সুনীল কৃত্তিবাস

সুনীল কৃত্তিবাস

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লোকান্তরিত হলেন যে-বছর, ২০১৩ নাগাদ সম্ভবত, না না, ২০১২, অক্টোবর, উইকি বলল, ওই টাইমটারে এনসার্কল করে আরও কয়েকটা মানুষের জীবনাবসান আগে-পরে হয়েছিল। মনে আছে এগুলো। লোকগুলারে মেমোরেবল বলব। পরে সেই টাইমও অনেকটা পার হয়ে গেল। দুনিয়াটা স্বাভাবিক, সোল্লাস, সুখেদুঃখে একে একে আরও ছয়-সাতটা বছর কাটল। সমুদ্যত দুর্বিপাক ও দৈব ঘটনাপুঞ্জও সংঘটিত হলো। তবে এই লেখায় কেবল সুনীলকেই তিন-চাইরটা প্যারাগ্র্যাফে ডেপিক্ট করব। এবং সুনীলচালিত কৃত্তিবাস  সাহিত্যপত্র।

সমস্ত হল্লাহাটির পর কৃত্তিবাস  বাংলা সাহিত্যে একটি ঘটনা। তাৎপর্যে এবং তৎপরতায় বিশ্রুত। সুনীল সেই কৃত্তিবাস, সেই বিশেষ গোষ্ঠীর শিব, অবদান রেখেছেন আজীবন। স্মরণ করছি তাকে শ্রদ্ধায়, সেইসঙ্গে স্মরণ করছি তার কাহিনি ও কবিতার সাহচর্যে বেড়ে-ওঠা আমাদের সেই সুদূর দিনগুলোকে, যেমন স্মরণ করছি নীললোহিত তথা গাঙ্গুলি সুনীলেরই নিকটকালে লোকান্তরিত কথাশিল্পী সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজকে। স্মরণ করছি আবদুশ শাকুরকে এবং আহমেদ মুজিবকে; — একজন রসাঢ্য বর্ণালি বাক্যে বিশেষ বিভূতিবিকিরণকারী একের-পর-এক বাংলা গদ্যানুচ্ছেদ উপহার দিয়ে গেছেন আমাদেরে একাধারে পঞ্চাশ বছর, অন্যজন যথাস্বভাব কবির দার্ঢ্য নিয়ে প্রেসের কবিতা  এবং পরে আরো দুটো কবিতাবই আমাদের সামনে রেখে চুপিসারে গেলেন চলে।

এটা আমরা মানি যে, একজন কবির, সৃষ্টিনিষ্ঠ যে-কোনো মানুষের মৃত্যুই পৃথিবীকে একটু হলেও অভাবী ও রঙহীন করে ফেলে চিরতরে। এঁরা প্রত্যেকেই এমন-সব রঙের আবিষ্কর্তা যা কিনা তাঁরা ছাড়া আর-কেউ প্রয়োগ করতে পারে না। আমরা এখানে, এই নিবন্ধে, সেইসব স্রষ্টা ও সৃজনকুশলীদের পরিচয় যথাসাধ্য জেনে নিতে ও জানাতে চাই যারা যার যার কাজে নিবেদিতপ্রাণ অথচ অজ্ঞাত/বোধগম্য কারণে উপেক্ষিত। সর্বক্ষণ মঞ্চদীপ যারা পান তাদের প্রতি বিরাগ নাই আমাদের, বরং সানুরাগ প্রেম রয়েছে, কিন্তু স্টলোয়ার্ট কোনো লোক বা যে-কোনো চর্চিত বিষয় নিয়া আলাপ করতে গেলে সেই আলাপের প্রাসঙ্গিকতা অনালোকিত অঞ্চলে আলোক প্রক্ষেপণের মধ্য দিয়েই প্রতিষ্ঠা পায় বলে আমরা বিশ্বাস করি। সেই বিশ্বাসের জায়গা থেকেই একজন অপরিচিত অতিতরুণ কবি যিনি লিখে গেছেন ভালো-মন্দ মিলিয়ে আমৃত্যু, করেছেন ঘরকন্না বাংলা কবিতারই সঙ্গে, এই কিসিমের নাতিদীর্ঘ নিবন্ধে সেই কবিকে/কবিদেরকে স্মরণ করতে চাই কৃতজ্ঞতার সঙ্গে। সেইসঙ্গে পূর্বসূরিদের সমূল্যায়ন মর্যাদাও দিতে চাই যথাসম্ভব।

প্রচারিত সমস্ত কৃত্তিবাসমিথ মনে রেখে এবং ভুলে গিয়ে এখানে আমরা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের শরণ নিচ্ছি কয়েকটি চিঠিসূত্রে, সঙ্গত কারণেই। শঙ্খ ঘোষের কাছে লেখা চাওয়ার উসিলায় সেইসব চিঠিতে যে-সুনীলকে পাওয়া যাচ্ছে, সেই সুনীলই এই মুহূর্তে এ-নিবন্ধে প্রাসঙ্গিক, সেখান থেকে তিনটে চিঠির ছিন্নাংশ জোড় দিয়ে একটি কোলাজ তৈয়ার করছি :

[…] কৃত্তিবাস বার করতে চেয়েছিলাম নিতান্ত স্বার্থগত কারণে, কিন্তু আপনারা বড় বাধা দিচ্ছেন। আমি সম্প্রতি কি কবিতা লিখেছি — সেগুলি আপনাদের পড়াতে চাই, কিন্তু কী করে পড়াবো। বাড়িতে গিয়ে শুনিয়ে আসা বোধহয় অত্যাচারের মতো, তাই কোনো জায়গায় ছাপাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কোথায় ছাপবো — সব কাগজই প্রতিরক্ষার কাজে এখনো ব্যাপৃত, এমনকি শতভিষাও এবার দেখলুম প্রতিরক্ষার কাজে মেতেছেন। সেইজন্যই ভেবেছিলাম সকলের কবিতা নিয়ে বেশ বড় করে কৃত্তিবাস  ছাপিয়ে সকলের মুখ দেখাদেখি করা যাবে। অর্থাৎ কৃত্তিবাসকে ভেবেছিলাম শারীরিক উপস্থিতিহীন সভাসমিতির মতো। বাংলা সাহিত্যকে রক্ষা করা বা আধুনিকতার ধ্বজা তোলা এর কোনোটাতেই আমার মন নেই। আমি এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ গ্লানিমুক্ত হয়েছি। কবিতালেখা আমার একমাত্র কাজ — কিন্তু আমার জীবনমরণের সমস্যা নয়। অথবা জীবন এবং মরণ এ দুটোরই কোনো সমস্যা নেই। সুতরাং যখন যা খুশি হয় তা খুশিমতো ভাষায় লিখে গেলে ক্ষতি কি? দুঃখ কিংবা স্ত্রীলোক কিংবা শিল্পের অমরত্ব এগুলোকে ঠাকুরঘরে পুজো না করে হাসাহাসি গল্পগুজব করলেই বা আপত্তি কি? আমি এরকম ভেবেছি। বা কেউ যদি এসবের জন্য জীবন পণ করতে চান তাতেও ক্ষতি নেই। যে-কোনো রকম লেখাতেই সাহিত্যের কিছু না কিছু উপকার হয়, অন্তত কোনো লেখাতেই যে কোনো রকম ক্ষতি হয় না এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত। আমার লেখাতে সাহিত্যের কোনো ক্ষতি হবে না, শক্তিরা যে হাংরি জেনারেশন করছে সেটা আমি পছন্দ না করলেও কারোর কোনো ক্ষতি হবে না জানি, অলোকবাবুরা যে কবিতার শুদ্ধতা রক্ষার চেষ্টা করছেন তাতেও কোনো ক্ষতি নেই, আপনার নীরবতায়ও কোনো ক্ষতি হবে না বরং ব্যক্তিগতভাবে আপনার লাভই হতে পারে।

[…] যা-ই হোক, কৃত্তিবাস  আমার দ্বারা আর বার করা সম্ভব হবে না। আমার ধৈর্যচ্যুতি হচ্ছে। এ কাজ আমাকে আর মানাচ্ছে না। কয়েকজন ইতিমধ্যে লেখা দিয়েছেন — তাই একটা সংখ্যা বার করতেই হবে। আমার সম্পাদনায় এটাই কৃত্তিবাসের অবশ্যম্ভাবী শেষ সংখ্যা। অন্য কেউ যদি কৃত্তিবাস  বার করতে চান তাঁকে আমি সাহায্য করতে পারি — কিন্তু আমার উদ্যোগে এই-ই শেষ।

[…] কৃত্তিবাস  আগের সংখ্যা কেমন হয়েছিল, আপনার মতামত জানতে পারিনি। আমার ভালো লাগেনি। অনেক জিনিশই আর কিছুদিন পর ভালো লাগে না। যা-ই হোক, গ্লানিমুক্ত হবার উপায় আর-একটি সংখ্যা বার করা। বার করছি। জুলাইয়ের শেষে বা আগস্টের শুরুতেই বেরিয়ে যাবে — আপনার লেখা অবিলম্বে চাই। এক দশকে সঙ্ঘ ভেঙে যায়, আশ্চর্য, তবু কৃত্তিবাস  আবার বেরোবে কেন? ঠিক বুঝতে পারছি না। এ সংখ্যাটা দেখা যাক।

[…] প্রতি সংখ্যাতেই অনেক ভুল-ত্রুটি থাকে, অনেক কাঁচা উত্তেজনা থেকে যায় — কিন্তু কৃত্তিবাসের মূল উদ্দেশ্য বোধহয় এখনও নষ্ট হয়নি। নাকি হয়েছে, আমি দেখতে পাচ্ছি না? তাহলে আমাকে বলবেন। বন্ধ করে দেবো। শুধু বাঁচিয়ে রাখার জন্য কৃত্তিবাস  ছাপার কোনো দরকার নেই। বিশেষত ও-কাজটা খুব-একটা পার্থিব সুখকর কাজও নয়। কৃত্তিবাস  সম্বন্ধে আপনারও বিশেষ দায়িত্ব আছে — আমি সবসময় মনে করি।

কৃত্তিবাস  বহুদিন বন্ধ থাকবার পর সুনীলের প্রৌঢ় বয়সে ফের বেরোনো শুরু হলো। ঘটনাটা, এই কৃত্তিবাস  পুনরায় বেরোনোটা, সেলিব্রেশন্যাল একটা তামাশা ছাড়া আর কিছুই যোগ করতে পারে নাই ইন্ডিয়ান বাংলা সাহিত্যে। অ্যাড মিলেছে ব্যাপক, সুনীলের সেই তরুণ দিনের শতচ্ছিন্ন অভাবের উতরোল ঘনঘটা নাই, বিজ্ঞাপনদাতারা পয়সা ঢেলেছে এক ক্ষমতাশালীর পায়ে। সুনীল ততদিনে কলকাতার শেরিফ। সত্যি সত্যিই শেরিফ পোস্টটা ক্রিয়েট করা হয়েছিল সুনীলের জন্য, সাম্মানিক। এইসব তামাশা হয়েছে শেষ একদশক জুড়ে।

এখন তো বোধহয় এক নয়, কৃত্তিবাস  নামে একজোড়া কাগজ বেরোয় ইন্ডিয়ায়; একটায় প্রিন্টার্স লাইনে সুনীলপত্নী স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়ের নাম ছাপা হয়, আরেকটা কাগজ মাসিক হিশেবে প্রতিভাস প্রকাশনী বাইর করে। শেষোক্তটা সার্কুলেইটেড বেশি। আমাদের দেশে ইন্ডিয়ান বইয়ের অ্যাজেন্সি বাতিঘর  প্রতিভাসের কৃত্তিবাস  নিয়মিত আমদানি করিয়া থাকে। সুনীলেরটাও করে, সেইটা তো ছোটকাগজ টাইপের মামলা, কোথায় কোন চিপায় ঘাপ্টি মেরে থাকে বোঝা যায় না। বাতিঘরে মোটা মোটা বইয়ের কারবারই বেশি, চোখ ঠাঠায় এমন বইপত্রালি।

বিশেষ দ্রষ্টব্যে এই কথাটা রাখি বলে যে, বাংলাদেশের কবিতায় বা সামগ্রিক সাহিত্যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাজ কীভাবে মূল্যায়িত হয় তা জানি না, শুধু জানি যে বাংলাদেশের হার্ডকোর কবিতাপাঠক থেকে শুরু করে সাধারণ শখের পাঠক সবার কাছে সুনীলের নামটা এবং তার অন্তত পাঁচ-ছয়টা কবিতা তো অত্যন্ত পরিচিত। কবিদের ক্ষেত্রে এইটা আরও প্রযোজ্য যে এদেশের সকল কবিই তাদের কবিজীবনের শৈশবে সুনীল পড়ে এসেছেন। উন্নত প্রজাতির অঙ্গুলিমেয় কবি অবশ্য থাকতেই পারেন যারা সুনীলের নামটা হারাম শ্রবণও করেন নাই ইহজন্মে। অঙ্গুলিমেয়দের কথা আলাদা, তাদের নিয়া সাধারণ আলোচনা বারণ, তারা স্বয়ং বরেণ্য নবযুগ, তারা বাংলা কবিতার অতি উপাদেয় গ্রিল ফ্রাই এবং বার্বিকিউ রন্ধন করিয়া থাকেন হামেশা। তারা দীপ্তিময় দেশপ্রেম। পরদেশি কবির নামোচ্চারে তারা সার্বভৌমত্ব খোয়া যাবার আশঙ্কায় ভোগেন; অমূলক নয়, বিজনেসের দিকটা মাথায় রাখলে।

লেখা : মিল্টন মৃধা

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you