হাওরের সংস্কৃতি, হাওরের গান || সুমনকুমার দাশ

হাওরের সংস্কৃতি, হাওরের গান || সুমনকুমার দাশ

গ্রীষ্মে হাওরের যে-অংশ দিয়ে হেঁটে যেতে হয় বর্ষায় সেখানে মাথাসমান পানি। হেমন্তে যে-জায়গায় হালচাষ করেন কৃষকেরা, বহু কষ্টে ফসল ফলান, ভরবর্ষায় সেখানটাতেই জেলেদের উত্তাল ঢেউয়ের সঙ্গে বুক চিতিয়ে পথ চলতে হয়। পূর্বপুরুষদের মতন উত্তরসূরিরাও প্রকৃতির বিচিত্র খেয়ালের সঙ্গে লড়াই করে বেড়ে ওঠেন। সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা — এই সাতটি জেলার প্রায় কোটি মানুষ হাওরপারের বাসিন্দা। জীবনযাপনে দুর্ভোগ এখানে চরমে, প্রকৃতির জোয়ার-ভাটায় প্রভাবিত হয় এঁদের জীবন। কখনও অকালবন্যা, কখনও খরা কিংবা শিলাবৃষ্টিতে নষ্ট হয় একমাত্র বোরো ফসল। তবু জীবন থেমে নেই। শত দুঃখ-কষ্ট সত্ত্বেও স্বপ্ন আর আশার যুগপৎ মৌতাতে মগ্ন হাওরবাসী। প্রকৃতির আপন খেয়ালেই এখানে কথা তৈরি হয়, গান সৃষ্টি হয়। মালজোড়া, ঢপযাত্রা, পুথিপাঠ, কিচ্ছা, মনসা পালা, ধামাইল, কীর্তন — কী নেই! প্রকৃতির প্রভাবে বাউল গেয়ে ওঠে গান, নানা বিচিত্র পাখির কলকাকলিতে মুখরিত হয় চারপাশ, ফল-ফুলে সুশোভিত হয় পল্লিবাংলা। এই হলো হাওর, এই হলো গান, এই হলো আবহমান বাংলার ঐতিহ্য।

হাওর মানেই নানা ‘পরব’। ‘বারো মাসে তেরো পার্বণ’ — বহুল প্রচলিত এ বাক্যও যেন এখানে অনেকটা মিথ্যে! প্রচারমাধ্যমের-অন্তরালে-থাকা একেকজন রাধারমণ, উকিল মুনশি, শাহ আবদুল করিম, সাত্তার মিয়া, কামাল উদ্দিন, প্রতাপরঞ্জন তালুকদারের প্রভাব ও প্রতিষ্ঠা এখানে অপ্রতিরোধ্য। একতারা, ডুগডুগি, করতাল, ঢোলের শব্দ এখানে নিত্য ঢেউ তোলে, রক্তে কল্লোল জাগায়। এই ঢেউয়ে ডিঙি ভাসান হাওরবাসী। যখনই মনটা বাঁক নেয় তখনই চাঙা করে গান, এটাই হাওরের চিরায়ত প্রবণতা। আহমদ মিনহাজ ঠিকই বলেছেন, ‘ভাটি, আক্ষরিক অর্থেই গানের দেশ, গান এখানে আপনিই খেলে — নদীর সর্পিল পরিবেষ্টনে, শস্যের সমাহারে, হাওরের রাশি রাশি জলের ফেনায় অভিনব এই দেশটিতে প্রকৃতি তার আপন প্রয়োজনেই গান ফলায়, হাওরের ঢেউয়ের সঙ্গে ওঠে গানের ঢেউ […]। ভাটির মানুষ গান ভালোবাসে, ভালোবাসে গানের ভাও রপ্ত করে নিতে।’ তাঁর ভাষ্য আরও উদ্ধৃত করা যায় :

“ভাটি বিচিত্র, তার প্রকৃতি বিচিত্র, প্রকৃতির সঙ্গে যুঝে-যাওয়া মানুষগুলো আরও বিচিত্র — নদী এখানে জীবনের উপমা, আর হাওর — সে তো উপমার অতিরিক্ত। […] অবিশ্রান্ত বর্ষণ না হলে ভাটি জাগে না, জনপদ তছনছ করে দেয় এমন ঢল না এলে ভাটির হাওরগুলো কথা কয় না — হাওর এই দেশে মাটিকে টানে ফসলকে টানে মানুষকে টানে, মানুষের কণ্ঠের গানকেও টানে। ভাটির মানুষ জানে বর্ষণ হবে, হাওর সমুদ্রের বিলাস আনবে; কোথাও পা ফেলার একরত্তি মাটি থাকবে না এবং তারা মন থেকেই জানে, হয়তো-বা এ তাদের রক্তের কণায় কণায় ঢুকে গেছে যে হাওরের উতরোল ঢেউয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাঁচতে হয়, মাছের জন্য জাল ফেলতে হয় এবং আগামী দিনটির জন্য অপেক্ষা করে যেতে হয়।

অপেক্ষায় কি ক্লান্তি আসে? হ্যাঁ, আসে। ভাটির মানুষদের চোখেমুখেও ক্লান্তির ঝাপটা লাগে, তাদের শরীরে জলের আঁশটে গন্ধ লাগে, বসতিগুলো জলের ফেনিল তরঙ্গে নীরবে ফুঁসতে থাকে — ভাটিতে অভাব বাড়ে, দারিদ্র্য বাড়ে, নিরন্ন শিশুর চোখে রাজ্যির কাতরতা বাড়ে — এরই মধ্যে ঋতু থেকে ঋতুতে ভাটির জীবন ঘুরে চলে — ভাটিতে মেলা হয়, নৌকাদৌড় হয়, গান হয় — অনেককিছু হয়, অনেককিছু হারিয়েও যায়।”

দুই
পানিসংলগ্ন স্বতন্ত্র সংস্কৃতির ক্রমধারা বিকাশে বাংলাদেশের হাওরাঞ্চল একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূখণ্ড। আবহমানকাল ধরে হাওরাঞ্চলের আচার, ব্রত, উৎসব, লোকাচার, নাট্যরীতি, গীতরীতি কিংবা নৃত্যধারা বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে, বিশেষত লোকসংস্কৃতি ও সাহিত্যকে সচল, সজীব এবং প্রাণবন্ত রেখেছে। এ প্রাণবন্ত ধারা দেশের লোকসংস্কৃতিকে শুধু পরিপক্ক করেনি বরং হাজার বছরের সুপ্রাচীন বাঙালি সংস্কৃতির লোকায়ত ধারায় এনেছে বৈচিত্র্য ও ঐশ্বর্য।

হাওরসংস্কৃতির অন্যতম এক উপাদান বিবাহ-উৎসব। এ অনুষ্ঠানে হাওরপারের জনজীবনের সকল আনন্দের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। কৃষি ও মৎস্যনির্ভর এ অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষের মাঝে একেকটি বিয়ে উৎসব হিসেবে আবির্ভূত হয়। এ উৎসবকে কেন্দ্র করে হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে নানা লোকাচার ও নৃত্য-গীতের আয়োজন হয়ে থাকে। মুসলিম সম্প্রদায়ের ‘বিয়ের গীত’ আর হিন্দু সম্প্রদায়ের ‘ধামাইলগান’ প্রায় একসূত্রে গাঁথা। হিন্দু গীতিকারদের লেখা ‘বিয়ের গীত’ যেমন পরিবেশিত হচ্ছে তেমনি মুসলিম গীতিকারদের লেখা ‘ধামাইলগান’ বিয়ের উৎসবে গীত হচ্ছে। সুপ্রাচীনকাল হতে উভয় সম্প্রদায়ের বিবাহ-উৎসবে আয়োজিত লোকাচারের প্রায় সব ক্ষেত্রেই সংযোগ থাকার কারণে বৃহত্তর হাওরাঞ্চলের মানুষদের অসাম্প্রদায়িক চেতনা, মনোভাব ও সংহতি বর্তমানেও রক্ষা পাচ্ছে। বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজ-সংস্কৃতি নানাভাবে বিপর্যস্ত; তা সত্ত্বেও বিয়েসংস্কৃতিতে বিন্দুমাত্র ছেদ পড়েনি। আর সেটা সম্ভব হয়েছে এ অঞ্চলের মানুষজনদের অভিন্ন রুচি ও সংস্কৃতির সঙ্গে আত্মিক-সম্পর্ক থাকার কারণে। বহু শতাব্দী ধরে প্রবহমান বিবাহ-উৎসবে বিভিন্ন আচার, অনুষ্ঠান, সংগীত ও নৃত্য এখানকার মানুষদের জীবনচর্যায় প্রাধান্য বিস্তার করে চলেছে। তাই অতি সহজে এর বিনাশ হতে পারে না।

বাউলগান হাওর-সংস্কৃতির এক অমূল্য সম্পদ। শুধু হাওর নয়, বরং বাংলা ভাষাভাষী সব অঞ্চলেই বাউলগানের প্রভাব রয়েছে। তবে অনান্য অঞ্চলের তুলনায় পানিসংলগ্ন হাওরাঞ্চলে বাউল ও বাউলগানের প্রভাব আরও বেশি। বছরের প্রায় সাতমাস এ অঞ্চলের কৃষিজীবী-মৎস্যজীবী মানুষ পানিতে আবদ্ধ থাকেন। এ সময়টায় তাঁরা পুরোপুরি অবসর যাপন করেন। আর এই অবসরে গ্রামে গ্রামে প্রায় রাতেই মালজোড়া ও বাউলগানের আসর বসে। সারা রাত চলে এ আসর। ফলে এ অঞ্চলে বাউলদের আধিক্য এবং প্রভাব অনেকটা স্বাভাবিক।

গ্রামগুলোতে উৎসব মানেই শ্রোতা/দর্শনার্থীদের উপচেপড়া ভিড়। সেটা হোক গানের আসর কিংবা ধর্মীয় কোনও আচার-অনুষ্ঠানভিত্তিক উৎসব। সারাদিনের কর্মক্লান্ত মানুষেরা সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে কথা ও সুরের মালায় নিজেদের জীবনকে গাঁথার চেষ্টা করেন। সেখানে লোকশিল্পীদের কণ্ঠের গান হাওরবাসীর কাছে মোহনীয় রূপে হাজির হয়।

যাত্রাপালা কিংবা হিন্দুধর্মীয় আখ্যানমূলক ঢপযাত্রা এখানকার লোকসংস্কৃতির আরেক শক্তিশালী উপাদান। বিভিন্ন ধর্মীয়, সামাজিক ও ঐতিহাসিক ঘটনাকে উপজীব্য করে যাত্রাপালার কাহিনি তৈরি হয়। সাধারণত বর্ষামৌসুমে হাওরের গ্রামগুলোতে যাত্রাগানের আসর বসে আর দুর্গাপূজা, মনসাপূজা, কালিপূজা সহ বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসবে ঢপযাত্রা পরিবেশিত হয়। এছাড়া হিন্দু সম্প্রদায়ের পাঁচালি ও পদ্মপুরাণ পাঠ, কীর্তন, পালাগান, গোষ্ঠগান, দোলের গান, হোরিগান, সূর্যব্রত উৎসবও মানুষ টানে। ধর্মীয় উৎসব হলেও শিল্পীদের শ্রুতিসুখকর পরিবেশনার গুণে এক আলাদা শৈল্পিক মাধুর্য সৃষ্টি হয়। বর্ষা মৌসুমে নৌকাবাইচ, পুথি, কিসসা, কবিগান, গুরমাগান, ঘাটুগান, নাতগান, শিলুক, জারি, সারি এবং গাজির গানও বেশ জনপ্রিয়।

শুষ্ক মৌসুমে কৃষকেরা যখন গরু নিয়ে মাঠে যান তখন মনের আনন্দে ভাটিয়ালি গানে টান দেন। কিংবা ধান চাষাবাদ ও কর্তনের সময়টা হাওরে ‘শস্যোৎসব’ হিসেবে পরিচিত। এ সময়টাতে হাওরের মানুষজন কৃষিভিত্তিক ও শস্যকেন্দ্রিক নানা আচার-অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। যেমন — হিরালি, নবান্ন, চৈত্র সংক্রান্তি, ধানমাড়াই উৎসব, গরুর লড়াই, ঘুড়ি উড়ানো। হাওরে এখনও নগরের ছোঁয়া লাগেনি, তাই এসব উৎসব এদের কাছে বিনোদন হয়ে হাজির হয়। ঈদোৎসব কিংবা শারদোৎসব এখনও হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে অন্যতম মিলন।

তিন
নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জ উপজেলার জালালপুর গ্রামের উকিল মুনশি হাওরাঞ্চলের ডাকসাইটে বাউল ছিলেন, অথচ প্রায় অজ্ঞাত জীবনযাপন করে গেছেন। তাঁর একটা গান : ‘রজনী প্রভাত হলো ডাকে কোকিলা / কার কুঞ্জে ভুলিয়া রইলাম / শ্যাম চিকনকালা / আতর গোলাপ দিয়া সাজাইলাম বাসর / ফুলের শয্যা হইল বাসী, নইলে প্রাণেশ্বর / কি করি এখন কোনও দুশমনে / বাঁকে বাঁধে আমার প্রাণধন / কারে দেখে জুড়াই জীবন / কালযমুনা ঝাঁপ দিয়া মরণই ভালা / আগে যদি জানি বন্ধু করিবে এমন / তবে কি দিতাম তারে জীবনযৌবন’। এই গানটা শিল্পীরা যেমন দরদ দিয়ে গান, মানুষজন তেমন শুনতেও পছন্দ করেন। আজও হাওরের মানুষেরা রশিদ উদ্দিন, কবিয়াল মদন সরকার, লাল মামুদ, হারাইল বিশ্বাস, আতর চান্দ, মিরাস উদ্দিন, আমির উদ্দিন মুনশি, দীন শরৎ, জালালউদ্দিন খাঁ, বিতলং সাধু, সুধীর বাউল, ফুল বানু, কালা শাহ, শাহ আবদুল করিম, আবদুর রশিদ মাস্তান, আবদুল জব্বার বয়াতি, শফিকুন্নুর, কফিলউদ্দিন সরকার, রোহী ঠাকুর, আবদুর রহমান সহ কতশত খ্যাত-অখ্যাত বাউলের লেখা জনপ্রিয় সব গান শুনে উদ্বেলিত হন। শহুরে মানুষেরা সেসবের কতটুকুই-বা জানেন? হাওরের বিশালতা যেমন মাপা সম্ভব নয়, তেমনি এখানকার লোকগানের ব্যাপ্তি কতটুকু সেটা হাল-আমলের শহুরে ‘ডিজিটাল সংস্কৃতি’ লালনপালনকারী তরুণেরা কি অনুভব করেন? তবে সেটা ভিন্ন বিতর্ক। আশার কথা হচ্ছে — সব মিলিয়ে হাওরের উৎসব এখনও জমজমাট, সেটাই বরং আমাদের পরম প্রাপ্তি।

শীর্ষপ্রচ্ছদের চিত্রশিল্পী সত্যজিৎ রাজন

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you