বিলাতবাসীর কড়চা || ফারুক আহমদ

বিলাতবাসীর কড়চা || ফারুক আহমদ

The lunatic, the lover, and the poet, are of imagination compact. — Shakespeare

কথাগুলোর বাংলা তরজমা করলে ভাবার্থ দাঁড়াবে — ‘কবি, প্রেমিক ও পাগল একই প্রজাতির লোক’।

এমনই একজন মানুষ ছিলেন আব্দুল হামিদ। তাঁর হাত ধরে আমি ১৯৮৯ সালে যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমাই। উনিশ’শ ষাট থেকে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত পূর্ব লন্ডনের প্রবীণদের কাছে তিনি ‘সলিসিটর হামিদ’ এবং নবীনদের কাছে ‘হামিদভাই’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। অথচ তিনি সলিসিটর ছিলেন না। সমাজকর্ম করতে গিয়েই লোকে তাদের নিজের অজান্তেই তার এ নামকরণ করে। যেমন লন্ডনে এসে বর্তমান সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর থানার বিশিষ্ট সমাজকর্মী আইয়ুব আলী হয়েছিলেন ‘আইয়ুব আলী মাস্টার’, ছাতকের আশিদ আলী হয়েছিলেন ‘আশিদ আলী মাস্টার’। হামিদ সাহেবের বাড়িও জগন্নাথপুর থানার আটঘর গ্রামে। দীর্ঘদিন তাঁর সান্নিধ্যে থেকে আমি অনেকবার ভেবেছি তিনি উল্লিখিত কোন পর্যায়ে পড়েন? কখনও মনে হয়েছে তিনি আত্মভোলা এক কবি। কখনও মানবপ্রেমিক। আবার কখনও মনে হয়েছে লোকটা আসলেই একজন সংগীতপাগল, বাউল। শিক্ষাজীবনে ভালো ছাত্র ছিলেন। হাজি মোহাম্মদ মহসিন বৃত্তিও পেয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়ে লেখাপড়াও করেন। বাংলা, ইংরেজি ও উর্দু তিনটি ভাষাতেই তাঁর মোটামুটি দখল ছিল। উনিশ’শ ষাটের দশকে যখন সারা সিলেটব্যাপী বিলাতে আসার উন্মাদনা, চারণকবি তৌরিছ মিয়া কামালীর গানে সেই ব্যাপারটা ধরা পড়েছে এভাবে :

উঠল রে লন্ডনের জ্বর
জায়গাজমি বিক্রি কর
তাড়াতাড়ি পাসপোর্ট কর
দিন তো গইয়া যায়।।

আব্দুল হামিদও আর দেশে বসে লেখাপড়ায় মন লাগাতে পারেননি। লেখাপড়ায় ইতি টেনে ১৯৬৩ সালের ৯ অক্টোবর তিনিও সেইসব সিন্দাবাদের মতো মানুষের সহযাত্রী হয়ে লন্ডনে পাড়ি জমান। ব্রিটিশ সরকার তাদের প্রয়োজনে জবভাউচার ইস্যু করলেও এদেশেও কিছু মানুষ ছিল এবং আজও আছে, তারা অপরিণামদর্শী, হিংস্র, কূপমণ্ডূক, কাপুরুষ বর্ণবাদী। তারা কালো মানুষ দেখতে পারত না। তাই তারা বাঙালি বা তৃতীয় বিশ্বের দেশ থেকে আগত এই সহজ-সরল নিরীহ মানুষগুলোকে, যারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের থাবায় লণ্ডভণ্ড এদেশটাকে নিজেদের শ্রম ও ঘাম দিয়ে গড়তে এসেছে তাদের সহজভাবে নিতে পারেনি। যখনই একা পেয়েছে তাদের উপর হায়েনার মতো চড়াও হয়েছে। এদেশে এসে আব্দুল হামিদও এই বর্ণবাদী হামলার শিকার হন। আঘাত পান মাথায় ও মুখে। সেই আঘাতের ক্ষত জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি মুছতে পারেননি। একটু একটু করে তাকে কাবু করেই চলছিল বর্ণবাদী আঘাতের বিষক্রিয়া। অত্যন্ত আত্মভোলা বোহিমিয়ান চরিত্রের এই মানুষটি ছিলেন নিঃসন্তান। তাই সংসারের প্রতি খুব-একটা মোহ ছিল না। জীবনের বেশিরভাগ সময়ই ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতায় কাটিয়েছেন। বাংলা ভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতে চালু করেছেন ‘হিউজ ভ্যালেন্স সাপ্লিমেন্টারি স্কুল’। গঠন করেছেন এখানকার শিল্পীদের নিয়ে ‘ঝলক ইন্টারন্যাশনাল আর্টিস্ট কোম্প্যানি লিমিটেড’ ইত্যাদি নানা সংগঠন। বিভিন্ন সময় এখানকার শিল্পীদের যেমন পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন তেমনি দেশ থেকে শিল্পী নিয়ে এসে এদেশেও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন। নিজেও গান করতেন। আঞ্চলিক, পল্লিগীতি ও মুর্শিদি গান নিয়ে ‘আকুল প্রাণের বিরহ’ এবং ‘বিরহের পল্লীগীতি’ নামে তাঁর দুটি গানের ক্যাসেট বের করেছিলেন। তিনি কোথাও গানের আসর পেলে আর দুনিয়াদারির খবর থাকত না। খাওয়াদাওয়ার কথা ভুলে গিয়েই দিনরাত গানের মজলিসে মশগুল থাকতে পারতেন।

১৯৮৮ সালের দিকে আবারও তাঁর শখ হলো দেশ থেকে গানের দল নিয়ে এসে লন্ডনে অনুষ্ঠান করবেন। এতে বিনোদনের পাশাপাশি দু-একজন আত্মীয়স্বজনকেও লন্ডনে নিয়ে আসতে পারবেন। এই বোধ থেকেই দেশে যান। দেশ থেকে গানের দল নিয়ে আসতে হলে প্রথমে যুক্তরাজ্যে সংশ্লিষ্ট সংগঠন অথবা এর কর্মকর্তা যাঁরা স্পন্সর হবেন তাঁদের ভালো আর্থিক অবস্থা ভালো থাকতে হয়। হোম অফিসকে প্রমাণ দিতে হয়, যে বা যিনি স্পন্সর করছেন তাঁর দেশ থেকে নিয়ে আসা শিল্পীদের রাখা এবং থাকা-খাওয়ার ব্যয়ভার বহনে তিনি সক্ষম। তারপরেই কেবল দেশে গিয়ে শিল্পী সিলেকশন সহ বাকি আয়োজন করতে হয়। এদেরকে অর্থাৎ প্রকৃত শিল্পীদের খাম হিসেবে ব্যবহার করে তাদের মধ্যে যন্ত্রী বা এক-দুইজন অশিল্পীকেও শিল্পী  হিসেবে চালান দেয়া যায়। এ উদ্দেশ্যে তিনি তাঁর সমুন্ধি, আমার বিশেষ বন্ধু ছাতক থানার বাঘবাড়ি নিবাসী শিল্পী আবুল বশরের সহযোগিতা চান। আবুল বশর জনাব হামিদকে ভিড়িয়ে দেন আমার কাছে। কারণ, হামিদ সাহেবের বোহিমিয়ান স্বভাবের জন্য তিনি তাঁর ওপর নির্ভর করতে পারছিলেন না, আবার ছোটবোনের স্বামী হিসেবে অবহেলাও করতে পারছিলেন না। সেজন্য আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন সম্ভব হলে মিস্টার হামিদকে সাহায্য করার জন্য।

প্রথম আলাপেই কেন জানি তাকে আমার সহজ-সরল ভালো মানুষ বলেই মনে হলো। কিছুক্ষণ আলাপ-আলোচনার পর আমি তাকে সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দিলাম। শর্ত হলো আমার একজন বন্ধুকে তাঁর দলভুক্ত করতে হবে। তিনি আমার তখনকার বিশেষ বন্ধু ও পরবর্তীকালে আপন মামাশ্বশুর মুহিবুর রহমান তালুকদার (টেনু)। প্রশ্ন থাকতে পারে আমার কাছে হামিদ সাহেবকে ভিড়িয়ে দেবার কারণ কি? হ্যাঁ, কারণটা হলো, আমি তখন রেডিও বাংলাদেশের অনুমোদিত গীতিকার ও নাট্যকার। সে-সুবাদে রেডিও বাংলাদেশের শিল্পীদের সাথে আমার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। দ্বিতীয়ত আমি তখন ছাতকে ব্যবসা ও বসবাস করি। সে-কারণে ছাতকের শিল্পী সুবলচন্দ্র দেব, সাধনকুমার চক্রবর্তী, স্বরজিৎ দে মিলন, আবুল বশর প্রমুখ এবং পাশাপাশি কনকচাঁপা খেলাঘর আসর, ছাতক শিশু অ্যাকাডেমি ইত্যাদি সংগঠনের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। আমি ছাতকে যাবার পর আমার মনে হয়েছে সংগীতজগতের অনেকটা গুরু হয়ে রয়েছেন গীতিকার গিয়াস উদ্দিন আহমেদ। সেই নির্দিষ্ট এলাকার তিনিই একচ্ছত্র সাম্রাট। গানের জন্য ক্বারী আমির উদ্দিন থেকে আরম্ভ করে সকলেই তার কাছে যান। আমার কাছে মাত্র একজনই। তিনি সুবলচন্দ্র দেব। আমি তখন পর্যন্ত আধুনিক এবং দেশাত্মবোধক গানই লিখি। অথচ ছাতকে আঞ্চলিক এবং গল্লিগীতির শিল্পীই বেশি। তার অবস্থান দেখে আমারও কিছুটা টনক নড়ল। আমিও আঞ্চলিক এবং পল্লিগীতি লিখতে শুরু করলাম। দেখতে না দেখতে প্রায় সকলকেই আমার ঘাটে ভিড়াতে সক্ষম হলাম। কিন্তু একজনকে আর আনা হলো না তিনি ক্বারী আমির উদ্দিন। এমনকি তার সাথে আমার কোনও পরিচয়ও গড়ে উঠল না। কারণ, গিয়াসভাইয়ের কাছ থেকে একটি অভিযোগ শুনতে পাই। অভিযোগটি ছিল, সিলেট মধুশহিদ এলাকায় একটি গানের আসরে ক্বারী আমীর উদ্দিন, গিয়াস উদ্দিন আহমদের একটি গান তার নিজের নামেই চালিয়ে দেন। গানটির কথা ছিল : ‘হুরু ঠাকুর মোরে লইয়া সিলট যাইবায়নি’। এ বিষয়ে পরে গিয়াসভাই কৈফিয়ত চাইলে আমীর উদ্দিনের উত্তর ছিল, রাতে ঘুমের ঘোরে তিনি গিয়াস উদ্দিনের নামের পরিবর্তে তার নিজের নামটি বলে ফেলেছেন। যাক, আমি ছাতক যাবার পর গিয়াসউদ্দিন আহমদের সেই একক সাম্রাজ্যে কিছুটা হলেও ধাক্কা লেগেছিল বলেই মনে হয়। অধিকাংশ শিল্পী বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের শিল্পীরা তখন একে একে আমার দিকে ঝুঁকে পড়েন। শুধু ক্বারী আমির উদ্দিন আহমদকেই দেখতাম বিভিন্ন অনুষ্ঠান থেকে বাসযোগে বাড়ি ফেরার পথে গিয়াসভাইয়ের সাথে তার অফিসে বসে গল্প করতে, তার কাছ থেকে গান নিতে। সে-যাক, দশজনকে নিয়ে আমরা গানের একটি দল ঠিক করলাম। কিন্তু হামিদ সাহেব পালে যতই হাওয়া লাগতে শুরু করল ততই তিনি তার নিজের অবস্থানের কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে একের পর একজনকে তার দলভুক্ত করতে লাগলেন। এভাবে তিনি ১০ জনের জায়গায় ২৭ জনকে তার দলভুক্ত করে ফেলেন। অর্থাৎ যাকেই পান তাকেই দলভুক্ত করে ফেলেন। অবস্থা দেখে আমি অনেকটা হতাশ হয়ে পড়ি। তখনই উপলব্ধি করতে সক্ষম হই কেন আবুল বসর সাহেব মি. হামিদকে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে কেটে পড়েছিলেন। এই পুরো দলের মধ্যে শিল্পী ছিলেন বড়জোর চার থেকে পাঁচজন। একসময় দলের সদস্যরা আবিষ্কার করলেন যে, তাদের দলে সকলেই আছেন একমাত্র আমি নেই। ফলে আমাকেও অনেকটা জোর করে দলীয় গীতিকার ও নাট্যকার হিসেবে দলভুক্ত করা হলো। এতে দলের সদস্যসংখ্যা দাঁড়াল ২৮ জনে।

আমরা দোটানা মন নিয়ে অর্থাৎ এত লোকের ভিসা হবে কি হবে না এই দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়েই ১৯৮৯ সালের ৬ অগাস্ট ব্রিটিশ হাইকমিশনে গিয়ে ভিসার জন্য ইন্টারভিউ দিলাম। ইন্টারভিউয়ের পরে জানানো হলো আমাদের সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়েই ভিসা ইস্যু করা হবে। পাসপোর্টে লিখে দেয়া হলো ‘ইসি অ্যাপ্লাইড ফর ঢাকা’। শেষ পর্যন্ত যাচাইবাছাই শেষে আমাদের ডাক আসলো ১১ ডিসেম্বর। ২৮ জনের মধ্যে ভিসা পেলাম মাত্র ৪ জনে। এর মধ্যে হামিদ সাহেবের কোনো নিকটাত্মীয় ছিলেন না। মজার ব্যাপার হলো ভিসাপ্রাপ্ত আমাদের এই চারজনের মধ্যে কেউই সংগীতশিল্পী নন। পাসপোর্টে আমার পেশা ছিল গীতিকার ও নাট্যকার। চায়না চৌধুরী নৃত্যশিল্পী, আজরা জেবিন যাদুশিল্পী এবং মালেক খান ও গিয়াস উদ্দিন আহমদের পেশা ছিল শিল্পী। অথচ প্রকৃতপক্ষে গিয়াস উদ্দিন আহমদও শিল্পী নন, গীতিকার। মালেক খানও শিল্পী নন, শখের বশে মাঝেমধ্যে গান করেন। মাত্র ২০ দিনের ওয়ার্কপারমিট নিয়েই আমরা রওয়ানা দিয়ে ২৭ ডিসেম্বর লন্ডনের হিথ্রো এয়ারপোর্টে হাজির হলাম। আগে থেকেই যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন শহরে হলবুকিং করা ছিল। কিন্তু সংগীতানুষ্ঠানের জন্য শিল্পী কোথায়? আজরা জেবিন এবং চায়না চৌধুরী ছাড়া আমরা সকলেই লেখক। বড়জোর কোরাসে কণ্ঠ দিতে পারি। গিয়াস উদ্দিন আহমদ যৌবনে একতারা বাজিয়ে, মাথার বাবরি চুল দুলিয়ে মালজোড়া গান করলেও প্রায় দুই-তিন দশক ধরে তিনিও গান গাওয়ার ধারেকাছেও নেই।

এ ধরনের সংকটের সময় অনেকটা মুশকিল আসানের বটিকা হিসেবে কাকতালীয়ভাবে আমেরিকা থেকে এসে আমাদের সাথে যোগ দেন শিল্পী উমা খান ও তার স্বামী আমাদেরই এলাকার লোক ও পরবর্তীকালে অভিনেতা হেলাল খান। তখন তবলাবাদক হিসেবে পেয়ে যাই দেবু চৌধুরীকে। এই সকলকে নিয়ে জোড়াতালি দিয়ে আমাদের প্রথম অনুষ্ঠানটি হয় লন্ডনের হেকনি টাউন হলে। হামিদ সাহেব দিলখোলা মানুষ। সকলের বন্ধু। সকলের হামিদভাই। তাই চালাক লোকেরা টিকিট না কেটেই হামিদ সাহেবের সাথে দেখা করার কথা বলে তাকে ডেকে এনে ভাই-হামিদভাই ডেকে ডেকে তার সামন দিয়ে সোজা পথ ধরে থর থর করে হলে ঢুকে পড়ে। এভাবেই লোকে ভর্তি হয়ে যায় পুরো হল। হামিদভাই তাদেরকে টিকিট কেটে শোতে আসার কথা আর মুখ থেকে বের করতেও পারলেন না। ডোরম্যানকেও বলতে পারলেন না তাদের ঠেকিয়ে রাখতে। ফলে যা হবার তা-ই হলো। এতে টিকিট যা বিক্রি হয়েছিল তা দিয়ে হলের খচরটাও উঠানো যায়নি। এভাবে প্রায় প্রত্যেকটি শোতে হামিদ সাহেব গচ্ছাই দিচ্ছেলেন। তবুও তার কোনও আক্ষেপ নেই, ভ্রুক্ষেপও নেই। ওদিকে আজরা জেবিন এবং চায়না চৌধুরীকে নিয়ে ছিল যত সমস্যা। দুজনে কী জানি কেন খুব একটা বনিবনা ছিল না। কারণে-অকারণে তাদের মধ্যে ঝগড়া লেগেই থাকত। প্রথম ঝগড়া লাগে পপলার এলাকায় যে ঘরটিতে আমরা থাকতাম সেই ঘরে। কারণ, হিদল শুঁটকি ভোজন। আজরা জেবিনের হিদল শুঁটকি না-হলে চলে না। তাই তিনি বাংলাদেশ থেকে আসার সময় তার প্রিয় খাবার বিকট গন্ধযুক্ত এই শুঁটকি সাথে করে নিয়ে এসেছেন। হিদল শুঁটকি রান্না করার তরিকাও নাকি আলাদা। প্রথমে তেলে ভালোভাবে ভেজে তার পরেই মূল রান্নার সাথে মেশানো হয়। সেদিন আজরা জেবিন তার ওই বিশেষ খাবারটি নিজেই রান্না করবেন। আমাকে বললেন, ‘ফারুক সাহেব, আজ আমি মজার একটি তরকারি রান্না করছি, খেয়ে হাত চাটতে হবে। এতদিন অন্য যাদু দেখেছেন, আজ দেখবেন রান্নার যাদু।’ আমিও জিহ্বায় শান দিতে শুরু করলাম যাদুময় খাবারটি উপভোগের জন্য। কিন্তু বেরসিক চায়না চৌধুরী সূচনাপর্বেই শুরু করে দেন সমস্যা। কারণ, শুঁটকি ভাজার গন্ধে ঘরে থাকাই তখন দায় হয়ে পড়েছিল। এ নিয়ে ক্ষেপে যান চায়না চৌধুরী। পক্ষ নেন তারই স্বামী মইদুল ইসলাম। সমস্যার সমাধান করতে আমরা যখন ব্যস্ত ঠিক সেই সুযোগেই শুঁটকিদেবী সগৌরবে তার গন্ধ বা খুসবু যা-ই বলেন তা ছড়িয়ে পুরো ঘরটাকে মোহিত করে দরজা-জানালা ছাপিয়ে সগৌরবে বাড়ির আঙিনায় ছড়িয়ে পড়েছেন। ভাবখানা এখন যেন তিনিও এই ম্লেচ্ছদের দেশটি দেখতে চান, তার অস্তিত্ব জানান দিতে চান। কিন্তু আমরা রাজভক্ত মানুষ। ঘরের বাড়ির মালিক বাইরে ছিলেন, তিনি সেই গন্ধ পেয়ে ভয়ে-রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে ঘরে ঢোকেন। কারণ, তার নেইবারদের অনেকে বর্ণবাদী। এ নিয়ে কেলেঙ্কারি হয়ে যেতে পারে। এমনকি পুলিশ ডাকার মতো ঘটনাও ঘটে যেতে পারে। বেচারা সংগীতপ্রিয় মানুষ। বউ দেশে তাই দয়া করে ঘরে থাকতে দিয়েছেন। এখন যদি পুলিশ কিংবা কাউন্সিলের লোক আসে তাহলে তাকে কৈফিয়ত দিতে হবে — আমরা, এই কালো কালো লোকগুলো কারা এবং এখানে কি করছি? তখন তাকেই জবাবদিহি করতে হবে আর এতেই বারোটা বাজার সম্ভবনা। কারণ তিনি রাণীর খাস মেহমান। রাজভক্ত মানুষ তাই তাকে এই ব্রিটিশ রাণীমাতার দেশে নৌজোয়ান হয়েও অজগরের মতো বসে বসে অলস দিন কাটান, কোনও কাজকর্ম করার প্রয়োজন হয় না। এখন রাণীমাতার চ্যালারা যদি বোঝেন ব্যাটা নচ্ছার, গোপনে ঘর ভাড়া দিয়ে বাড়তি কামাই করছে তাহলে আর রক্ষা নেই। কালীমূর্তি ধারণ করে বেচারার সবকিছুই কেড়ে নেবেন। তারপর শুরু হবে পাই পাই করে হিসেব প্রদানের পালা।

কিন্তু কে শুনে কার কথা। শুধু গন্ধ নিয়েই আজরা জেবিন এবং চায়না চৌধুরীর মধ্যে ঝগড়া তখন সপ্তমে। কখনও কখনও চুলাচুলির পর্যায়ে যায় যায় করছে। এই সুযোগে বেচারা ঘরের মালিক আমাদের দেশ থেকে আদর করে নিয়ে আসা মূল্যবান শুঁটকিগুলো পলিথিনের ব্যাগে ভরে, দরজা-জানালা খুলে দিয়েই ঘরে যত এয়ার ফ্রেশনার ছিল সেগুলোর সুগন্ধি শুঁটকিদেবীর পায়ে নিবেদন করলেন। এই শ্রদ্ধা পেয়ে শুঁটকিদেবী তার গন্ধ মোচন করলেন। ইতোমধ্যে এই দুই মহিয়সী মহিলা গলাবাজি করতে করতে অনেকটা ক্লান্ত। গলার সুরও নরম হয়ে আসতে আসতে ধীরে ধীরে আমাদের তোয়াক্কা না করেই থেমেই গেল। ভাগ্যিস গলাবাজি আর চুলাচুলিতে গড়াল না। আমরাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। ঐদিনই হামিদ সাহেবকে ডেকে এনে আজরা জেবিনকে তাঁর ঘরেই স্থানান্তর করা হলো। পড়বি তো পড় মালির ঘাড়ে। বিষয়টা তা-ই হলো। ওখানে গিয়ে আজরা জেবিনের হাত থেকে আর টেলিফোন নামে না। প্রতিদিন যখন-তখন বাথরুমে গিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বাংলাদেশে ফোনে আলাপ চালিয়ে যান। হামিদ সাহেব প্রমাদ গুণলেন। এক পর্যায়ে আজরা জেবিনকে আবারও স্থানান্তরিত করা হলো বাসদ নেতা ম.আ. মুক্তাদিরভাইয়ের শেডওয়েলের আস্তানায়। সেই কোয়ার্টারে হামিদ সাহেবের টেলিফোনবিল এসেছিল ১৮০০ পাউন্ড! এখনকার হিসেবে দুই তিন লাখ টাকার মতো!

তারপরের সমস্যা হয় চায়না চৌধুরীকে নিয়ে। এভাবে হামিদ সাহেবের পুরো আয়োজনই মাঠে মারা যায় এবং তিনি এক-পর্যায়ে প্রায় দেউলিয়ার পর্যায়ে চলে যান। এই আর্থিক বিপর্যয় থেকে তিনি আর উঠে দাঁড়াতে পারেননি। তারপর একে একে সবাই চলে গেলেও তার আশীর্বাদে আমিই শুধু লন্ডনে থেকে যাই। নিঃসন্তান আব্দুল হামিদ এবং তাঁরই সুযোগ্য স্ত্রী ফিরোজা খাতুন (মীরা) আমাকে তখন তাদের আপন ছোটভাইয়ের মতোই গ্রহণ করেন। তারা আমাকে বিয়ে করান, আমার এবং আমার স্ত্রীর জন্য তাদের একবেডরুমের ঘরের নিজেদের রুমটাও ছেড়ে দিয়ে সোজা সিটিংরুমে গিয়ে আশ্রয় নেন। পাঠক, একবার ভাবুন কত বড় হৃদয়ের অধিকারী হলে মানুষ এমনটি করতে পারে? আপনারা এই দুটি মানুষকে কী বলে অভিহিত করবেন? যাক, সেই থেকে তার মৃত্যুর দিন পর্যন্ত (৩০ জুন ২০১১) অর্থাৎ প্রায় দুই দশকেরও বেশি সময় আমরা একই পরিবারের সদস্য হিসেবেই কাটিয়েছি। তার ইচ্ছা ছিল আমি এখানকার কোনও একটি পত্রিকায় কাজ ধরি। এতে কর্মসংস্থানের পাশাপাশি লেখালেখির কাজও চালিয়ে যেতে পারব। শুরু হলো আমার জন্য হামিদভাইয়ের কাজ খোঁজার মহড়া। সাপ্তাহিক সুরমার প্রধান সম্পাদক ডাক্তার ফজল মাহমুদ, সম্পাদক নজরুল ইসলাম বাসন, জনমত-এর আনিসভাই, সৈয়দ সামাদুল হক এবং দেশবার্তার গাজীউল হাসান খান সবার সঙ্গেই আলাপ চলছে। ইত্যবসরে একদিন ফোনে আলাপ হয় সিলেটের প্রথিতযশা সাংবাদিক-কবি প্রয়াত মহীউদ্দিন শীরুর সাথে। হামিদভাই ও আমার ইচ্ছার কথা শুনে ধমক দিয়ে বললেন, ‘জানো, সুরমায় কাজ করে সপ্তাহে আমি কত পেয়েছি? তা দিয়ে তোমার স্ত্রীর প্রসাধনীও হবে না। এর চাইতে বরং কোনও রেস্তোরাঁয় গিয়ে কিচেনপোর্টারির কাজ ধরো।’ তারপর আরও কিছু সবক দিলেন। তার ধমক খেয়ে, যুক্তিতর্কের সাথে হেরে গিয়ে, সুবোধ বালকের মতো এদেশে বসতি স্থাপনকারী আমাদের পূর্বসূরিদের একেবারেই খানদানি পেশা ‘ভাত বেচায়’ যোগ দিলাম। শীরুভাই, হামিদভাইকেও আমার কোন ধরনের পেশা গ্রহণ করা উচিত তা বুঝালেন। তিনিও বিষয়টা বুঝলেন। সেই থেকে আমি পেশায় ‘ওয়েটার‘। পাসপোর্টে পেশা ছিল গীতিকার ও নাট্যকার। অর্থাৎ দুটো পদবিরই শেষে আছে ‘র’। এবার পেশা বদল হলেও পদবির শেষের ‘র’টা বদল হলো না। মাঝে কিছুদিন কিচেনের কাজ শেখার জন্য শখে কিচেনপোর্টারিও করেছি। অর্থাৎ সেখানেও ‘র’। ক-বছর পর কিছুটা প্রমোশন পেয়ে হলাম ম্যানেজার। তাতেও পদবির শেষে ‘র’। ভাবলাম এই ‘র’ যখন পিছু নিয়েছে তখন আমিও তার শেষ দেখে ছাড়ব। এক-পর্যায়ে সুযোগও এসে গেল রেস্টুরেন্টের পার্টনার হবার। কিন্তু টাকা কোথায়? যে বেতন পেতাম তাতে সংসার চালানোর পাশাপাশি দেশের বাড়িটাও সামাল দিতে হতো। অর্থাৎ আমার অবস্থা তখন ‘চাল আনতে পান্তা ফুরায়’। ভাবলাম লোন করব। গিন্নীকে কথাটি বলায় তিনি কিছুক্ষণ অপলক নেত্রে  আমার দিকে তাকালেন। হয়তো ভাবলেন, আমি ভালো একটাকিছু চিন্তাও করতে পারি অথবা করতে শুরু করেছি। তবে প্রকাশ্যে কিছুই বললেন না। শুধু জানালেন লোন করার দরকার নেই আমার কাছে টাকা আছে। আমি তো অবাক! কারণ, একসাথে একই ছাদের নিচে দীর্ঘদিন থেকে বসবাস করেও আমার যতটুকু মনে হয়েছে তিনি একজন সরল-সহজ এবং কারণে-অকারণে আমার ভাষায় কিছুটা কিপ্টে। কিন্তু সেই তিনি যে ব্যাংকের মতো ক্ষমতাবান এবং আমার মতো অভাজনকেও কোনও ধরনের সিকিউরিটি ছাড়া বিনা সুদে এমনকি ফেরত দেবার মতো কোন শর্তারোপ না করেই এতটা পাউন্ড দিয়ে দিতে পারেন তা জানার মুরদ আমার ছিল না। আর থাকবেই-বা কি করে স্বয়ং বিধাতাও নাকি নারীর মন বুঝতে পারেন না আর আমি তো কোন নচ্ছার। ভিজিটার জামাই হিসেবে বিয়ে করে তাকে ঘরে এনেছিলুম বলে তিনি না চাইলেও কিছুটা তোয়াজ তার প্রাপ্য ছিল। যারা এই প্রাপ্য দিতে কার্পণ্য করেছেন, আমার সমগোত্রীয় সেই ভাগ্যবিড়ম্বিতদের নিয়ে আপনারা অনেক নাটক দেখেছেন, উপন্যাস পড়েছেন, গল্প ও কবিতা লিখেছেন। ‘বিবাহের পহেলা রাতে মারিবে বিড়াল’ থিয়োরিটি আমাদের বেলায় একেবারেই মধ্যযুগীয়। তাই আমি ও-পথে পা না বাড়িয়ে তার প্রাপ্য সম্মান দিতে কার্পণ্য করিনি। এমনকি আরেকটু বাড়িয়ে কারণে-অকারণে গৃহলক্ষ্মীও বলেছি। কিন্তু এবার সেই গৃহলক্ষ্মীর সাক্ষাৎ লক্ষ্মীদেবীরূপে আর্ভিভাব দেখে মনে মনে ভেবেছি, জহুরি হিসেবে আমিও একেবারে ফেলনা না।

তবুও কিছুটা লোন করতে হয়েছিল। আর এভাবেই পার্টনারশিপ নিয়ে হলাম গাভনার। এই নামটার সঙ্গেও ‘র’। তবে তার আগেই আবার লেখালেখি করতে শুরু করেছি। ১৯৯৪ সালে আমার গানের বই ‘এ মাটির বাউল’ বইটা বের হয়। ২০০০ সালে এথনিক মাইনোরিটিজ অরিজিন্যাল হিস্ট্রি অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার থেকে বের হয় ‘বিলাতে বাংলা সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা’। তারপর ২০১০ সালে ‘বিলাতে বাংলার রাজনীতি’। মোট কথা আশির দশকে লেখা গানগুলো দিয়ে, ‘এ মাটির বাউল’, নব্বইয়ের পুরো দশক ব্যয় করে ‘বিলাতে বাংলা সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা‘ এবং একবিংশ শতকের প্রথম দশক শেষে ‘বিলাতে বাংলার রাজনীতি’। এই শম্বুকগতি নিয়েই চলছি। সেজন্য গিন্নী প্রায়ই একহাত নেন। তার অভিযোগ, ‘লেখকরা একসাথে কবিতা, গান, গল্প আরও কতকিছু লেখে। কিন্তু তুমি গান ধরলে আর কিছুই পারো না। ইতিহাস ধরলে গানের খবর থাকে না’ ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি নিরীহ মানুষ তাই পারতপক্ষে ঝগড়াতে না গিয়ে গিন্নীকে খুশি করবার জন্য নয় বরং ভদ্রলোকের মতো একেবারে মনেপ্রাণে খাঁটি কথাটিই বলি, ওদের হচ্ছে বহুমুখি প্রতিভা, ওরা সব্যসাচী, তাই তারা দু-হাতে লিখতে পারে। কিন্তু আমার হচ্ছে বউমুখি প্রতিভা। বউয়ের অনুগ্রহে এদেশে আছি, বউয়ের টাকা দিয়ে ব্যবসা করি, বউয়ের তাড়া খেয়ে লিখি, বউয়ে রান্না করে দিলে তবেই খাই। এতে তাকে খুশি করতে পারি কি না জানি না, তবে তিনি রণে ভঙ্গ দেন। আমিও হাফ ছেড়ে বাঁচি।

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you