দ্য গ্যুডিবয়

দ্য গ্যুডিবয়

শেয়ার করুন:

তথ্য হিশেবে এইটা আমরা জানি দুনিয়াবাসী সকলেই যে সত্যজিৎ রায় সিনেমা বাঁধছিলেন মোটমাট চৌত্রিশখানা, যার মধ্যে পনেরোখানায় পার্ট করেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। রায়চৌধুরী ঘরের সৃজনযজ্ঞে সৌমিত্র অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত বৈঠকাসন পেয়ে এসেছেন সবসময়। এই-যে সত্যজিতের পনেরোখানা বই, যে-পনেরোখানায় চ্যাটার্জি সৌমিত্রের পার্ট আছে, অলমোস্ট সব-কয়টাই তো আমরা দেখেছি-শুনেছি-পড়েছি। আর এর বাইরে বেশুমার বইয়ের ভেতর সৌমিত্রাভিনয় দেখি নাই কি জীবনে? দেখেছি। কাজেই সৌমিত্র আমাদের অতি চেনাজানা, অতীব আপনার, হাতের কররেখার ন্যায় চিনি তারে। দেখে চলেছি তারে জন্মের পর থেকে, শুনে চলেছি তার গলায় রিসাইট্যল, লেখাও পড়েছি তারে নিয়া এবং তার নিজের।

বলবার একটা কথা আছে, সেইটে এ-ই যে, সৌমিত্র কখনো ওই-অর্থে নায়ক হিশেবে আমার নিকট প্রতিভাত হন নাই। কিন্তু অভিনেতা তো বটেই। গ্রেইট অভিনেতা নো-সন্দেহ। তবুও রক্তরগরগে যে-মানুষটা আমি চাই দেখতে, একশ ভুলভ্রান্তিখামতির ফাঁকে এক-দুইটা ভালো ও সদগুণসম্পন্ন যে-মানুষ, সৌমিত্র সেইটা না। মানে কখনোই তারে আমার ঠিক ভুলভ্রান্তিবিদীর্ণ মরজাগতিক মনুষ্য মনে হয় নাই। বড় বেশি নির্ভুল, বড় বেশি নিষ্কণ্টক, বড় বেশি মার্জিত তিনি। ঠিক যে-প্রকারে উইকেডনেস্ একটা মানুষে সাধারণদৃষ্ট, জরুরি সেই জিনিশটা সৌমিত্রে মিসিং মনে হয়েছে বরাবর। ফলে তার নিজের একটা ম্যানারিজম তো গোড়া থেকে তৈরি হয়েই ছিল, গ্যুডিবয় ইমেইজ, কিন্তু ঠিক ভার্সেটাইল না তিনি। যতটা পুণ্যাত্মা হিশেবে তিনি মানানসই, ততটা পাপাত্মা হিশেবে না। ভালোমানুষিবৃত্তে তিনি সেরা। যাকে, যে-ধরনের অ্যাক্টরকে, চালু বাংলায় বলা হয় থিঙ্কিং পার্সোন্স হিরো, সৌমিত্র তা-ই।

সত্যজিতের অপুর সংসার   বলি কিংবা অপরাজিতা, অশনি সংকেত, গণদেবতা, চারুলতা, সোনার কেল্লা, অরণ্যের দিনরাত্রি  ইত্যাদিতে সৌমিত্রের অভিনয় নিখুঁত প্রায়। এইটাই বিপদ। খুঁত না-থাকলে সেই চাঁদ নিয়া আলাদা কথাবার্তা আদৌ হয় না। আর এর বাইরে তো অসংখ্য সিনেমায় তিনি লিড্ অ্যাক্টর, যেখানে মাইনর অ্যাক্টর সেখানেও লিড্ দিতে দেখেছি আমরা তাকে, সৌমিত্র ম্যুভিতে থাকা মানেই দর্শকচোখ খুঁজে বেড়াবে তাকে। এইটা আছে শুরু থেকে অব্যাহত। অপর্ণা সেনের সঙ্গে কেমিস্ট্রিটা, স্ক্রিনকেমিস্ট্রির কথা বলছি, পার্ফেক্ট হয়েছিল। তৎসত্ত্বেও সৌমিত্র নায়কের ভূমিকায় লটকে থাকতে ঝোলাঝুলি করেন নাই বিশেষ। সেই কারণেই সম্ভবত ক্যারিয়ার এত সুদীর্ঘ হতে পেরেছে। সত্যজিতের পরে অপর্ণা আর ঋতুর ডিরেকশনে সৌমিত্রকে আমরা আরেকবার ঝলসে উঠতে দেখব। অসুখ   ম্যুভিতে একটা ক্যারেক্টারে সৌমিত্রের অভিনয় খুবই মনে পড়ে। এখনও সমান কুহক তিনি স্প্রেড করে দিতে পারেন অভিনয়কলার মাধ্যমে।

এই মাপের অভিনেতা কি আমাদের এখানকার কেউ হতে পারতেন না? রাজ্জাক, ধরা যাক? হতে পারতেন? বলা যায় না, হতেও পারতেন, যদি নায়কভূমিকায় অ্যাক্টিং করবার বল্গাহারা বাসনা টাইমলি চেক দিতে পারতেন। এই সেদিনও, নব্বইয়ের শেষপাদেও, আমাদের নায়করাজকে আমরা বেঢপ উইগ আর পেটে বেল্ট কষে বেঁধে নূতন-সুনেত্রার সনে নায়ক হয়ে উদ্যানে-অরণ্যে ঘোরাঘুরি করতে দেখেছি। ফলে চরিত্রাভিনেতা নায়করাজ রাজ্জাক হয়েছেন যখন, তখন ধুমিয়ে কান্নাকাটিই করেছেন কেবল ‘বাবা কেন চাকর’ প্রভৃতি সিনেমায়। সেই কান্নাকাটি চরিত্রের প্রয়োজনে কতটা, আর কতটা নায়করোল না-পাবার দুঃখে, গভীর ভাবনার বিষয়। মেলোড্রামার একশেষ করেছেন রাজ্জাক ও তৎসময়ের রাজাকাঙ্ক্ষী নায়কেরা। খালি ডিরেক্টর আর স্ক্রিপ্টের দোষ নয় মনে হয়।

স্ক্যান্ডাল প্রায় নেই, বলতে গেলে, সৌমিত্রক্যারিয়ারে। এইটাও সফলতার একটা কারণ কি? কে জানে, হতেও পারে। খুবই নিয়মতান্ত্রিক কাজের ক্যারিয়ার। ফাঁকিঝুঁকিহীন। ফলে এইসব ভুলভ্রান্তির চার্মটা নাই তার ক্যারিয়ারগ্র্যাফের কোথাও। ভুল থেকে একটা অভাবিত আস্বাদনের যে সম্ভাবনা, তা আর পাওয়া হয় নাই তার কাছ থেকে। একটা রাবীন্দ্রিক ভাবগাম্ভীর্য ও সহজিয়া আনন্দগানের জীবন। উত্থানপতনহীন। তবে শেষদিকে এসে এমন একটা কারবার উনি করে বসলেন ঋত্বিক প্রসঙ্গে যে এই আচরণের কোনো ব্যাখ্যা আমি বাইর করতে পারি নাই অনেক খেটেখুটে ভেবেও। উনি ইয়াং ডেইজে ঋত্বিক ঘটককে বেধড়ক পিটিয়েছিলেন এবং উপর্যুপরি ও ডেস্পারেইটলি। মৃত্যুর বছর-দুই আগে সেই ঋত্বিকপ্রহারকাহিনি স্বীকার করছেন সগর্ব ও অনুতাপহীন গলায় চ্যাটার্জিবাবু। পত্রিকায় এই বিকট সাক্ষাৎকার প্রকাশের পরে সবাই বিমূঢ় হয়ে ভেবে কূল পাচ্ছিলাম না বাবু সৌমিত্র উন্মাদ হয়ে গেলেন কি না, নাকি মিডিয়ার মামদোবাজি সমস্তই, ঠিক এমন সময় নায়কমশাই ক্লিয়ার করে ফের মিডিয়ায় আনরিপেন্টেন্ট গলায় এসে বলেন, ওইদিন উনি ঋত্বিককে মেরেই ফেলতেন যদি-না কে-একজন অমুক এসে নিবৃত্ত না করত সৌমিত্ররে। এই পয়লা বাবু সৌমিত্রের গ্যুডিবয় ইমেইজ ক্ষুণ্ণ হয়। আমি আজও এই ঘটনার কোনো পজিটিভ এক্সপ্ল্যান্যাশন খুঁজে পাই নাই। অ্যানিওয়ে।

সৌমিত্র একটা জায়গায় আনপ্যারাল্যাল। উচ্চারণ। সংলাপ-প্রক্ষেপণ। ইংরেজি সিনেমায় আমরা যেমন প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে ভিক্টোরিয়্যান উচ্চারণ, রোম্যান সংলাপ ডেলিভ্যারির ভাবভঙ্গি দেখে পুলক লাভ করি, সৌমিত্র বাংলায় এই জিনিশটা জায়গামতো যুগিয়েছেন আমাদেরে। এখানকার আমাদের গোলাম মুস্তাফার এই হিম্মৎ ছিল। সৌমিত্র অন্তর্হিত হবার পরে এই উচ্চারণ প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে আমরা লাগাতে পারব কি না, এইটা একটা চিন্তারই ব্যাপার।

সৌমিত্র সম্পর্কে এই নিবন্ধ অকস্মাৎ তার একটা ইন্টার্ভিয়্যু পড়ে একটা উদ্ধৃতি ক্লিপআপ করে রাখার গরজে লেখা। ইন্ডিয়ান-বাংলা ত্রৈমাসিক বইয়ের দেশ   জানুয়ারি-মার্চ ২০১৫ সংকলনে এইটা ছাপা হয়েছে। ডিটেইলে অনেক কথাবার্তাই বলেছেন সেখানে। বিশেষভাবে সবিশদ কথা হয়েছে তার লেখালেখি নিয়েই। সৌমিত্র কবি, নাটকলেখক ও অনুবাদক। কবিতাসমগ্র বেরিয়েছে এরই মধ্যে, উনার জীবদ্দশাতে, বেরিয়েছে নাটকসমগ্র। সৌমিত্রের একটা কাজের ভূয়সী প্রশংসা করি আমি। কাজটা কা’লিল জিব্র্যানের দি প্রোফেট, বাংলায় সৌমিত্র করেছেন দ্রষ্টা । লা-জওয়াব। অনবদ্য। পরে এই টেক্সটের কমপক্ষে চারটে ট্র্যান্সল্যাশন বেরিয়েছে, খুঁটিয়ে পড়েছি সব-কয়টা, সৌমিত্র-অনুবাদের পর ওইগুলো কোন সাহসে পেশ করলেন অনুবাদকেরা, তা বটে এক বিদঘুটে ভাবনার ব্যাপার। এইটা হামেশা হতে দেখি আমাদের দেশে। একটা ভালো অনুবাদের পিঠেপিঠি উপর্যুপরি বিদঘুটে অনুবাদ বের হয়ে বাজার অন্ধকার করে ফেলা হয় ধুলায়। সৌমিত্রের এই অনুবাদ ঘরে রেখে এক-সময় ইংরেজিটাও পড়ে দেখি, (ইন্ডিয়ার রূপা   থেকে বেরোনো, এ-মুহূর্তে অন্যান্য ডিটেইল্স দিতে ইচ্ছে করছে না) ইংরেজির চেয়ে বাংলাটাই বেশি ব্যঞ্জনাবাহী। অথচ গদ্যে লেখা গোটা টেক্সট, অথচ কী কবিতাসংক্রামক! দ্রষ্টার জন্য সৌমিত্রের আসন আমার কাছে আলাদা মর্তবায় বুলন্দ।

প্রয়াণের পরে সৌমিত্রের সাহিত্যিক পরিচয় নিয়া বাংলাদেশের ফেসবুকার রাইটারদের ট্রল করতে দেখে বুঝতে পারি কী বিদঘুটে এক কবিলেখকসমাজে বাস করছি আমরা! আমি নিয়মিত ইন্ডিয়ান বাংলা লিটল ম্যাগাজিনগুলায়, শারদীয় ও অন্যান্য পত্রিকায়, সৌমিত্রের কবিতা ও অনুবাদ রেগ্যুলার পড়ে এসেছি। কিন্তু আমাদের দেশের ‘মান্যগণ্য’ লেখকেরা ফেসবুকে কমেন্ট পড়া ও করা ছাড়া আর-কিছু পড়েন ও করেন বলে মনে হয় না।

তো, ওই ইন্টার্ভিয়্যুয়ের কোটেশনটা এবারে দেখাই :

আমাকে হয়তো পাশের বাড়ির ছেলের মতোই, উত্তমকুমারের মতোই খানিকটা মনে করা হতো। জনপ্রিয়তা না থাকলে, ছবিগুলো হিট না করলে আমায় কবে তাড়িয়ে দিত। এটা একটা নির্মম লাইন। আর একটা ব্যাপার, অন্যরকমের একটা হিরোর দরকারও ছিল এই ইন্ডাস্ট্রিতে। উত্তমকুমার একদম reigning god ছিলেন। এবং ও-রকম জনপ্রিয়তা কারও আমি দেখিনি। সেখানে আর-একজন অল্টারনেটিভ হিরোর খুব দরকার ছিল। পরিবর্ত হিসেবে যারা আসছিল, তারা সকলে উত্তমকুমারের ঝাপটায় একদম ভেসে যাচ্ছিল। উত্তমকুমারের পাশে দাঁড়াতে পারত না। আমি প্রথম এবং তারপরেও শেষ হিরো, যে উত্তমকুমারের পাশে দাঁড়িয়েছি। একসঙ্গে দু-জনের নাম উচ্চারণ করা হতো। উত্তম-সৌমিত্র। কারণ, ও-রকম জনপ্রিয়তা আমি কারও দেখিনি। কী আর বলব, এতরকম পিছুটান ছিল তাঁর জনপ্রিয়তা বজায় রাখার জন্য, এতদসত্ত্বেও যে তিনি তা বজায় রাখতে পেরেছেন, সেটা একটা বিরাট শক্তির পরিচয়। জনপ্রিয়তা হয়তো আমারও কিছুটা ছিল। … তো সেদিক থেকে দেখতে গেলে আমি উত্তমকুমারের কাছাকাছি পৌঁছতে পারিনি। কিন্তু কেউ ভাবতেই পারেনি যে, সেই উত্তমকুমার যখন মধ্যগগনে, তখন তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আর-একজন নাম শেয়ার করবে। রোজ চায়ের দোকানে ঝগড়া হতো, স্কুল-কলেজে বিতর্ক, উত্তম না সৌমিত্র। এইটে আমার সৌভাগ্য বলতে পারো। কলেজে পড়তাম যখন, আমি সুচিত্রা সেনকে একদম পছন্দ করতাম না। স্যরি, কিছু মনে কোরো না। আমার সমস্ত বন্ধু ছিল সুচিত্রার ফ্যান। আর আমি ছিলাম উত্তমকুমারের ফ্যান। আস্তে-আস্তে যখন অভিনয় সিরিয়াসলি নিতে শুরু করলাম, উত্তমকুমারকে যে ফলো করতে হবে, এটা একেবারেই মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললাম। ওঁকে অবশ্য ফলো কোনোদিনই করিনি। ওঁর অভিনয়, প্রেজেন্স সবই ভালো লাগত। ও-রকম হাসি দেখলে যে-কোনো লোক পাগল হয়ে যাবে, এমনকি পুরুষরাও। তবে উত্তমদাকে আমি কখনো ফলো করিনি। আমার আইডল ছিলেন একেবারেই অন্যরকম একটা লোক। ইন ফ্যাক্ট থিংকিং অ্যাক্টর যারা, তিনি তাদের সকলেরই হিরো। তিনি বলরাজ সহানি। এমনকি নাসিরুদ্দিন-এরও দু-জন আইডল, এক বলরাজ সহানি, অন্যজন আমি।

আশি পূর্ণ হয়েছিল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ২০১৫ বা তার কাছাকাছি টাইমে। গেলেন কোভিডের কড়া টাইমটায়। আড়েগড়ে বছর পঁচাশি টিকে তারপর বিদায় নিয়েছেন। সৌমিত্রের বয়স হয়েছিল যদিও, অথচ ছিলেন তরতাজা। সৃজনোদ্যমী। একদম অশীতিপর কোনোদিনই মনে হয় নাই উনারে।

লেখা / জাহেদ আহমদ

শেয়ার করুন:

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you