ইউটিউব-এ আনুষ্ঠানিকভাবে অবমুক্ত গ্যাব্রিয়েল সুমনের চন্দ্রগ্রস্ত গানটি শ্রবণের পর মনে হচ্ছে দেরিতে হলেও হাওয়াকাঠের ঘোড়ার কবি ঠিক জায়গায় কদম রাখতে পেরেছেন। সুমনের সঙ্গে ব্যক্তিগত চিন-পরিচয় নেই। কবি হিসেবে তাঁকে জানি, পরিচয় বলতে এটুকুই। হাওয়াকাঠের ঘোড়া একসময় বেশ আগ্রহ নিয়ে পাঠ করেছিলাম। ভালো লেগেছিল পড়ে। অনলাইন সাইটে নানান সময় তাঁর কবিতা ও বাতচিত চোখে পড়েছে। এই সুবাদে জানা ছিল কবিতা ছাড়াও সুমন আরো অনেক কিছুর সঙ্গে নিজেকে সংযুক্ত রাখতে ভালোবাসেন। তিনি গান করেন। ছবি আঁকেন। সিনেমা তৈরির বিদ্যায়ও বহু বছর ধরে হাত পাকাচ্ছেন। আপনা খেয়ালে তাঁর এই বহুমাত্রিক বিচরণের মাঝে কবি পরিচয়টি ছাড়া বাদবাকি পরিচয়কে পাখির চোখ করে জানা-বোঝার সুযোগ হয়নি। এটা অবশ্য মনে হয়েছিল,—তাঁর এই গান করা, ছবি আঁকা বা সিনেমা বানানোর খোয়াবঘোর অভিযানটি প্রকারান্তরে হাওয়াকাঠের ঘোড়ায় বোনা সিনেমাটিক স্কেচের সম্প্রসারণ বৈ অন্য কিছু নয়। সুমন হয়তো অপেক্ষায় আছেন সেই গান অথবা সিনেমাটার জন্ম দিতে যার জন্য তাঁর এই কবিতাযাপন।
পাঠক হিসেবে কবিতার সঙ্গে আমার বনিবনা নিবিড় নয়। কালেভদ্রে হয়তো পড়ি। গ্যাব্রিয়েল সুমন সেই অনিয়মিত-অধারাবাহিক পাঠের অংশ হয়ে এতদিন টিকে ছিলেন। তাঁকে আচমকা যখন যেটুকু পড়েছি তার সিংহভাগকে ব্যক্তিসত্তার মনোবিশ্বে জায়মান দৃশ্যচিত্রে ঠেকনা দিয়ে দাঁড়ানো স্ক্রিপ্ট মনে হয়েছে আমার। তারা কবিতা, গান কিংবা সিনেমা হয়ে ওঠার চেয়ে সুমনেরই বানানো পাঁচ মিনিটের স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবিতে দেখানো জীবনের মতো নিজের ভবিতব্য তালাশ করছে। A Short Film About Nothing-এ দর্শক জলে-ভাসা দুটি কাগজের নৌকা দেখতে পায়। তারা সেখানে পরস্পর আলাপে লিপ্ত থাকে। আকাশে পাখি হয়ে উড়ান দিতে নয়তো জলে ভাসতে-ভাসতে জগৎ নামক নিঃসীম প্রশ্নবোধকের কাছে ফিরে আসার সম্ভাবনা নিয়ে আলাপ করতে-করতে জলের মধ্যে ভাসে আর ডোবে তারা। আলাপটা সেখানে প্রগলভ নয়, একে অন্তর্মুখী বলে দাগানোই সংগত মনে হয়। কবি-গায়ক-সিনেমাকার হয়ে উঠতে থাকা সুমনের ব্যক্তিসত্তা জুড়ে সক্রিয় এই অন্তর্মুখী উৎসারণ বা আরো পরিষ্কার করে যদি বলি, কবিতায় তাঁর অহং প্রকাশের ধরনটা আমায় টানে। ধরাবাঁধা মাপের বাইরে নিজেকে নিক্ষেপের ঝুঁকি তিনি নিয়েছেন এবং তার জন্য দুর্বিনীত বা অন্যের কাছে উপদ্রব রূপে বিদিত হওয়ার বদনাম মাথায় নিতে পিছপা হচ্ছেন না। প্রচলিত পথে হাঁটতে অভ্যস্ত কবিরা সচরাচর জনপরিতুষ্টির বেদিতে নিজেকে বলি দিয়ে থাকেন, ওই পথের বাইরে নিজেকে নিক্ষেপ করায় সুমনের কপালে জনপরিতুষ্টি ও পরিতোষক জোটার সম্ভাবনা ক্ষীণ। হাওয়াকাঠের ঘোড়া পড়তে বেশ লাগার পেছনে কবির এই বিপরীতমুখী অবস্থানের ভূমিকা থাকলেও থাকতে পারে।
চন্দ্রগ্রস্ত গানটার ব্যাপারে দুকথা বলার আগে গ্যাব্রিয়েল সুমনের কবিসত্তার দিকে অগত্যা একবার ফিরে তাকানো যেতে পারে। গানটির উৎসারবিন্দু যদি বলি তবে সেটা তাঁর কবিসত্তাকে বাদ দিয়ে যেহেতু ঘটেনি, আপাত অপ্রাসঙ্গিক আলাপটা আশা করছি বিরক্তির কারণ হবে না। চন্দ্রগ্রস্ত যদি সুমনের কবিসত্তাকে রিকল করার উপলক্ষ হয়ে থাকে তাহলে এটা মেনে নিতেই হবে, দেশ-কাল-পরিপার্শ্ব বিষয়ক সচেতনার স্বীকৃত মাপে সত্তাযাপনের নিগূঢ় অভিজ্ঞতাকে পাঠ যাওয়ার সুযোগ কবি বড়ো একটা রাখেন না। তাঁর ভাষায় নিজের আত্মচরিত তিনি লিখেন কবিতায়। আত্মচরিতটা এইবেলা প্রসারিত হতে চাইছে ওইসব কবিতা, গান, ছবি কিংবা সিনেমায়, যারা এখনো রচিত হচ্ছে নয়তো রচিত হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। এমনকি এটাও ঘটতে পারে, তারা হয়তো কোনোদিনই আলোর মুখ দেখবে না! রচিত হবে না। চন্দ্রগ্রস্ত-এ সুমন নিজেকে নিয়ে নিজের এই ক্যামোফ্লেজটা ধারণ করেছেন, গানটি শোনার ক্ষণে যার অভিঘাত কানে ঘাই দিয়ে যায়।
স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবিতে জলে-ভাসা কাগজের নৌকাদের আলাপে মগ্ন রাখা সুমন সমান্তরাল কোনো এক রেখায় দাঁড়িয়ে চিরকালের অতীতে গুম-হয়ে-থাকা চিরবর্তমান পৃথিবীকে দেখে চলেন। জলে-ভাসা কাগজের নৌকার পাশাপাশি শব্দহীন আলাপ ও সঞ্চারণে নিয়োজিত একজোড়া মানব-মানবীর শৈশব-তারুণ্য ও সাংসারিক রূপান্তরকে ক্যামেরা সেখানে ফ্রেমবন্দি করে। বার্তাটা পরিষ্কার,—প্রাণবান পৃথিবী ও তার পরিপার্শ্বে সচল জীবনস্রোত বুদবুদের মতো জলে নয়তো হাওয়ায় নিরুদ্দেশ হতেই পারে। লোকজন একে মরণযাত্রা ভেবে সন্ত্রস্ত হয় সচরাচর, যদিও ভালো করে ভেবে দেখলে মরণটাই জগতের প্রবহমান থাকার আয়ুধ হয়ে দাঁড়ায় শেষতক!
জীবনের অপার রহসময়তা স্বয়ং জীবনের মধ্যে সক্রিয় থাকে না। আকাশে ভাসিয়ে দেওয়া হাওয়াই বেলুন আর জলে ডুবে-ভেসে ডাঙায় গোত্তা খাওয়া কাগজের নৌকার দিকে তাকালে বিষয়টা খানিক টের পাওয়া যায়। রূপান্তরের খেলা চলছে সেখানে। যা-কিছু সময়টানে হারিয়ে গেল বলে ধরে নিচ্ছি তারা কি আসলেই হারায় কোনোখানে? নাকি হারিয়ে যাওয়ার ক্ষণে অবিকল আগের অবয়বে ফেরত আসে এখানে অথবা অন্য কোথাও? এ-রকম এক জিজ্ঞাসার চক্করে পড়ে টিএস এলিয়ট সময়কে একইসঙ্গে বৈনাশিক ও সংরক্ষক ভাবতে মজবুর হয়েছিলেন। Time the destroyer is time the preserver;—সুমনের স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি এলিয়টের অমর উক্তির প্রতিধ্বনি করছে এমন নয়, তবে ছবির অন্তে পৌঁছে কাগজের নৌকার দুটি থেকে অধিক সংখ্যায় ফেরত আসার ঘটনায় যে-রহস্যময়তা মৌন থাকে সেটাই হয়তো সত্তা ও অস্তিত্বের প্রকৃত সুর। চন্দ্রগ্রস্ত গানের রকাবেশবিভোর আবহে যার রেশ সুমন বহমান রাখছেন এইবেলা।
ক্যামেরার ফ্রেমে আটক একজোড়া মানব-মানবী, অনুমান করাই যায়, এভাবে নিজের অজান্তে অবোধ বালক-বালিকা থেকে সুবোধ সাংসারিক হওয়ার মাঝে মরণের দিকে এক-পা দুই-পা করে আগাতে থাকবে। মরণপ্রবাহে নিগমন নেওয়ার ক্ষণে কাগজের নৌকারা ওদিকে ডুবে-ভেসে ডাঙায় কিনারা খোঁজে। এবং তারা অপেক্ষায় থাকে এক বালিকার। বালিকাটি একদিন তাদের জলে ছেড়ে দিয়েছিল আর সেখান থেকে ফের হাতের তালুতে উঠিয়ে নিচ্ছে! একটা প্যারালাল পৃথিবী দর্শক আসলে দেখে, জীবন যেখানে জলে-ভাসা কাগজের নৌকা। এমনটা হবে হয়তো, কাগজের নৌকারাই হচ্ছে জীবনের প্রাগৈতিহাসিক আত্মচরিত। ঘটে যাওয়া, ঘটতে থাকা অথবা ঘটতে পারত কিন্তু ঘটে নাই, এ-রকম সব ঘটনার বীজ মনে হচ্ছে সুমনকে দখলে রাখে। ব্যক্তিসত্তার গহিন কুহরে জায়মান একান্ত পৃথিবী, বিনয় মজুমদারের ফিরে এসো চাকাকে চকিত স্মরণ করতে বাধ্য করে এমন এক পৃথিবী, দৃশ্যমান জগতে অদৃশ্য যত খেলা চলছে সেগুলোকে চর্মচক্ষে জীবিত ও সবাক হতে দেখার বিস্ময় জাগিয়ে তুলতে জানে এ-রকম কোনো পৃথিবীকে হাতের নাগালে পাওয়ার প্রেষণা বোধ করি কবিকে টানে। তাঁর এই টানকে অতঃপর আত্মচরিত বলব নাকি মনোলোগ সে-কথা ভেবে মন বিচলিত হয়।
দৃশ্যমান নিরেট পৃথিবী ও তার আশপাশের সঙ্গে গ্যাব্রিয়েল সুমনের সম্পৃক্ত হওয়ার ধরনকে এই জায়গা থেকে বিবেচনা করলে ভিন্ন মানতে হয়। নিজেকে সে সম্পৃক্ত রাখে এমন এক পার্থিবতায় যাকে অপার্থিব ভাবার সুযোগ থাকে না। একে বরং আধিদৈবিক ভাবতে বেশ লাগে। আশপাশের সঙ্গে স্বকৃত আত্মবিরোধ কবিকে অন্যপথে অন্য এক পৃথিবীর দিকে নিয়ে চলে। এই পৃথিবীর শরীর কেমন সেটা সকলসময় ঠাহর করা কঠিন হয়। ভ্যানগগের আঁকা ছবির মতো রঙের স্থানচ্যুতিকে সে হয়তো পিয়ার করে। সোনালি গমখেতে কাকের বেদম উড়ানের মধ্যে ভ্যানগগ মৃত্যুকে রাজ করতে দেখেছেন। মেঘকে অন্য রঙে এঁকে সেই রংকেই মেঘের প্রকৃত শরীর বলে বুঝে নিতে মরিয়া থেকেছেন আজীবন। সুমনের শিল্পযাপনের মধ্যে এ-রকম একটা সাইকিক জার্নি পাঠকের মালুম হওয়ার কথা। জার্নিটা যারপরনাই ব্যক্তির মনোবিশ্বে পয়দা হওয়া আজব জগতে পাঠককে সফর করতে বলে। জগৎটাকে যেখানে কবিতার রংবাজির চেয়ে সিনেমাটিক স্কাল্পচার-এ খোদাই কিছু ভাবার ভ্রমে মন আবিষ্ট হয়। তাঁর প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ হাওয়াকাঠের ঘোড়া এ-রকম এক চন্দ্রাহত বোধি সঙ্গে করে পাঠকের কাছে নিজেকে দাখিল করেছিল। বোধিটা অদ্য ইউটিউবে অবমুক্ত গানে আধিদৈবিক মিউজিক কম্পোজিশন ও গায়কির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিজেকে চন্দ্রগ্রস্ত ঘোষণা দিতে বাকি রাখেনি।
…
ইংরেজি Lunatic কিংবা Moonstruck সরাসরি যে-অর্থ বহন করে তার ধাক্কা বাংলা চন্দ্রাহত, চন্দ্রগ্রস্ত-এ মনে হচ্ছে অতটা প্রবল নয়। ইংরেজিতে চাঁদপাগলা মানে হচ্ছে এমন লোক যার দেহ ও আত্মা নিজ নিয়ন্ত্রণে থাকতে নাচার। অশুভ ছায়া সেখানে বিস্তারিত। ছায়াপ্রভাবে জগতের সঙ্গে বোঝাপড়ার দম সে হারায়। তাকে তখন অফুরান নাবিকের মতো ক্লান্তপ্রাণ ও ত্যক্ত দেখায়। পরিণামে সে ক্রমশ নিজের ভিতরে গুম হয়। স্কিৎজোফ্রেনিক খ্যাপামির সঙ্গে যার তুলনা টানা যায় হয়তো! বাংলায় চন্দ্রাহত বা চন্দ্রগ্রস্ত-এ এমতো বিগারের ধাক্কা অধিক প্রবল নয়। ইংরেজি Lunatic বা Moonstruck বলতে লোকে যেমনটা বোঝে, সুমনের হাওয়াকাঠের ঘোড়া ও পরবর্তী কবিতাযাত্রাকে যারপরনাই এ-রকম একটা কিছুর সহগামী ভাবা কঠিন ঠেকে। অহঙের প্রাবল্য থাকলেও দুর্মর খ্যাপামির চাপ তাঁর কবিতায় প্রকট নয়। কবির ব্যক্তিসত্তার প্রতি পরতে লতার মতো জড়িয়ে থাকা অহংটা সেখানে চন্দ্রাহত হওয়ার কারণে পরাভূত পাখির ছবি আগে চোখে ভাসিয়ে তোলে। চন্দ্রগ্রস্ত গানের ক্ষেত্রেও ঘটনা সমান। খ্যাপামির পরিবর্তে চোরাবিষাদ আর হাহাকারঘন মগ্নতা শ্রোতাকে কাবু রাখে সেখানে।
Lunatic নিজের পরিপার্শ্বকে সর্বাগ্রে প্রত্যাখ্যান করার মধ্য দিয়ে উন্মাদ কালযাপনে সর্বহারা হয়। চন্দ্রগ্রস্ত ও চন্দ্রাহতরা (আমার ধারণা) উলটো পথে হাঁটেন। তাদের জীবনজার্নিকে সুমনের হাওয়ামোড়ক কবিতার সহগ ভাবা যেতে পারে। যা-কিছু মিলেঝুলে এই জগৎসুন্দর এবং আরো যা-কিছু সেখানে যুক্ত হতে পারত কিন্তু এখনো যুক্ত হয়নি অথবা যুক্ত হওয়ার সামূহিক সম্ভাবনা সত্ত্বেও কখনো যুক্ত হবে না, এ-রকম এক আবেশ যেখানটায় প্রগাঢ় ও প্রস্তরীভূত হতে থাকে। হাওয়ামোড়ক আমার বেশ পছন্দের কবিতা। এর দৃশ্যচিত্রে সেই প্রসাদগুণের দেখা মিলে যার ভিতর দিয়ে বিনয় মজুমদার, পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল এবং ক্ষেত্রবিশেষ উৎপলকুমার বসু একদিন বিচরণ করেছিলেন। কবিতার দৃশ্যচিত্র যেখানে রিয়েলিটি মিথ নামক অভিজ্ঞতাকে প্রশ্নবোধকে মোড় নিতে বাধ্য করে। গদ্যছন্দী কবিতার শুরুয়াতটা হয় ক্লাইমেক্স দিয়ে, যদিও পরিশেষটা ক্লাইমেক্স থেকে প্রশ্নবোধকে নিজেকে গুম করতে থাকে। শুরুর অংশটা যদি হাওয়ামোড়ক কবিতার চাবি হয় সেক্ষেত্রে অন্তটা হচ্ছে তালা। তো যা-ই হোক, চাবিঅংশটা ফাঁকতালে পাঠ যাই বরং, কবি সেখানে লিখেছেন :
আজ একটি ঘাসিনৌকা আমাকে জলাধার মধ্যবর্তী ভাসমান ঘাসজাহাজে স্ট্যান্ডবাই রেখে গেছে। নৌকার মাঝি ও আমার মধ্যে কোন জানাজানি নেই। সে সোনারতরী পড়েছে কি না তাও জানা নেই। আজ সারাবিকেল সোনারতরীর ভাবনা আমাকে সঙ্গ দিয়েছে। উপর থেকে যেসব ভুবনচিল আমার উপর নজর রাখছিল। ভুলক্রমে তারা আমার উপর ড্রপআউট করেছে জীবনানন্দের ছায়া। জলের উপর যেসব সাদাবক উড়ে যাচ্ছিল, তাদের ঠোঁটে লেগে ছিল মাংসভক্ষণের হাসি।…
[দ্রষ্টব্য : হাওয়ামোড়ক, হাওয়াকাঠের ঘোড়া]
জগৎসুন্দর নিয়ে কবির কনট্রাস্টটা একবার ধরতে পারলে গায়ে শিহরণ বহে। সুন্দরের দিকে গমনের আকাঙ্ক্ষা সেখানে প্রেমের মধ্যে জিঘাংসা দেখে ফেলার আঘাতে হৃদয় অবশ হওয়ার অনুভূতি দিয়ে যায়। এ-রকম এক অনুভূতির মাঝে সুমন তাঁর সাকিন খুঁজে বেড়ান মনে হয়। চন্দ্রগ্রস্ত গানের কথা, সুর ও গায়কিতে যার ছায়া বিস্তারিত।
…
ব্যক্তিগত ঠিকানা তালাশের চাপ হাওয়াকাঠের ঘোড়ার উৎসারবিন্দু বলে আমার মনে হয়েছিল একসময়। ঠিকানাটা বাস্তবে নিখোঁজ কিন্তু কবির মনোবিশ্বে সদা জাগ্রত। সেখানকার পরিপার্শ্ব, তার দালানকোঠা, আলো-হাওয়ার বিন্যাসে নিহিত রহস্য, রোদ ও জোছনার নিয়ত সংঘাত অগত্যা ‘ব্যক্তিগত শহরচিত্র’-র আভাস হয়ে তাঁর চেতনসত্তায় জাগে নয়তো ঘুম যায়। সমস্যা হলো কোন পথে গমন করলে শহরকে পাওয়া সম্ভব তার ব্যাপারে কবির আত্মবিশ্বাসে পাঠক আস্থা রাখতে বিফল হয়। আস্থা রাখার পথে সুমন স্বয়ং আগল দিয়ে রাখেন। আগলের পেছনে নিহিত উদ্দেশ্যটা এইবেলা কবির মনোভূমির পাত্তা লাগাতে পাঠককে একদিক থেকে সহায়তা করে। যার নেপথ্যে এমতো ভাবনাকে সক্রিয় ভাবে পাঠক :
গ্যাব্রিয়েল সুমন নামের ব্যক্তিসত্তা নিজের অন্দরমহলে বসে যে-শহরচিত্র তৈরিতে খেটে মরছে ও সেখান থেকে চন্দ্রগ্রস্ত বিস্ময়ে বাইরের জগৎকে সে রিলেট করে, এর সঙ্গে তার সহবত ও সংঘাতের পুরোটাই বেমালুম ব্যক্তিগত। ব্যক্তিগত হওয়ার কারণে সেখানে অন্য ব্যক্তিসত্তার প্রবেশ আপনা থেকে খারিজ হতে বাধ্য। কেউ যদি এখন সুমনের শহরচিত্র-এ সফর করতে চায় তাহলে তাকে এটা মেনে নেওয়া লাগবে, সে এক কবিসৃষ্ট শহরে প্রবেশ করতে পারে কিন্তু সেখানে নিজেকে দ্রবীভূত করা তার পক্ষে সহজ হবে না। হাওয়াই কাঠে তৈরি ঘোড়া কবির শহরচিত্রে প্রবেশের মাধ্যম মানা যেতে পারে বড়োজোর। শহরচিত্রটা নিছক ব্যক্তিগত, উপরন্তু ওটা সদা অসম্পূর্ণ ও জায়মান হওয়ার কারণে ঘোড়া এখন সওয়ারিকে কতদূর নিয়ে যাবে তার আন্দাজ পাওয়া দুষ্কর। আগাম অনুমানটা সেখানে অবান্তর বটে! হাওয়াকাঠের ঘোড়ার প্রবেশমুখে লটকানো বিবৃতিতে কবি সেটা জানিয়ে দিতে খামতি রাখেননি। তাঁকে বলতে শুনছি :
যদিও আমি শারীরিকভাবে এখানে থাকি না, কেননা শহরটা আমারই বুকের ভিতর। আত্মা অই শহরে থাকেন। বহুবার আমার আত্মাকে চিঠি লিখে জানাতে চেয়েছি—আমিই তুতেনখামেন। ফাটা মাটির ব্যাকগ্রাউন্ডে ফোটা একটি হলুদ অর্কিড রাখা আছে ওখানে—ছবি তুলে নিয়ে গিয়ে নিদেনপক্ষে ফেসবুকের কাভারপিক বানাতে পারবেন।
পাঠক! আপনাকে অন্য আস্তাবলের সহিস ভেবে বলছি—আমার প্রতিটি পঙক্তি ব্যক্তিগত ব্যবহার্য বাবলগাম। ভুলেও তাকে খাবার চেষ্টা করবেন না। বরং যাত্রাপথে বানাতে পারেন দু–একটা বায়ুজাহাজ। আর খেয়াল রাখবেন পথের দুপাশের অগ্রন্থিত দৃশ্যাবলীর দিকে—যা আমি লিখিনি, লিখবোনা কোনদিন। আপনার ভ্রমণ শুভ হোক। আর হ্যাঁ, এটাকে গ্যাব্রিয়েল সুমন ভেবে ভুল করবেন না—এটা হাওয়াকাঠের ঘোড়া।
[দ্রষ্টব্য : তার আগে পরে…: হাওয়াকাঠের ঘোড়া]
সুমনের শিল্পযাপন, ধারণা করি, এই ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে চন্দ্রগ্রস্ত গানে এসে আপাতত দম নিয়েছে। হাওয়াকাঠের ঘোড়া তাঁর গানজার্নির ভিত গড়ে দিলেও তিনি সম্ভবত ওখানে স্থির নেই। গড়াভাঙার খেলায় রহস্যময় জগৎসুন্দরের মতো তাঁর জীবনজার্নি নয়া বাঁকে মোড় নিতে উৎসুক। জগৎসুন্দর হচ্ছে অসম্পূর্ণ রহস্য। সদা প্রশ্নবোধক এক সোনারতরী। তার মধ্যে গমনাগমনে বাধ্য শাবক কোনো মানুষের পক্ষে যে-কারণে নিজেকে সম্পূর্ণ ভাবার উপায় নেই। বোধিটা স্বয়ং সুমনের ব্যক্তিঅহংকে (ধারণা করি) পালটে দিতে শুরু করেছে। নিজের কাছে নিজেকে প্রশ্নবোধক করার পথে গমনের কাল ঘনিয়ে আনছে সে। চন্দ্রগ্রস্ত গানে যার রেশ শ্রোতা পায়। কবি সেখানে গাইছেন :
মনের ভিতর তারা জ্বেলে রাখি—আনন্দে তাই ভিজে গেলো আঁখি,
আনন্দে তাই নীল হলো পাখি—মাথার উপর চন্দ্র জ্বেলে রাখি।
অনন্ত ১ নদীর মাঝে তরী ভাসে ডোবে,
জোছনাকালীন বিষাদে আর ক্ষোভে।…
চোখের ভেতর—চোখ খোঁজে জোনাকি,
মাথার উপর চন্দ্র জ্বেলে রাখি…
গানের কথা ও ভাববস্তু সুমনের এতদিনকার কবিতাযাপনকে সার্থক প্রমাণে যথেষ্ট বলা যায়। মিউজিক কম্পোজিশনে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার যে-রকাবেশকে প্রকটিত করে, এবং গানের অন্ত অবধি একে ধরে রাখা চ্যালেঞ্জিং ছিল। হাসান ইথারের কম্পোজিশন সেদিক থেকে ভীষণ সফল। গানের দেহে শ্রোতার প্রবেশ ও সেখানে তাকে অবস্থান নিতে বাধ্য করার ঘটনায় সফল এই সাউন্ড ডিজাইনকে সাধুবাদ জানানো উচিত। এইচ.পি. লাভক্রাফটের লেখাজোকায় কসমিক ফিয়ার নামে যে-ব্যাপারটার সঙ্গে পাঠকের পরিচয় ঘটে, চন্দ্রগ্রস্ত-র কম্পোজিশন ওই ফিলটা দিয়ে যায়। অনন্ত ১ নদীর মাঝে জীবনতরীর ভাসা-ডোবাটা হচ্ছে এমতো ব্যাপার যাকে মানুষের পক্ষে আজো হজম করা কঠিন। কম্পোজিশন এখানে গানের দেহের প্রতি পরতে ঘনীভূত ভয় ও বরাভয়কে ধারণ করে অগ্রসর হওয়ার কারণে শুনতে দারুণ লেগেছে।
বাংলা রকগানে সাউন্ড ডিজাইন ও কম্পোজিশনের গড়পরতা ধাত থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা সুমনের গানটিকে ব্যতিক্রম করে তুলেছে। তার সঙ্গে গায়কিটাকে আলাদা করে স্মরণে রাখা লাগে। সাত মিনিট একটা গানের দৈর্ঘ্য বিচারে বেশ দীর্ঘ বলা যায়, যদিও শুনতে বসে কোন ফাঁক দিয়ে সময় গড়িয়ে যেতে থাকে তার কিছু মালুম হয় না। সুসঙ্গতি যার বড়ো কারণ। গানের দেহে জাগরূক ভাব যে-রহসময়তায় শহিদ হতে আকুল, বাদ্যযন্ত্র ও গায়কির নিখুঁত প্রয়োগ তাকে অসম্মান করেনি। সাবলীল ভারসাম্যের কারণে গানের দেহে যা-কিছু যুক্ত করা হয়েছে তারা একে অন্যকে ওভারল্যাপ করে যাচ্ছে অথবা দাবিয়ে রেখে নিজে চড়াও হতে চাইছে বলে মনে হয়নি। আর্টওয়ার্ক থেকে কম্পোজিশনের সবটাই সুষম ছিল। পরিবেশনার এই ভারসাম্যটাই আসল জাদু। সময় যত গড়াবে শ্রোতাকে ওটা চুম্বকশলাকার মতো নিজের অধীন করে নেবে। তার কাছে ফিরে যেতে প্ররোচিত করবে। কানে হেডফোন ঠেসে শ্রোতা প্রবিষ্ট হতে চাইবে অথির এই মায়ার খেলায়।
চন্দ্রগ্রস্ত গানে জীবনের গল্পটি জায়মান; যে-রকম জায়মান প্রেম, চোরাই হাহাকার আর বিষাদমোড়ানো জগৎপারাবার! হাওয়াকাঠের ঘোড়ায় সওয়ার সুমন এই মুহূর্তে নিজেকে যেখানে স্ট্যাডবাই করেছেন সেখান থেকে তাঁর পরবর্তী জার্নি দেখার কৌতূহল থাকবে। গান নিয়ে বিচিত্র সব বীভৎসতার মাঝে তাঁর এই আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশকে একপশলা স্বস্তির বৃষ্টি রূপে অভিনন্দিত করা যেতে পারে। মনে আশা, নিজেকে টপকে যাওয়ার খেলায় তিনি জারি থাকবেন। হাওয়াকাঠের ঘোড়াকে সেই জায়গায় কদম রাখতে বলবেন যেখান থেকে বাংলা গান তার চিরাচরিত স্বভাবে বশীভূত থাকার পরেও নতুন সুরসংগতি নিয়ে হাজির থাকতে কখনো হয়রান বোধ করেনি।
*
শুনুন গ্যাব্রিয়েল সুমনের গান চন্দ্রগ্রস্ত
দেখুন গ্যাব্রিয়েল সুমনের সিনেমা অ্যা শর্টফিল্ম অ্যাবাউট নাথিং
সাবস্ক্রাইব করুন গ্যাব্রিয়েল সুমনের ইউটিউবচ্যানেল
গানপারে গ্যাব্রিয়েল সুমন
আহমদ মিনহাজ রচনারাশি
- ভোটবুথ, ভূতভোট, বজরঙবলি ও বেবুন - November 26, 2024
- ক্বারী আমীর উদ্দিন সান্নিধ্যে সেদিন || তারেক আমিন - November 20, 2024
- পোয়েট ও তার পার্টনার - October 19, 2024
COMMENTS