আমাদের শৈশবের সুরমা আজ একরত্তি স্মৃতির সুবাস, একটুকরা আখ্যানের প্লট কিংবা কবিতার লুকানিচুরানি ইঙ্গিতবহ চূর্ণপঙক্তি, বড়জোর সিনেমার এক-দুইটা প্যানোরামিক ফ্রেমের ভিশ্যুয়্যাল। সুরমাতৃকা, মায়ের সুর, সুরপ্রিয়তমা আজ অলমোস্ট সুরহারা। আমাদের সেই ঘুড়িভিড়ে-ছেয়ে-যাওয়া আকাশ, জলঝিলিমিলি সেই হাওয়া ও হরিতকিবৃক্ষের হর্ষ, সেই টিলা ও টুনটুনির গীতিমালা আজ যেন অবসরের দীর্ঘনিঃশ্বাস। কোনো-এক নতুন তারাশঙ্করের অপেক্ষায় এই নিঃস্বপ্রায় হাঁসুলিবাঁকের উপকথা। আমাদের একদা-স্বাস্থ্যোজ্জ্বলা এই হৃদিপ্রিয়া, এই নিধুয়া পাথারে একান্ত মধুহৃদি আমাদের, এই চিরবন্ধু-চিরনির্ভর-চিরসুন্দর স্যুইটহার্ট মন্যামুর — আহা, কত নামেই-না আমরা তারে ডেকেছি একদিন! অপুষ্টিতে ভুগতে ভুগতে, অনাব্য অনাদর অপথ্য অচিকিৎস্য অসুখে, এখন তিনি শীর্ণকায়া। আর তার গরিমার স্রোতোচ্ছ্বলতা, প্রাচীনদিনের সেই সম্পন্ন বৈভব, আচমকা ভুলিয়া যাওয়াও তো সম্ভব হচ্ছে না তার পক্ষে। ফলে একপ্রকার নিরভিযোগ ভোগান্তি মুখ বুজে। যেন বাতাসের সনে মিশিয়া যাবার সন্ধি করে চলেছেন তিনি প্রতিনিয়ত। একদা তাম্বুলরঞ্জিত ও রসস্থ সুরভিসিক্ত তার দুর্ধর্ষ ওষ্ঠাধরযুগলে এখন লাগিয়া থাকে শেষ-বিকেলের মরাটে আলো আর কাফন-বিমর্ষতা। চারিপাশে হন্তদন্ত দুনিয়ার দাপুটে রোয়াব, যুগান্তরের ঘূর্ণিপাক, প্রভৃতির পাশে আমাদের সমস্ত সুর আমাদের সমস্ত মা আমাদের সমস্ত প্রিয়তমা আমাদের সুরমা আজি ম্রিয়মাণ। শুধু সুরমা কেন, ম্রিয়মাণ ও অজল নিস্তেজ বিমর্ষ অপরাপর সক্কলেও; করতোয়া, মাতামুহুরী, তিস্তা, মেঘনা, লৌহজং, কর্ণফুলি, তিতাস, যমুনা, ঘাঘট ও পদ্মা … সব্বাই বিমর্ষ অবসন্ন।
ঘুমপাড়ানি মাসিপিসির সনে ঘুমাতে যেতাম, কোন-সেই-কালে সেই ধূসর-ধূসরতর অতীতে, প্রত্যুষের লেবুরঙা আলো চোখে নিয়া আর সুরভিত শিউলিহৃদয়ে। এখন, অনেক অনেকদিন হয়, সেই ঘুম নেই, আলো নেই, রঙ নেই, লেবু নেই, লেবুপাতা নেই, করমচা নেই, বৃষ্টি নেই, বৃষ্টি-থামানিয়া গানের সঙ্গে মেপে-দেয়া ধানের হিসাবনিকাশ নেই, বৃষ্টি ঝেঁপে আসার জন্য দোয়া খায়ের নেই। সীমাহারা এক নেইরাজ্যির বাসিন্দা আমরা আজ বহুকাল হয়। নিদ্রা পালায়েছে আজি নিগূঢ় কোনো বনে। এখন শতরাত্রি ইন্সোম্নিয়াভোগা কালশিটে আঁখিতল দেখেও কপট কূপিত হবার মতো নেই কেউ। দুশ্চিন্তা করবে আমাদের জন্যে এমন নেই কেউ। অমঙ্গলের আশঙ্কায় কেঁপে উঠবে থির্থিরিয়ে এমন নেই কেউ। অনুপস্থিত অপার্থিবা সেই লালাবাই সুর। শোলক-বলা নেই, নার্সারি রাইম নেই, উধাও ঘুমঢুলুনি কিচ্ছাকাহনগল্প। অনেকদিন হয় পাল্টে গেছে প্রত্যুষের রঙ। বদলে গেছে যামিনীবিভা।
সেই বিহঙ্গগুচ্ছ কই আজ? সেই টিলার গায়ে ঘুঙুরপাখি, নিচুচালা পাকঘরের খিড়কি-লাগোয়া আতাফলগাছের ডালে দুর্গাটুনটুনি, সেই পেয়ারাপাতার ফোকরে দৈয়ল-চড়ুই? বৃক্ষবাসী মহান সেই নাগরিক সোসাইটি নেই আজ আর নগরে। সেই বৃক্ষগণও তো দৃষ্টির অগোচর আজ, আবডালে আজ নেই সেই বৃক্ষভাষা, আজ আর নেই সেই বিহঙ্গমুখরতা। লাফাঙ্গা মানুষের কলরব খালি, গোঁদা মানুষের লাফঝাঁপ-তড়পানি গাছে-গগনে জলে ও জঙ্গলে, সেই নৃত্যপর নদী ও নিসর্গের নন্দন গরহাজির বিলকুল। অথবা আছে হয়তো কোথাও কোনোখানে, সেই নদী সেই নিশি সেই নিসর্গ সেই নুনের নন্দন, আমাদের শ্রবণ-ও-দর্শনসীমার বাইরে হয়তো বিরাজিছে তারা।
এ এক অদ্ভুত বধিরের কাল তাহলে! এ এক উদ্ভট তালকানার তবিলদারি তবে! এ এক আদিগন্তপাতালবিস্তারী এক দহনের কাল! না, অতটা নেতিচিন্তক হয়া কাজ নাই বাপু, দরকারও নাই, প্রিন্স অফ পেসিমিজমের বিলাসী বেঁচে-থাকার মধ্যে যেটুকু গৌরব তা তুমি নাই-বা লভিলে। এরপরও কথা তো মিছে নয় যে স্টক-সীমিত সবুজ অদ্য নিঃশেষিত। ফুরোবার আগেই একখণ্ড ক্রয় করা চাই স্টক-সীমিত ভবিষ্যৎ। প্লট বাগাও, পর্বতপরিব্রজনের প্যাশন ছুঁড়ে ফ্যালো করাল কালগহ্বরে, পৈখপাখালি আর ভোরের বাতাসপ্রীতি নিপাত যাক। জমি কেনো, জমিজিরেত বাড়াও, জমি খরিদিয়া তাল্লুকদার হও। স্বপ্ন অধুনা মানুষের কুল্লে এই একটাই। নিষ্কণ্টক জমিন্দার হইবার স্বপ্ন। খোয়াব, খোয়াইশ। অদ্যাবধি এই একটাই জীবিত স্বপ্ন মানুষের। বাকিসব ঝুট হ্যায়, বিলকুল বরবাদি হ্যায় রেস্ট অফ দি ড্রিমস। তামাদি হয়ে গেছে যেন বাকি জিন্দেগানি।
বিদেশি ভাষা বলবার মতন সযত্ন সন্তর্পণে এইবার জলের প্রসঙ্গে আসি। জল মানে পানি। পানির অপর নাম পিপাসা, থার্স্ট, তৃষ্ণা, পিয়াসা, আর জল তো খোদ জীবন, লোকে বলে। একদা আমাদের জলাশয় ভরিয়া জল থাকিত, তথা পানি, আর খালে-বিলে-সরোবরে ফুটিয়া রইত পদ্ম ও পানাফুল আর চিকচিক করা বালি কোথা নাই কাদা। নদী ছিল পুষ্টিহৃষ্ট, লক্ষ্মীমন্ত মাছমুখর, নীরোগ জলবতী একদা। আজকাল জলাশয়ে জল আর জলসখিগণ ছাড়া বাকি সবকিছু লভ্য; যথা — শামুকখোল, মরা সাপখোলস, ঝিনুকভগ্নাংশ, আততায়ী কাচবোতলচূর্ণ, পলিপ্যাকস্তূপ প্রভৃতি বিচিত্রাদি। টিকটিকিডিমের ন্যায় শ্বেতবর্ণ-হলুদাভ রোদ্দুরে মেলান-করে-ধৃত হতাশা, ফ্রাস্ট্রেশন, হেপাটাইটিস-বি ইনফেক্টেড ফিউচার। গতায়াতপথের মাঝখানে সেতু ও সাঁকো সুলভ বটে, সেতুর নিচ দিয়া বালিবিকীর্ণ রৌদ্রমগ্ন বিধবাসিঁথির মতো অঞ্চলটিকে আমরা নদী শিরোনামে আদুরে সম্বোধন করিয়া থাকি।
কিন্তু কোথা সেই নদী, কোথা সেই হাতছানি, কোথা ডাকাডাকি সেই উতল হাওয়াবাতাসের মগ্নচৈতন্যলীনার? কোথা সেই ঝিলমিলঝিলমিল-করা আমার ময়ুরপঙ্খী নাও? নদী নাই, ম্রিয়মাণ নদীসংস্কৃতি, তাই বিলুপ্তপ্রায় নদীবক্ষে রিভারক্রুজ রেস্তোরাঁ, রাতে তাতে দেহবল্লরী-ছিটকানো আলোসজ্জা, ঝাল মুর্গি-মটনের খানাপিনা। মাঝি নেই, খেয়াপারাপার নেই, পেশা পাল্টায়ে রিকশাঘণ্টি বাজাতে শিখে নিয়েছে হয়তো-বা সুরমার ঈশ্বর পাটনিরা সবাই। আর বৌ-ঝিয়েদের নাইতেও দেখা যায় না আর নদীর দুই কিনার জুড়ে। এখন নদীতীর মধ্যবিত্তবিলাসের প্রয়োজনে বাঁধানো, রেলিঙবেষ্টিত, সন্ধ্যায় আমরা হাওয়া খাইব বলে সারাদিন নদীতীরবর্তী জনপদের লোকেরা তমিজের সঙ্গে নদী মাড়ানো পরিহার করে চলে সাবধানে। নদীর বিউটিফিকেশন হয়েছে কোটি বিডিটি রাজস্ব লগ্নি করে, সেইদিকে কড়া নজর রাখা আমাদের নাগরিক ডিউটি, বিউটির খেলাপ হলে কঠিনভাবে পানিশ করা হোক মর্মে উচ্চার্য-অনুচ্চার্য দাবি আমাদিগের। শহরের আব্রু রক্ষা করা যে-কোনো মূল্যে আমাদের জান-পহেচান লড়াই। নদী ঘিরে এইসব করুণ তামাশা।
আশৈশব চেনা আমার শহর, — যার অম্লজান শুষে আমার ও আমাদের এই বেড়ে-ওঠা, — চোখের সামনে কেমন বদলে গেল ভোজবাজির ন্যায়! এই সেদিনও আকাশে হেলান দিয়া নাতিউঁচা পাহাড়গুলো ঘুমাতে যেত, আমরা দেখেছি, রিকশাচলা শহরের রাস্তাঘাটগুলো সব-কয়টিই ছিল উচ্চাবচ, অল্প পরপর রিকশা থেকে নেমে ঠেলতে হতো সোয়ারিভরা ত্রিচক্রযান ডাউন থেকে আপে তুলে নিতে, এখন সব সমান। ফ্ল্যাট শরীর যেন, পেন্সিলথিন, কার্ভ নাই, গ্র্যাফিক ইল্যুশন নাই কোনো। অনেকটা রাইবচ্চন সমন্বিত ঐশ্বর্যার ন্যায়। এখন যেইদিকেই চোখ যায় শুধু অগোছালো দৈত্যাকার দালান, অদ্ভুতুড়ে ও আননেসেসারি ইমারত, দানবিক দালানায়ন। নগরায়ন, শহরায়ন, সভ্যতায়ন। ঘুমোয় না, আমার শহর, জেগে থাকে দিনরাত ড্রাগনচোখে। লেলিহান লকলকে জিভ তার মেট্রোসিটি লালসার। যুগের হাওয়া অন্যমনে — যেমনটা পাই কবীর সুমনের গানে — জমি বেচার টাকা গোনে আমার শহরে। মাটি বেচে মালদার হইল কত লোকে রাতারাতি! এর মাটি মেরেকেটে বেচিতেছে ও। অট্টালিকার অশ্লীল উদরে প্রবেশিছে সার-সার আমার শহরের প্রসিদ্ধ টিলাগুলি। কিশোরীবিনুনির ন্যায় টিলাগাছগুলা।
আর রাস্তায় লোকালয়ে মানুষ কোথায়! — কিলবিল ছুটিছে কেবল কাফকার পোকা। আটটা-পাঁচটা দিনযাপনের দৈন্য ও অবদমন। অচরিতার্থতা ধারাবাহিক। চক্রাকার অত্যাধুনিক ড্রাকুলার, ভ্যাম্পায়ারের, শাসনে তটস্থ দুনিয়া। আমার গ্রাম। তোমার শহর। আমাদের শহরতলি। উপকণ্ঠ শহরের। আমি যেইখানটায় থাকি, যেথায় নীড় বাঁধা আছে একান্ত আমার, দশ-পনেরো বছর আগেও — নাকি দুইশ নাকি পৌনে-তিনশ বছর! — পাড়াগাঁর দু-পহর ঝুলত সেখানে; রৌদ্রে যেন গন্ধ লেগে থাকত স্বপনের। পরাবাস্তবের পরী উড়ত নভোনীলতল্লাটে। এখন আর নেই সেই গ্রামগন্ধ। শহরতলি গিলে ফেলেছে গোটা গ্রামশামিয়ানা। আর শহরতলি নিদারুণ শহরের বর্জ্য ফেলবার ভাঁগাড়। ইটভাটার ধোঁয়ায় বিম্বিত কৃত্রিম আকাশ আর ব্রঙ্কাইটিসের বীজাণুবাহী গুমট হাওয়া। কোথায় সেই বাদলা দিন? কোথা সেই শীত, সুপর্ণা ঋতুটি? ফি-বছর কদম ফোটে ক্যালেন্ডারের পাতায়, — ইদানীং ফেসবুক-নিউজফিডে। নগরে নিসর্গ বলতে কেঠো অনুভূতিরিক্ত মেহগনি, বিদেশি মেদবহুল দুয়েক পদের হোঁদল-কুঁতকুঁতে গাছবিরিখ, রাক্ষুসে য়্যুক্যালিপ্টাস আর মাঝরাতে পাণ্ডুর জন্ডিসরোগা আকাশে একখানা ভাঙাচোরা চাঁদ। সংক্ষেপে এ-ই হলো সাম্প্রতিক সমাচার, হালফিল হকিকত, স্ট্যাটাস আপডেট, আমার শহরের।
(এই রচনাটা আরও বছর-তিন আগে অনুধ্যান অনলাইনে ছাপা হয়েছিল ও অদ্যাবধি তথায় অ্যাভ্যাইল্যাবল আছে। লেখা হয়েছিল দশককাল আগে। এইখানে তেমন কোনো সংস্কার ছাড়া আর্কাইভড রইল। — জাআ)
আরও রচনা
সুরমাপারে সন্ধ্যাযাপন
পাঞ্জেরী রেস্তোরাঁ
- ছত্তার পাগলার সন্ধানে আহমেদ স্বপন মাহমুদ ও সরোজ মোস্তফা - January 28, 2025
- সপ্তপদীর দুপুরবেলায় সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় || ইলিয়াস কমল - January 27, 2025
- স্বরচিত কবিতার অন্তর্গত অনুপ্রেরণা || হাসান শাহরিয়ার - January 24, 2025
COMMENTS