সুচিত্রায়ণ

সুচিত্রায়ণ

শেয়ার করুন:

তিনি যে-বছর সর্বশেষ পর্দায় এসেছিলেন, সর্বশেষ যে-বছর পর্দাহাজিরা তাঁর, ওই বছরের মডেল আমি ও সমবয়সী আমরা, আই মিন ওই বছরেই পৃথিবীর খোলা বাজারে আমি আবির্ভূত হই। ইন দ্যাট সেন্স অবশ্য ওল্ড মডেল আমি, ইঞ্জিন রিকন্ডিশনিঙের দরকার এখনও হয় নাই তথাপি হইতে কতক্ষণ। তবু হোপফ্যুলি ইঞ্জিনে ময়লা ধরা বা পার্টসগুলো ক্ষয় কিংবা হেডলাইট বিকল হবার ঢের দেরি নিশ্চয়। তা-ই যেন হয়, হে পাঞ্জেরি, ইয়া এলাহি মাবুদ! বসেছিলাম সুচিত্রাচ্ছন্নতার যুগসন্ধিসময়ে বেড়ে-ওঠা আমাদের দিনরাতগুলি নিয়া খানিক ম্যুভিস্মৃতি নিকলানোর নিয়তে। সেইটা আদৌ কতদূর করতে পারব বুঝতে পারছি না, রাত হ্রস্ব অতি, না-সারা কাজকম্ম জমে পাহাড়। কলুর বলদ হইলে যা হয় আর-কি, নিজের মনের কথাগুলো বলার স্পেইস বের করা বেজায় ইম্পোসিবল হয়ে উঠতে থাকে দিন-কে-দিন, বলবই-বা কাহারে ডাকিয়া, ঘানিচাক্কার বাঁধা ঘূর্ণিতে কেটে যেতে থাকে দিন ও যাপন। সুচিত্রাচ্ছন্নতা, মানে সুচিত্রা সেন বিষয়ক অবসেশন, আমাদের সময়ে সেভাবে ছিল না এইটা আমায় কবুল করতে হচ্ছে। এরপরও যা ছিল, অবসেশন নয় সেসব, মর্তবা তার বুলন্দ দরোয়াজার। সত্যি তা-ই, জরুর সত্যি। স্তিমিত হয়ে গেছিল ততদিনে ক্রেজ, পরিবর্তে একে একে একাধিক অন্যান্য ক্রেজ গড়ে উঠতে থাকে আমাদের জগতে, সেসবের সঙ্গে আমরা জড়িয়েমুড়িয়ে নিচ্ছিলাম নিজেদেরে ক্রমশ। সুচিত্রার জায়গায় সেইরকম কোনো টলি-ঢালি চিত্রাভিনেত্রী যেতে পারেননি — এই কথাটা আঁখি মুঞ্জিয়াই বলে ফেলা যায়। আমাদের বেড়ে-ওঠা দিনগুলিতে ইন্ডিয়ান বাংলা সিনেমা খুব জাঁকিয়ে ব্যবসা করছিল, শতাব্দী-দেবশ্রী এই দুইজনেরে দেখতাম খুব আড়চোখে প্রেমিকাপ্রতিম, ববিতা-শাবানা ঠিক আমাদের সময়ের আইকন হইতে পারেন নাই তাদের যুগ অস্তমিত না-হওয়া সত্ত্বেও। সুচিত্রাকারুকাজ আমরা আমাদের তখনকার উঠতি-যুবা বাপ-চাচাদের সুবাদে কদাচ দুইয়েকটা দেখছিলাম ভাড়া-করে-বাড়িতে-আনা ভিসিয়ার যন্ত্রে। সেইসময় হিন্দি সিনেমা না-দেখলে তো ছোটচাচার ভাড়ায়-আনা ভিসিয়ার দেখার ব্যাপারটা মাঠে গড়াগড়ি যাইত, তখন অমিতাভ-রেখার উত্তুঙ্গ ঋতু, মিঠুন-শ্রীদেবীও সমানতালে এগোচ্ছেন ‘ডিস্কো ড্যান্সার’ ইমেজে, হেমা মালিনীও পুঁচকে আমাদের পছন্দ হইতে শুরু হয়েছে, এবং জয়া, ভাদুড়িতনয়া ও অমিতাভজায়া — কার্যত ‘শোলে’ সিনেমায় তাঁর মিতদৃশ্য স্ক্রিনপ্রেজেন্স দেখে। ছেলেবেলার লেজের দিকটাতে একসঙ্গে অনেকেই প্রিয়পর্যায়ে এসে যাচ্ছেন, যাদের মধ্যে ডিম্পল কাপাডিয়া বা পুনম ধীলন থেকে শুরু করে কিমি কাতকার কি মিনাক্ষী শেশাদ্রীও বাদ নাই। কিন্তু সুচিত্রা সেন তখন যতটা শুনতাম — সুচিত্রা শব্দটা তখন আমাদের কানে আসত উত্তমসুচিত্রা যুগ্মধ্বনিরূপে — ততটা দেখার সুযোগ ছিল না। কারণ ওই রাত্রিহ্রস্বতা। ভাড়ার ভিসিয়ারমেশিন তো রাইতের মধ্যে দেখে সেরে ফেরৎ দিয়ে দিতে হবে, সক্কালবেলা দোকানদারের লোক নিয়া যাবে, কাজেই ছোটচাচার পূর্বদর্শিত ছবিছায়া আবার নতুন করে আমাদের জন্যে দেখার তো প্রশ্নই আসে না। তা-ও কখনোসখনো দুইয়েকটা সুচিত্রাছায়াছবি ভিডিয়োদোকানি দিয়া দিত সঙ্গে, যে-সপ্তাহে তেমনকিছু নতুন ইন্ডিয়ানবাংলা মার্কেটে থাকত না তখন, এইভাবে ‘দীপ জ্বেলে যাই’ বা ‘সাগরিকা’ বা ‘হারানো সুর’ বা ‘শাপমোচন’ বা ‘হস্পিটাল’ বা ‘পথে হলো দেরি’ বা ‘চাওয়া পাওয়া’ প্রভৃতি কিছু-কিছু ছবি দেখা হয়ে যেতে থাকে আমাদেরও গুটিগুটি পায়ে। সেই সময়টায় হিন্দি সিনেমায় বৃষ্টি হইত খুব বেশি, বৃষ্টিতে গান গাইতে গিয়া নায়িকার বস্ত্রাদি কিঞ্চিৎ বেসামাল হইত ঘটনা মিথ্যা না, মাগার বড়জোর ঘাগরা হাঁটুদেশ ক্রস করব-করব মুহূর্তে ক্যামেরা ধাঁই করে সরে যেত অন্ধকার গাছপালার ভেজা ঝোপের দিকে বেহুদা। সাংঘাতিক ব্যাপার ছিল এইসব তখন, ছোটচাচাদের যুগে, ‘চোলি কা পিছে ক্যায়া হ্যায়’ ব্যাপারস্যাপার অবশ্য ছোটচাচারা আবিষ্কার করতে পারেন নাই, ওইসবের কলম্বাস তো হইলাম গিয়া আমরা তথা আমাদের যুগ। অবশ্য তখনও মারদাঙ্গা ঝাকানাকা একেবারে-যে গরহাজির ছিল এমন নয়, ছিল তো, দুর্ধর্ষভাবেই ছিল, যথা জিনাত আমান বা হেলেন প্রমুখের উপস্থিতি, ছিলেন ভালোয়-মন্দে স্মিতা পাতিল সহ অনেকেই আরও। ‘সত্যম শিবম সুন্দরম’ ও ‘গঙ্গা যমুনা সরস্বতী’ কি ভুলিয়া যাইবার বাহে! এখন আমাদের ছোটচাচারা নিজেদের যুগটারে উচ্চে তুলিয়া ধরিবারে সাধুযুগ বলিয়া চিল্লাইলেই তো হলো না। আর ব্যাপারটা তো মন্দ কিছুও না, বাপু, দুইদিনের দুনিয়া। আজকের আইটেম স্যঙের প্রিডিসেসর তো ক্যাবারেড্যান্স। কাজেই দাওয়াই ছিল একটাই, পিচ্চিপুচ্চিদের নিয়া সাঁঝরাইতের দিকে এক-দুইটা উত্তমসুচিত্রা বা গুরুদক্ষিণা-বড়বউ-ছোটবউ গোছের সামাজিক অ্যাকশন নিয়া আসো, ঘুম পাড়াইয়া দাও দুই-আড়াইঘণ্টা দেখাইয়া তাড়াতাড়ি। কিংবা তখন হংকং-কোরিয়াভিত্তিক একধরনের কুংফুম্যুভি খুব বাজার ধরেছিল, এইগুলোও মনে করা হইত কম-বিপজ্জনক বাচ্চাদের জন্য, দোকানওয়ালা আমাদের কাকাকে বলে দিত চল্লিশ মিনিটের মাথায় গিয়া একটা সমস্যা আছে, সেইখানে দেড়-দুইমিনিট টেনে দিতে হবে। টেনে যখন ফরোয়ার্ড করা হইত, দেখতাম তো সব, চুমাটুমা খাইলেই কেন টানতে হবে সিনেমা এইটা আমার পাৎলা মাথায় তখনও যেমন ঢুকত না আজও তা-ই। কিন্তু সবই তো বুঝতাম, করার কিছুই ছিল না যদিও। দুঃখের সেইসব দিনে দু-দণ্ড সহায় হয়েছিলেন আমাদের সুচিত্রা সেন। তাঁরে তাই স্মরণকরণ দরকার আমার। সুচিত্রা সেন নেই তো সেই আমার জন্মেরও শুভক্ষণ হইতেই, দৃশ্যপটে অ্যাবসেন্ট, কিন্তু তথাপিও তাঁর ইম্প্যাক্ট কোথায় এবং কেমন করে সম্ভবিলো মম সুখ(ও)দুখ(ও) অসহ যৌবনে, এইটা তালাশিয়া দেখা কাজেই এসেনশিয়্যাল। নতুন করে তাঁর তিরোধান নিয়া কান্না আমার পক্ষে মেলোড্রামা হবে। সেইটা তাই না-করি। নিষ্কান্না শ্রদ্ধার্ঘ এইটা, বা সুচিত্রার্ঘ্য, মেলোড্রামা এক্সক্ল্যুডপূর্বক অ্যা প্রম্পট ট্রিবিউট টু সুচিত্রা সেন। দ্য এন্ড অফ পার্ট ওয়ান। টু বি কন্টিন্যুড।

২.
আমাদের মা-চাচিমাদেরে ঠিক সুচিত্রাসাজ ফলো করতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। আবার এইটাও তো ভুল হবে না বলা যে, সেই-অর্থে আলাদা চটকদার কোনো সজ্জা ছিল না সুচিত্রার। খুব ক্যাজুয়াল একটা ল্যুক, খুব আটপৌরে ভঙ্গি, খুব শোভন সপ্রতিভ সাবলীল সজ্জা সুচিত্রাপ্রতিমার একটা বড় বৈশিষ্ট্য বলে সবসময় মনে হয়েছে আমার। পিলে-চমকানো কিচ্ছুটি নজরে পড়ে নাই কখনো সুচিত্রাবয়বে। একটা নজরকাড়া নরম স্বাভাবিকতা তাঁর চলায়-বলায়-সজ্জায়-ম্যানারিজমে লেপ্টে থাকতে দেখেছি সবসময়। ঠিকঠাক বলছি কি না তা জানি না, কারণ সুচিত্রাবাস্তবের চেয়ে আমাদের প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে সুচিত্রাপুরাণ শুনে ও দেখে। একটা ব্যাপক সুচিত্রামিথ লতিয়ে উঠেছে আমার জন্মের আগের দশকেই চিত্রালি নীলিমায়। সেহেতু ওই মিথের একটা প্রভাব থাকতেই পারে আমার বা আমাদের সুচিত্রাবিচারকাজে। সেইটা আলবৎ অনস্বীকার্য। তবে এইটা একটু বলা দরকার যে, এমনিতেই আমি সুযোগের অভাবে সুচিত্রাক্যারিয়ারের দীর্ঘ গ্র্যাফ থেকে একদম কড়ে-গোনা চার-পাঁচটা লাইন চাক্ষুষ করেছি কেবল। মানে স্রেফ ছয়-সাতটা সুচিত্রালঙ্কৃত পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র দেখেছি এ-যাবৎ, বাকিটা নানাভাবে তাঁর ওপর নানাজনের স্মৃতিবিমুগ্ধ কথকতা আর প্রচুর স্টিল দেখে এ-জীবনে প্রেমে পড়েছিনু আমিও সুচিত্রার। রয়্যাল সাইজে একটা বই বেরিয়েছিল সুচিত্রাবায়োগ্র্যাফিক, খুব সম্ভব আনন্দ পাব্লিশার্স থেকে, প্রচুর স্থিরচিত্র দেখেছি সেখানে। এইটাও তো পথ হিশেবে ফেলনা নয় একেবারে, একজন সিনেমার্টিস্ট বা একজন চিত্রশিল্পী সম্পর্কে একটা ভালো বুঝসমুজ করে নেয়া যায়ই তো ফোটোগ্র্যাফি নিরখিয়া। একজন পেইন্টারের মূল কাজ দেখার কপাল নিয়া দুনিয়ায় কয়জন জন্মায়, এইটা নিয়া স্ট্যাটিস্টিক্স ব্যুরোর দুয়ারে যাবার দরকার নাই, বেশিরভাগই আমরা পেইন্টিঙের রিপ্রোডাকশন তথা প্রিন্ট দেখেই তো বোঝাপড়া চালাই। ল্যুভর ম্যুজিয়মে যেতে পারলে তো খুবই ভালো, না-পারলেও তো দিন চালাইবার মতন একটা আইডিয়া আমরা পায়া যাই বইপত্তরের আবছা পাতা হাতড়ে। এইভাবেই তো দুনিয়ার দুঁদে সব পেইন্টারের কাজ দেখে চলেছি আমরা। আমি নিজে সিনেমা দেখার ব্যাপারে এইটা একটা উল্লেখযোগ্য পথ হিশেবে প্রারম্ভেই প্র্যাক্টিস করে এসেছি, বিশেষত ইন্ডিয়ান কমার্শিয়্যাল সিনেম্যাগগুলো পত্রিকাছাউনিতে যেয়ে বিক্রেতার সঙ্গে খাতিরের সুবাদে দেখতে দেখতে বেড়েছে আমার অল্টার্নেইট সিনেমাভিজ্ঞতা, ‘স্টারডাস্ট’ আর ‘সিনেব্লিৎস’ প্রভৃতি পড়ে এ-জীবনে প্রচুর সিনেমার স্টোরিলাইন জেনেছি এবং মনে রেখেছি, এইভাবেই তো সুচিত্রা সেন বা ইঙমার বার্গম্যান মশাইয়ের সুলোচন-ঝর্ণাস্নিগ্ধ হিরোয়িন ইনগ্রিড বার্গম্যান সম্পর্কে জেনেছি মূলত। কয়টা কাজ দেখেছি আর, তাদের, এ-জীবনে! সেইটাই তো। সুচিত্রা সেনের সাজসজ্জা নিয়া আলাপ করছিলাম, শোভাসাজ তো বহিরঙ্গই নয়, ব্যক্তিত্বের প্রকাশটাও তো সজ্জার মধ্য দিয়া আদল পায় মানুষের। সুচিত্রাব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠার পেছনে এই দিকটা প্রাসঙ্গিক। জমক থাকে যেমন সেলিব্রেটিদের, সুচিত্রারও ছিল, জমক আনয়নে তেমন কোনো চোখে-লাগা কিছুই করতে হয় নাই তাঁকে। একেবারে অল্প হলেও তো মিনি-মিডি পরেছেন তিনি, ভি-কাট বা স্লিভলেস তো বটেই, বিকিনিও তো পরেছেন। তবু উদ্ভট মনে হয় নাই, খাপছাড়া লাগে নাই, কিংবা মনে হয় নাই যে তিনি মিডিয়াবাইট পাইবার তরে তড়পাইতেসেন। সবসময় ছিলেন ছিমছাম, শোভন মনোরম, নরম হলেও নতচিবুক ন্যাকাবোকা আবেদনসর্বস্ব ছিলেন না সুচিত্রা সেন। ওইসময় ন্যাকা নায়িকার বাজার রবরবা ছিল যেমনটা আজও আছে। ন্যাকামো সুচিত্রাতেও ছিল না তা নয়, ছিল, সীমিত সহনীয় পরিমাণে ন্যাকামি ছিল বটে। এইধারা থাকতে গেলে যেমন শরীরী ব্যক্তিত্ব দরকার, অঘোষিত মুক্তকোষ তলোয়ার, সুচিত্রার তা ছিল। এই শরীরী ব্যক্তিত্ব গড-গিফ্টেড না মেন্টেইন-করা, তা জানি না, যা-ই হোক ছিল। হয়তো সুচিত্রাছায়াছবির কন্টেন্ট ও তথায় ধৃত উপাদান ব্যবচ্ছেদ করে দেখানো যাবে সেথাকার নানাবিধ ডমিনেশন, পুরুষ ও নারীর তন্ত্রমন্ত্র আবিষ্কারকরতঃ বলা যাবে এই-এই কারণে সুচিত্রা বাঙালির আইকন হয়েছেন এবং বলা যাবে এইধারা আইকন হওয়া ন্যাক্কারজনক ইত্যাদি। তা যা-ই হোক, সুচিত্রাবিচারের মধ্য দিয়া নানাভাবে একটা বড় সময় উঠিয়ে আনা সম্ভব গত শতকের বাঙালি মনোবিন্যাস ও সংস্কৃতিদৃষ্টির। হয়তো। বলছিলাম, মা-খালা-চাচিমাদেরে আমরা সুচিত্রা-ফলোয়ার হইতে সেইভাবে দেখেছি বলে মনে পড়ে না, তার কারণ তো অনুমান করাই যায়। যেহেতু আমার জন্মবছরেই সুচিত্রা যাচ্ছেন চলে পর্দান্তরালে এবং যেই অন্তরাল থেকে এরপরবর্তীকালে এক-দেড়বার বেরোবেন মাত্র। ফলে আমাদের মা-চাচিমা তাদের নয়ন-সমুখে সেভাবে ঠিক সুচিত্রা পান নাই তো। মনে পড়ে আমাদের মা-চাচিমা ববিতাখোঁপা বা শাবানাবেণী করছেন, রোজিনাব্লাউজ পরছেন বা সুচরিতা স্টাইলে চিবুকে একটা তিল এঁকে নিচ্ছেন কাজলপ্রয়োগে, মাশকারা বা আইল্যাশ ব্যবহার করছেন, এইসব ভাসাভাসা আবছায়া মনে পড়ে ছেলেবেলার কুয়াশাপর্দার ফোকর গলিয়ে। এমনও হইতে পারে যে, এসবের পেছনে প্রেরণা হয়ে সুচিত্রাই বিরাজিছেন, আমাদের মা-চাচিমার অবচেতনে এবং আমাদের বাপ-বড়চাচা-কাকাদের নন্দনদৃষ্টিতে, অ্যাট লিস্ট ববিতা-শাবানারা তো তখন মোস্টলি সুচিত্রাকে একভাবে-না-আরভাবে ফলো করছেনই। ববিতা অবশ্য বেশ বহুলাংশে লিজ টেলর ফলোয়ার ছিলেন বলেও মনে হয়েছে একসময় আমার, অন্তত ফুলানো-ফাঁপানো কেশবিন্যাস আর তার শরীরবল্লরীর ভরাট এলিগ্যান্স ও জেশ্চার দেখে তা-ই মনে হইত, ভুলও হতে পারে আমার দেখার। সুচিত্রা কিন্তু প্রধানত শাড়িচিহ্নিত হয়েই বিরাজেন আমাদের চোখে। সেইসময় আমাদের আম্মা-চাচিআম্মা শাড়ি কিনতেন মাসে-মাসে ফেরিওয়ালাদের বিশাল বোঁচকা নামিয়ে বাড়ির বিরাট উঠানে শীতলপাটি বিছিয়ে, আর আমরা গোল ও ঘন হয়ে ঘিরে গড়াগড়ি দিতাম ফেরিওয়ালার বোঁচকা-থেকে-বেরোনো বিচিত্রবর্ণিল ও অরণ্যচিত্রল শাড়িগুলোর উপর, তখনকার শাড়িনামগুলো কয়েকটা আজও মনে আছে। যেমন ‘দুর্দেশ’, ‘আনারকলি’, ‘মিস লঙ্কা’, ‘সিলসিলা’ ইত্যাদি। সবই বিভিন্ন সিনেমানামে, প্রেক্ষাগৃহমথিত ম্যুভি ছিল সব, আজকের বুলিতে যাকে বলে ব্লকবাস্টার, এবং সুচিত্রাছায়াছবির নাম ধারণপূর্বক কোনো শাড়ি ছিল কি না তা আমার সেইসময়ের স্মৃতি ঘেঁটে বের করতে পারি নাই, সঙ্গত কারণেই তা না-পারার কথা, মা-চাচিমা কাউকে জিগাইলে মিলবে বলে ভরসা ক্ষীণ।

৩.
তখন সার্ক সম্মেলন আয়োজনী ইভেন্ট অথবা সাফ গেমস উপলক্ষে বাংলাদেশ টেলিভিশন  দক্ষিণ এশিয়ার কালচারাল এক্সচেঞ্জের আওতায় বেশ কয়খানা ভারতীয় বাংলা ফিল্ম দেখিয়েছে ইয়াদ হয়, সেইসঙ্গে হিন্দিও দুই-তিনখান, কয়েকবারের আয়োজনে এই ধারাটা অব্যাহত ছিল। বিটিভির রজত জয়ন্তী পালনকালে বেশ কয়দিনব্যাপী ছিল অনুষ্ঠানপ্রবাহ। ওই সময়েই শ্রীলঙ্কা-মালদ্বীপ-পাকিস্তান-ভুটান প্রভৃতি কান্ট্রির কিছু ম্যুজিক শোনা হয় কিছু ম্যুভিও দেখা হয় এভার-ফার্স্ট ইন মাই লাইফ, ওইসব অঞ্চলের টিউনস্কেপের সঙ্গে সেই প্রথম ওরিয়েন্টেশন ঘটে আমার, পঁচিশ পূর্তিকালে বিটিভিতে সশরীর এসে পার্ফর্ম করেছিলেন সাউথ এশিয়ার রথী-মহারথী মিউজিশিয়্যান অনেকেই। বিসমিল্লা খাঁ, আলি আকবর সাহাব, রবিশঙ্কর, মানবেন্দ্র-হেমন্ত-হৈমন্তী প্রমুখ অনেকের গান যা আমরা এদ্দিন শুধু স্টেরিয়োপ্লেয়ারে ক্যাসেট প্লে করে শুনতে পেতাম অথবা দেখতাম কালেভদ্রে চিত্রালি কি চিত্রালোকে, তাদের লাইভ পার্ফর্ম্যান্স ওই পয়লাবার দেখার মওকা পাই। কিশোরী আমনকর এসেছিলেন বোধহয়, এসেছিলেন সুচিত্রা মিত্র ও কনিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, এবং চটুল গজল গেয়ে শোর-মাচানো পঙ্কজ উদাসও বাদ পড়েন নাই নিমন্ত্রণতালিকা থেকে। সো-ফার আই রিমেম্বার ডিউরিং দ্যাট পিরিয়ড অফ টাইম দেখেছিলাম ‘দ্য সিটি অফ জয়’, ‘সদগতি’, ‘শতরঞ্জ-কি-খিলাড়ি’ প্রভৃতি। কৈশোরখোলস ছেড়ে বেরোবার মুখে এইভাবে বেশ দুই-তিনখানা উত্তমসুচিত্রাও অভিজ্ঞতান্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। একটা সাজ-সাজ রবের রাজকীয় কৈশোর পেয়েছিলাম বিটিভির রজত জয়ন্তী সুবাদে, এখন পেছন ফিরে দেখতে পাই। কিন্তু তখন বিটিভি  তাদের ইউজুয়্যাল কারিক্রমে ফ্যুল-ল্যান্থ ফিচার ফিল্ম তথা আস্তদৈর্ঘ্য বাংলা সিনেমা সারামাসে একটামাত্র প্রচার করত। ফলে খুব বেশি সিনেমা দেখার সুযোগ তখন হয়ে ওঠে নাই। ‘ইত্তেফাক’ ও ‘দৈনিক বাংলা’ প্রভৃতি নিউজপেপারে সেকালে চারপৃষ্ঠা ভরাট বড়সড় আকারে অ্যাড ছাপা হইত শুভমুক্তিপ্রাপ্ত ছবিছায়ার, অগত্যা তাইতেই সিনেমাক্ষুধা নিবৃত্তি করতে হইত আমাদেরে। এরপর অচিরে এসে যায় গৃহশীর্ষে অ্যান্টেনা টাঙিয়ে মেট্রো-দুর্দর্শন দেখার অপর্চুনিটি। ওই তখন ঝিরিঝিরি উত্তমসুচিত্রাসাবিত্রীশর্মিলা আর ঠোঁটভাঙা অভিমানী অপর্ণা সেনের অনেক পুরনো ম্যুভি দেখা হয়ে যেতে থাকে। সেইটা যাক। কিন্তু মন ঝুঁকিয়ে দেখাটা তো তখন ঠিক হয়ে উঠত না। চাঞ্চল্য তো তখনকার বয়সধর্ম আমাদের, দুনিয়ার সবকিছু অল্প-অল্প চেখে দেখার সময় সেইটা, এ-ডাল ও-ডাল ঘুরে পল্লবগ্রাহিতাই তো প্রধান বৃত্তি তখন আমাদের। সুচিত্রার সঙ্গে আলাপ-পরিচয়টা গাঢ় হয়ে ওঠে নাই তখন পর্যন্ত।

৪.
সুচিত্রাতনয়া মুনমুন সেন এক-সময় সেন্সেশন হয়ে ওঠেন, সময়টা আশির দশক, তখনও অত বড় হয়ে উঠিনি আমরা। গায়ে-গতরে বড় হয়ে উঠিনি ঠিকই, কিংবা গাণিতিক হিসাবে আটকাধীন ছোট, কিন্তু মন তো ছুটছে তখন উল্টাপাল্টা দিগ্বিদিক আলোবর্ষদ্রুতি নিয়ে। মেজাজ মশাই শাসন করে বেঁধেছেদে কে কবে রাখতে পেরেছিল? মুনমুন সেন নিয়া আমাদের চারপাশে বড়দের মধ্যে ছিছিক্কার শুনতাম। কথাগুলো খুব কানে আসত : সুচিত্রা সেনের মেয়ে হয়ে এমন খোল্লামখুল্লা মুনমুন, না না, এইটা মানা মুশকিল। ছি ছি! মায়ের মুখে চুনকালি দিলো মেয়ে। ব্লা ব্লা। মায়ের এককোণাও হইতে পারল না মেয়ে, এমন কথা বলে বেড়াত সবাই। কিংবা বাতাসে কিছু কমন ওয়ার্ডস ভেসে বেড়াত তখন, যথা বোম্বশেল, সেক্সসিম্বল, শরীরী আবেদন, সেক্স-অ্যাপিল ইত্যাদি। এইগুলো পত্রিকাবাহিত হয়ে আমাদেরও প্রথমে কানে এবং পরে মগজে গেঁথে যেতে শুরু করেছে। কিন্তু কথাটা আমার কবুল করতে কুণ্ঠা নাই যে, এতসব ছিছিক্কারের পরেও মুনমুন সেনকে ভালো লাগত তখন, আজও মুনমুন-স্থিরচিত্রগুলো অথবা ইতিউতি তার ভিশ্যুয়াল ক্লিপিংস দেখতে ভালো লাগে। মুনমুনের লাস্য ও কামনামেদুর শরীরশোভা আর তার জেশ্চার ভারি ভালো লাগত, যদিও ওইসবের মাহাত্ম্য ওই বয়সে নিশ্চয় বুঝতে পারতাম না। বড় হতে হতে একটা জিনিশ বুঝতে পারি যে, মুনমুন সব মিলিয়ে অ্যাভারেজ অভিনয়শিল্পী হলেও শরীরী আবেদনের দিক থেকে এখন পর্যন্ত বাঙালি নারীদের মধ্যে তুলনাদুর্লভ। তখন হিন্দি স্ক্রিনে জিনাত আমান প্রমুখদের প্রেজেন্স দেখে একটা চিত্তচাঞ্চল্য, বলা ভালো তনুচাঞ্চল্য, ঘটত বিলক্ষণ। তবে জিনাতদের উপস্থিতি ছিল অনেকটা সুলভ প্রকৃতির, বাংলায় এমন হলে ভলাপ্চুয়াস বলে, মদন দেব ছাড়া আর-কোনো দেবদ্বিজের আশীর্বাদ জিনাতদের মধ্যে ছিল বলে মনে হইত না। মাগার মুনমুনের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অত সরল ও সস্তা ছিল না। আভিজাত্য — শব্দটা ব্যবহার করতে আমার সর্বত্র ও সবসময় আড়ষ্ট লাগে, আভিজাত্য শব্দটা, এবং সঙ্গত কারণে যা এই মুহূর্তে ব্যাখ্যা না-দেই — মুনমুনের দেহবল্লরী ও বিভঙ্গিবিকিরিত চলাফেরা থেকে ঠিকরে বেরোত বটে। এইসব ব্যাপার তো তখন সমাজে এবং আমাদের পিচ্চিদের কাছে ট্যাবু টপিক ছিল এবং এ নিয়া সো-কল্ড সুসংস্কৃত সভ্যসমাজ ছিছিক্কার ব্যতিরেকে তেমন কথাবার্তা কইতেনও না। আমার আজও গায়ে কাঁটা দেয় একটা বই পড়ার স্মৃতি মনে করলে। সেই বইটা আমি পড়েছিলাম অনার্স ইত্যাদি রঙের পড়াশোনালাইফে। লেখক — বইটার — শঙ্করলাল ভট্টাচার্য। বইয়ের নাম ‘হার হাইনেস’। মুঘল আমলের কয়েকজন সম্রাজ্ঞী ও রাজকুমারীর শরীরী রূপ, দেহচটক, যৌবনোচ্ছ্বল আবেদন ও সেসবের ইম্প্যাক্ট ইত্যাদি নিয়ে সেই বইয়ের যাত্রাপালা আবর্তিত। প্রবন্ধের বই। শঙ্করলালের গদ্যের সঙ্গে যারা পরিচিত তারা আন্দাজ করতে পারবেন ছিপছিপে কলেবরের সেই বই কী জিনিশ হতে পারে। এই বইটা আমি দীর্ঘদিন ধরে খুঁজছি নিজের মালিকানাধীন করবার জন্য, কিন্তু বিধি বাম, এইটা আউট-অফ-প্রিন্ট দশকেরও অধিক কাল ধরে। যে-কথাটা বলবার জন্য এত কথা, তা হচ্ছে এ-ই, সেইখানে একটা মারাত্মক পরিচ্ছেদ ছিল মুনমুন সেনের সেক্স-অ্যাপিল নিয়া। অ্যাপ্রিসিয়েশন। এই-রকম বিষয় এইভাবে ক্রিটিক্যাল অ্যাপ্রিসিয়েশন হইতে-যে পারে এইটা ধারণায় ছিল না আগে, সম্ভবত বাংলা-লিখুয়া কারোরই ছিল না, ফেসবুকের এ-যুগে এইটা দারুণভাবে হচ্ছে এবং আমি নিজে উপকৃত হচ্ছি সেসব ট্যাবুমুক্ত কথাবার্তা থেকে।  অ্যানিওয়ে। শঙ্করলালের ‘রাগ-অনুরাগ’ আর ‘কোমল গান্ধার’ নামখচিত বই দুইটার গদ্যচালের প্রশংসা করতে শুনি যখন লোকেদেরে — দুইটাই তো পড়েছি আমরা ধারাবাহিক দেশ  ও সানন্দায় — এমন মায়া হয় যে এদেরে একবার যদি ‘হার হাইনেস’ বইটা পড়াইতে পারতাম! বিশেষত ওই মুনমুন সেন উপজীব্য করে লেখা শ্বাস-রোধ-করা ফাটাফাটি প্রবন্ধটা! সেক্স-অ্যাপিল প্রশংসার দাবিদার — এই ব্যাপারটা এখন পর্যন্ত যেটুকু মান্য করে চলি আমি, তার পেছনে এই একটা বই, বিশেষত এই একটা প্রবন্ধ, বিশেষত মুনমুন সেন ভিত্তিভূমি।

পোস্টস্ক্রিপ্ট : অন্যান্য অনেক অনেক আনফিনিশড আর্টিকেলের ন্যায় এই নিবন্ধও পরে আর কন্টিনিউ করা যায় নাই। পিসিফোল্ডারে এবং প্রিজার্ভড পেনড্রাইভগুলায় এই কিসিমের ক্ষীণকায় আধাছাদা আখ্যানের সহসা সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। অ্যানিওয়ে। একটু কথার লাগাম টানি। ইন প্রিসাইস বলি। ইচ্ছা ছিল সুচিত্রারে কেন্দ্রে রেখে এইটিজের আমাদের কৈশোরকাল ও নাইন্টিজের পয়লা তারুণ্যের ফ্যান্টাসিভরা পারিবারিক ছবি কিছুটা ক্যাপচার করা। তা আমি করতে পেরেছিও অনেকটা। আর সময়টা দুইহাজারচোদ্দ। যখন লিখতেসিলাম, এই নিবন্ধ। সুচিত্রা সেন, ইন্ডিয়ায়, অন্তিম শয্যায় বেশ অনেকদিন ছিলেন হাসপাতালে। সেই নিউজ ও পরবর্তী কিছুদিনের বাংলাদেশের প্রত্যেকটা বাংলা ইংলিশ পত্রিকায় বিগ চাঙ্ক জুড়ে ছিলেন দুনিয়ার আর কিছু নয় কেউ নয় একমেবাদ্বিতীয়ম সুচিত্রা সেন। মনে আছে একপক্ষকাল জুড়ে সুচিত্রাই ছিলেন বাংলাদেশের প্রত্যেকটা কাগজের লিড আইটেম। ফ্রন্ট থেকে ব্যাক মিডল সবজায়গায়। যেইটা সবচেয়ে বেশি ইয়াদ হয়, ইলেকশনের সেই বছরে শেখ হাসিনা সম্পূর্ণই বিরোধী দলমুক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন সংখ্যাগরিষ্ঠ জয়যুক্ত হন। ভূলুণ্ঠিত হয় বাংলাদেশের শেষ সম্ভ্রম। ঘটনাটা ফাইন্যালি টুক প্লেইস ইন ফিফথ অফ জানুয়ারি টুথাউফোর্টিন। সুচিত্রা সেন পক্ষকাল ক্লিনিক্যালাইজড থাকবার পরে টুক হার লাস্ট ব্রেথ ইন জানুয়ারি সেভেন্টিন্থ। ফলে, দেশের পত্রপত্রিকায় আর কিছু খবর ছাপাইবার দরকার ক্রমশ কমে আসতে থাকবার শুরু হয় এই বছরটায় পাকাপাকি। সুচিত্রা সেনের প্রয়াণপূর্ব দিনরাতগুলির আপডেট সবিস্তার সফিচার দিতে একটুও কঞ্জুসি করে নাই আমাদের পত্রিকাগুলা। আর টেরিস্ট্রিয়্যালগুলার ইনানিবিনানি ভিশুয়্যাল ফ্যুটেজভরা পাঁচালি নিবন্ধের বিবেচ্য নয়। আমরা লক্ষ করব ওইসময়কার লিডিং পত্রিকাগুলো। পয়লা পাতায় প্রায় প্রত্যেকদিন আটকলাম সুচিত্রা সেনের ইমেইজ। কয়দিন চলেছিল এমন কাভারেইজ, স্মরণ করা ডিফিকাল্ট হবে না। যাক। সকলেই পাল্লা দিয়া কাভারেইজে নেমেছিল সুচিত্রা সেন। সবচেয়ে বেশি ইমোশন্যাল হয়ে পড়েছিল, মুষড়ে পড়েছিল বলা ভালো, দৈনিক ইত্তেফাক। এই গল্প আরেকদিনের জন্য তোলা থাক। পত্রিকাগুলার মালিকপক্ষ, সম্পাদকপক্ষ, সকলেরই ইয়াং টাইম কেটেছে সুচিত্রা সেনের সিডাক্টিভ স্পেলের আওতায়। পাবনার রমা পশ্চিমবাংলার সুচিত্রা আমাদের দেশের প্রবীণ সংঘের প্রণয়দীপিকা। পাড়ুকন নয়, সেন, বাংলার রয়্যাল হাইনেস সুচিত্রা সেন। বাংলাদেশের পত্রিকাগুলার মালিকগোষ্ঠীর আশকারায় আবেগের বন্যা বয়ে গিয়েছিল খতিবের-নিকট-সাষ্টাঙ্গ সম্পাদকেরও কলমে কলিজায় লাল মাস্টহেডের সৌরপত্রিকায়। এর আগের বছরটায়, তেরোয়, দেশের ভিতরে বিতরে গিয়েছে যেই দশা, তা আর বোধহয় ইয়াদ দেনা দরকার পড়ে না। আজকের লিঙ্গুয়ায় আলবদর আর লালবদর উভয়েই জিনিশটা জানে বেশক। কথা সেইটা না। আমি জিনিশটা ওইসময় মানবিক একটা অ্যাঙ্গেল থেকে দেখতে চাইতেসিলাম। স্বদেশের সর্বপ্রকারের বোধবুদ্ধি বিলুপ্ত হবার বছরটায় এদেশেরই নিউজপেপারগুলি কীভাবে সুচিত্রা সেন কাভারেজে মেতে উঠেছিল দেখতে দেখতে আমি ভাবছিলাম অন্য কথা। কাগজের সম্পাদকগুলা আর মালিকগুলার কথা। তারাও তো যৌবনের অধিকারী ছিল ধূসর অতীতের কোনো সময়ে। এবং, মোস্ট ইম্পোর্ট্যান্টলি, ছিল স্বপ্ন ও স্বপ্ননায়িকা তাদিগেরও। হ্যাঙোভার তো, এই দেশে, সুখকর নয় এবং তা আনকাট আনেডিটেড দীর্ঘই হয়। সেই রঙিন যুগের আগের রূপালি ফিতায় শাদায়কালায় শান্তিতে ঘুমায়া আছে সাধের যৌবন তাদের। সুচিত্রায়িত পত্রিকার পাতায় পাতায় তাই নিজেদেরই যৌবন রোমন্থনের একটা চান্স তারা হাতছাড়া করবে কেন। করতাম না তাদের জায়গায় আমি হলেও। তবে আমার নায়িকা ভিন্ন হবে, এইটা আর বলতে হয় না। তারপরে এইসব দেখতে দেখতে থেকে থেকে এর লগে তুলনীয় হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পূর্ব ও পরবর্তী মিলিয়ে জমজমাট একটা পক্ষ পালন করেছিল পত্রিকাগুলো, স্মরণ করব। দৈনন্দিন রঙিন সাংবাদিকতার বাইরে বেরিয়ে বেশ একটা স্বাধীনতাহাওয়া খাইতে পেরেছিল পত্রিকার পাঠক লেখক শুভানুধ্যায়ী সকলে। এর বছরদুই আগে, বারো সালের জুলাই মাসে, হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুকালীন পত্রিকাট্রিটমেন্ট, আর তার বছরদুই পরে সুচিত্রা সেনের, প্রায় সেইম। নোটিস করেছিলাম। এই গদ্যের ফাইন্যাল পার্ট পর্যন্ত যেতে পারলে সেই ফাইন্ডিঙস বলা যাইত। প্রয়োজনীয় উপকরণগুলি ডিসলোকেইটেড হয়া যাওয়ায়, মিজাজমর্জিও, এর ফিনিশিং টাচের সহসা সম্ভাবনা নাই। ফিরে পেলে, এফিশিয়েন্ট ইন্সপিরেশন ও লস্ট রিসোর্সেস, এই নিবন্ধের পরবর্তী কিস্তিগুলায় রিয়া সেন ও বিশেষভাবেই রাইমা সেনের চ্যাপ্টার ওপেন করা যাইত। অত বকবকানির আপাতত দম ও দরকারও নাই। কিন্তু ছোট ছোট নোট আকারে, সচিত্র, এইগুলা আপ্লোড করেছিলাম ফেসবুকে, এভাবে একপ্যারাগ্র্যাফে একেকটা পার্ট, মোটমাট চার। এরপর পারি নাই আর। অবিকল রইল। শুধরাইলাম শুধু টাইপোগুলা। আর এরই মাঝখানে চলে গেছে আঠারো। চলে গেছে চব্বিশ। বাংলাদেশের ইতিহাসে আরো দুই বিকট বছর। সম্ভ্রমহরণের লজ্জায় জিভ কাটবার বছর। এর মধ্যে এফডিসি, থিয়েটার, টিভিফিকশন সহ সকল মাধ্যমের শিল্পীসাহিত্যিককবিখেলোয়াড়দের লোমহর্ষকর লোলুপতা আমরা দেখে স্থাণুর মতো পড়ে রইব। চব্বিশ যায়। আসে পঁচিশ। অবস্থা বেগতিক। হাওয়া দিগ্বিদিক। কোনোমতে নেংটিটাও ধরিয়াবান্ধিয়া রাখা যাচ্ছে না হাওয়ায়। নেংটি মাথায়। বিদায়। ফিরব, পুনরায়, অন্য সময়, অন্য কোনো দিনের পঞ্জিকায়।

জাহেদ আহমদ (রচনাকাল  ২০১৪ জানুয়ারি গানপারপ্রকাশ ২০২৫ অগাস্ট)

জাহেদ আহমদ
Latest posts by জাহেদ আহমদ (see all)
শেয়ার করুন:

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you