাকি। আরও বলছিলেন, — প্রথমআলোর ছুটির দিনে লন্ডন অলিম্পিকে বাঙালিদের নিয়া তোমার স্টোরিটা খুব ভালো হইছে। তাঁকে বলি, সে-তো আপনার দেয়া সাহস খেজুরভাই। তিনি মুচকি হাসেন।

এপ্রিল ২০০০। নবীগঞ্জ জে.কে. হাইস্কুল প্রাঙ্গণে আমার সম্পাদনায় শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক অনুদ্বৈপায়ন ভট্রাচার্যকে নিয়ে স্মারক গ্রন্থ ‘মৃত্যুঞ্জয়ী প্রজ্ঞাবান’ বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠান। আয়োজক প্রিয় নবীগঞ্জ গণপাঠাগার। অনুষ্ঠানে এসেছিলেন শাবিপ্রবির ভিসি প্রয়াত হাবিবুর রহমান স্যার, বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহবুবুর রব সাদী, অধ্যাপক আবুল ফতেহ ফাত্তাহ, অভিনেতা পীযুষ বন্দ্যোপাধ্যায়, শাবিপ্রবির প্রয়াত অধ্যাপক গৌরাঙ্গ দেব রায় আর সভাপতিত্ব করছিলেন আমাদের প্রিয় শিক্ষক প্রয়াত আবদুল মতিন চৌধুরী। মূল প্রবন্ধ পাঠ করলেন বন্ধু কবি জাহেদ আহমদ। কলেজপড়ুয়া সম্পাদককে স্বাগত বক্তব্য রাখতে হবে! মঞ্চের পাশে সেদিনও খেজুরভাই কানে কানে বলছিলেন, ডরভয়ের কিছু নাই। আশেপাশে সবাই তো পরিচিতজন।

পত্রিকায় অনুষ্ঠান সম্পর্কে বিশদ লিখেছিলেন খেজুরভাই। এরই মাঝে একদিন তাঁর অফিসে ডেকে নিয়ে
পলিথিনে-মোড়ানো প্যাকেট হাতে দিয়ে বললেন, কোনোদিন কাজে লাগতে পারে কিংবা না-ও পারে, তবু তোমার কাছে রেখে দাও! প্যাকেট খুলে দেখি তাঁর সম্পাদনায় নবীগঞ্জ থেকে ১৯৮৫/’৮৭ সনের বের-হওয়া পত্রিকা শাখাবরাকের কয়েকটি কপি। তাঁকে বলি, আমি ছেলেমানুষ। কখন কোথায় হারিয়ে ফেলি? উত্তরে বললেন রাখো, হারবে না!

তাঁর প্রয়াণের খবর শুনেই ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে; — পত্রিকাগুলো আছে তো? নবীগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে ৩০ বছর আগে পত্রিকা বের করা বিশাল ব্যাপার ছিল। সেই সাহসটাই দেখিয়েছিলেন মফস্বল সাংবাদিকতায় সিলেটের পরিচিত নাম এটিএম নূরুল ইসলাম খেজুর।

তাঁর সম্পাদিত মফস্বলের সেই অনিয়মিত পত্রিকা শাখাবরাক বেশিদিন টেকেনি। বলি, তাতে কী! একটা সময়কে তো ধরে রেখেছে। অনেকে টিপ্পনী কেটে বলেন, খেজুর মিয়া সাংবাদিকতা কইরা কিচ্ছু করতে পারল না! আমরা সবাই জানি বিত্তবৈভব তাঁর ছিল না। প্রজন্মের কাছে তাঁর দায় ছিল; প্রজন্মই তাঁকে মনে রাখবে। আচ্ছা, চট করে বলতে পারবেন নবীগঞ্জের প্রয়াত দুই খ্যাতনামা জনপ্রতিনিধি আবদুল হক চৌধুরী ও দেওয়ান হাদী গাজীর উপজেলা নির্বাচনী লড়াইয়ের সেই প্রেক্ষাপট? ১৯৮৫ সালের ৮ মে শাখাবরাকে ছাপা হয়েছিল তাদের দুজনের সাক্ষাৎকার। আবদুল হক চৌধুরীর লাঙ্গল আর দেওয়ান হাদী গাজীর দাঁড়িপাল্লা প্রতীকের লড়াই।

ছাপার অক্ষরে সাংবাদিক খেজুর আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য তুলে রেখে গেছেন গবেষণার উপাত্ত। দূর পরবাসে ৩০ বছরের পুরানো জীর্ণ পত্রিকার পাতাগুলো যখন উল্টাছিলাম ভেতরটা খচখচিয়ে উঠছিল। নবীগঞ্জে শৈশব কেটেছে কিংশুক সাংস্কৃতিক সংগঠনের নাম শুনে; কালের আবর্তে আজ দুইদশক পার করা আমাদের প্রাণের সংগঠন আনন্দ নিকেতন এরই তো ধারাবাহিকতা।

১৫ এপ্রিল ১৯৮৭। শাখাবরাককে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে দেওয়ান হাদী গাজী বলেছেন, কিংশুককে একটি শিশুপাঠাগার করে দেয়া হবে। নানা সীমাবদ্ধতায় অগ্রজদের গড়া কিংশুক হয়তো টেকেনি; সেইসব দলছুট তরুণদলের প্রেরণায় আনন্দ নিকেতনে আজ হয়েছে শিশুতোষ পাঠাগার আনন্দভুবন । শাখাবরাকে অনেক বয়োজ্যেষ্ঠদের লিখনী দেখে নেচে উঠেছে মন; তাদের অনেকে এখনও লিখছেন। কারো কারো নামে এসেছে ঈষৎ পরিবর্তন। ৩০ বছর আগেকার লেখা হাতে পেলে কেমন লাগবে বলুন!

শাখাবরাকের কপিগুলো নিয়ে ফেসবুকে কথা হয় যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী সাহিত্যিক আহমেদ শাহাব চাচার সাথে; শুনলাম আরেক অজানা খবর। নবীগঞ্জের ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে সংরক্ষণ ও গবেষণার কাজে হাত দিয়েছিলেন প্রয়াত নন্দিত উপজেলা চেয়ারম্যান দেওয়ান হাদী গাজী। গবেষকদলে ছিলেন আবুল ফতেহ ফাত্তাহ, আহমেদ শাহাব, আবদুল আহাদ সাদী, সুভাষ দাশ প্রমুখ। প্রজেক্টের জন্য সামান্য অর্থবরাদ্দও হয়েছিল। তথ্যসংগ্রহের মাঝামাঝি পর্যায়ে প্রশাসনিক জটিলতায় বন্ধ হয়ে যায় কার্যক্রম।

তৃণমূল পর্যায়ে নানা সীমাবদ্ধতার মাঝে সাংবাদিক হিসেবেই জীবন পার করেছেন এটিএম নূরুল ইসলাম খেজুর — আমাদের প্রিয় খেজুর ভাই। আধুনিক সাংবাদিকতাপেশায় বৈচিত্র্য এসেছে। ফ্যাক্স, পোস্ট এখন সোনালি অতীত। সুদীর্ঘকাল খেজুরভাইদের মতো নির্ভীক সাংবাদিকদের শ্রমঘামের উপর ভর করেই খোলস পাল্টাচ্ছে চ্যালেঞ্জিং এই পেশা। নবীগঞ্জ তথা হবিগঞ্জ জেলার লেখক, সাংবাদিক, সংস্কৃতিকর্মীরা প্রজন্মের স্বার্থে তৃণমূল পর্যায়ের সেইসব কীর্তিমান নেপথ্যনাবিকদের কথা তুলে ধরবেন সেই আশা রইল।

জয়তু শাখাবরাক; জয়তু সাংবাদিক এটিএম নূরুল ইসলাম খেজুরের দায়বোধ ও সঙ্কল্প!

… …

উজ্জ্বল দাশ

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you