কবিপরিচিতি : সতেরো শতকের সুফি কবি সুলতান বাহো-র জন্ম পাঞ্জাবের সুন উপত্যকার আংগা গ্রামে। বাদশাহ শাহজাহানের রাজত্বকালে তাঁর পিতা মোগল সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। তাঁর জননী বিবি রাসতিও সুফিমার্গের পূণ্যবতী এক সন্ত হিসাবে সমাজে সম্মানিত ছিলেন। চল্লিশের অধিক গ্রন্থের প্রণেতা এ সুফি-সন্তের ইসলাম ও মরমিবাদ বিষয়ক পুস্তকগুলো রচিত হয়েছিল ফার্সি ভাষায়; তবে পাঞ্জাবি ভাষায় রচিত তাঁর কবিতাগুলো পরবর্তীকালে শুধু লোকপ্রিয়ই হয়নি, তা আজ অব্দি সুর-লয়ে গীতও হয়। সুফিতত্ত্ব বিয়য়ক ফার্সি ভাষায় রচিত তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি গ্রন্থের শিরোনাম হচ্ছে, ‘নুরুল-উল-হুদা’ বা ‘দিব্য আলোর নির্দেশনা’ এবং ‘ রিসালা-ই-রোহি’ বা ‘আত্মা বিষয়ক পুস্তক’। তবে তাঁর সমধিক লোকপ্রিয় পুস্তক হচ্ছে, পাঞ্জাবি ভাষায় রচিত মারফতি গীতিকবিতার সংকলন ‘আবিয়াত-ই-বাহো’। সুলতান বাহোকে সারওয়ারি-কাদেরি সুফি তরিকার প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।
উপস্থাপিত কবিতা ও কবির বায়োবিষয়ক তথ্য ও কবির আলোকচিত্রের সূত্র হচ্ছে ইন্টারনেট। পাঞ্জাবি ভাষা থেকে ইংরেজিতে তর্জমা করেছেন ইকবাল বাহো।
সুলতান বাহো-র কবিতা ।। ইংরেজিতে তর্জমা : ইকবাল বাহো ।। ভাবতর্জমা : মঈনুস সুলতান
জেগে ওঠো হে চন্দ্রিমা
ভাসমান মেঘমালা ফুঁড়ে জেগে ওঠো
জেগে ওঠো হে চন্দ্রিমা,
জোৎস্না ছড়িয়ে পড়ুক স্বর্গ থেকে স্বর্গান্তরে—
কিরণ অতিক্রম করে যাক মহাকাশের পরিসীমা,
নীরব প্রার্থনায় তোমার স্মরণ নেয় নক্ষত্ররাজি
তারকার হৃদয়ে উদ্ভাসিত হয় প্রত্যাশা—
প্রস্ফুটিত হয় মহাকাশে জ্যোতিষ্কের পুষ্পসাজি।
একদা যখন আমরা ছিলাম আমাদের স্বদেশে
শস্যপণ্যে ভরা ছিল আমাদের নিখিল,
মেতেছি চুনি-পান্নার তেজারতিতে
ভিক্ষুকদের মতো হালফিল—
ঘুরে বেড়াই দুনিয়াদারির গলিঘুঁজিতে,
কিন্তু পারিনি তোমাকে খুঁজিতে।
যাঞ্চা করি, কাউকে যেন ছাড়তে না হয় নিজস্ব বসতবাড়ি
দূর বিদেশে যে হয়ে দাঁড়ায় সামান্য খড়কুটার তুল্য!
তাকে যেন দিতে না হয় দুর্গম পথ পাড়ি…
এ বিশ্বজগৎ থেকে তাড়িয়ে দেয়ার জন্য
হাততালি দিয়ে আমাদের যেন চমকে দেয়া না হয়;
আমরা তো পরিত্যক্ত হয়েছি ইতোমধ্যে
তবে আমরা নির্ভয়,
চাঁদের কিরণে আমরা ধন্য
নীরবে নিচ্ছি প্রস্তুতি—হে বাহো
অনেক বছর ধরে হারিয়ে যাওয়া
আমাদের বাস্তুভিটার দিকে উড়ে যাওয়ার জন্য।
আমার অভ্যন্তরে পাঁচটি হাভেলি
আমার অভ্যন্তরে খুঁজে পাইপাঁচ-পাঁচটি আলিশান হাভেলি
উজ্জ্বল দীপাবলিতে সুসজ্জিত প্রতিটি মহল,
আরেকটি প্রদীপ খোঁজার কি-বা প্রয়োজন আমার?
খাজনা আদায়ের তহশিলদার ও বাড়িওয়ালা পঞ্চজন
রুদ্ধ করে রেখেছে যারা
অভ্যন্তরের গহীনে গোপন সরণির দেউড়ি,
তাদের কাছে আমি তো নই দায়বদ্ধ।
পাঁচটি স্বতন্ত্র মসজিদের পঞ্চইমাম যেখানে
বিশ্বাসীর কাছে পাঠাচ্ছেন আহ্বান,
আমার জন্য অন্য একটি মসজিদের কি-বা প্রয়োজন?
প্রভু যদি ইচ্ছা করেন তোমার শিরোচ্ছেদ
দ্বিধা কোরো না হে বাহো—
আদেশ পাওয়ামাত্র সমর্পণ কোরো মস্তক।
শরীর যদি সাজানো থাকত অজস্র চোখে
আমার শরীর যদি সাজানো থাকত অজস্র চোখে
প্রভুর প্রতি দৃষ্টি আমার নিবদ্ধ থাকত সারাক্ষণ,
তাকিয়ে থাকতাম আমি প্রতিটি মুহূর্ত পল অনুপল অক্লান্ত আবেগে।
যদি যাঞ্চা করতে পারতাম—
আমার শরীরের প্রতিটি লোমকূপ যেন বিবর্তিত হয় অযুত অক্ষিগোলকে
তখন কিছু চোখ পলকে নিমিলিত হলেও
তাঁকে দর্শনের জন্য অন্য চক্ষুরাজি থাকত সম্পূর্ণ উন্মুক্ত!
তারপরও তাঁকে প্রত্যক্ষ করার তৃষ্ণা
হয়তো থেকে যেত অতৃপ্ত,
কী-বা করতে পারি আমি?
আমারকাছে—হে বাহো, শুধু একবার—একটি পলক প্রভুকে দর্শন
পবিত্র কাবায় লক্ষ তওয়াফের চেয়েও উত্তম।
হিন্দু কিংবা মুসলিম নয়
হিন্দু কিংবা মুসলিম নয়
প্রয়োজন ধর্মের অমোঘ বন্ধন থেকে বিমুক্ত হওয়া
সত্যিকারের প্রেমিক কখনো মন্দিরের অভ্যন্তরে লিপ্ত হয় না উপাসনায়;
তবে ভক্তিমার্গে বিচরণ থেকে বিযুক্তও হয় না কখনো—
নিজের নিভৃতে তারা খুঁজে নেয় প্রভুকে
নীরব আলাপনে মগ্ন থাকে তাঁর সঙ্গে নিরন্তর।
স্রষ্টার সারাৎসারকে নিজ অঙ্গে ধারণ করার জন্য
তারা অজ্ঞতার ভান করে সংগোপন করে আত্মজ্ঞান।
উৎসর্গ করো নিজেকে হে বাহো এমন কারো কাছে
ভালোবাসার রঙ্গভূমিতে প্রবেশ করে বিজয়ী হয়েছেন যিনি
প্রেমের লাস্যক্রীড়ায়।
আনুষ্ঠানিক নামাজ, সেজদা কিংবা দেবালয়ে ভক্তিভরে অঞ্জলি হচ্ছে সত্যিকারের অনুসন্ধানে অপারগতার নামন্তর।
রোজা কিংবা উপবাসে সঞ্চয় করা যেতে পারে কিছু খাদ্য
এছাড়া অর্জিত হয় না অন্য কোনো ফায়দা।
পবিত্র মক্কা য়তীর্থ করতে যায় তারাই—যারা অবাঞ্চিত নিজগৃহে।
নির্দিষ্ট কোনো উদ্দেশ্য থেকে বঞ্চিত যারা,
শুধুমাত্র তারা নিজের ভক্তিকে প্রচারের জন্য প্রার্থনা করে উচ্চস্বরে।
কিন্তু যারা তালাশ পেয়েছে প্রভুর অস্তিত্ব নিজ অন্তরের অন্তস্থলে,
আনুষ্ঠানিক উপবাস কিংবা সেজদার ধার ধারে না তারা বিশেষ।
সমর্পণ
বাস করেন না প্রভু সবচেয়ে মর্যাদাবান স্বর্গে,
কাবা শরিফের পবিত্র নিলয়েও পাওয়া যাবে না তাঁকে খুঁজে।
পবিত্র ধর্মগ্রন্থ বিছড়িয়ে জ্ঞানার্জনেও তাঁকে পায়নি কেউ।
পবিত্র জলে অবগাহন করেও আমি পাইনি তাঁর তালাশ,
গিয়েছি আমি দূর থেকে বহুদূরে—
আমার নিরন্তর সফরও হয়ে দাঁড়িয়েছে নিষ্ফল অনুসন্ধান।
তবে যখনই সমর্পণ করেছি আমি নিজেকে মুর্শিদের সমীপে
দূরীভূত হয়েছে নিমেষে আমার সকল হতাশাদগ্ধ যন্ত্রণা।
মঈনুস সুলতান রচনারাশি
- সপ্তপদীর দুপুরবেলায় সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় || ইলিয়াস কমল - January 27, 2025
- স্বরচিত কবিতার অন্তর্গত অনুপ্রেরণা || হাসান শাহরিয়ার - January 24, 2025
- আর্কের হাসান ও নব্বইয়ের বাংলা গান - January 23, 2025
COMMENTS