আমি তখন চারুকলা ভর্তি কোচিং করছি। ১৯৯৮ সাল। লাইন টেনে ওভাল এঁকে হাত মকশো করছি। এতদিনের আঁকাআঁকি সম্পর্কিত জানাবোঝা নিয়ে বিশাল কনফিউজড অবস্থা। আর ভীষণ ইন্ট্রোভার্টেড তখন। মাথার ভেতর কত কত প্রশ্ন, কাকে জিজ্ঞেস করব কে দেবে উত্তর। এরকম এক দুপুরে হঠাৎ খেয়াল করলাম চারুকলার ক্যাম্পাস প্রায় খালি। আমার মতো নবিশ কয়েকজন ব্যতীত একদম শূন্য ক্যাম্পাস। স্বভাবতই কাউকে জিজ্ঞেস করতেই একজন বলল, সবাই থিওরি ক্লাসে। আমি বেশ ঘাবড়ে গেলাম, কারণ, থিওরি ক্লাসে এভাবে সবাই হামলে পড়ার কারণ কি? কেউ একজন বলল, তুমিও যেতে পারবা। আমি অবাক, আমি কিভাবে যাব, আমি তো বহিরাগত! তাছাড়া এটা কোন ব্যাচের কিসের থিওরিক্লাস যেখানে আমিও যেতে পারব? কৌতূহল তৈরি হলো আমার। আমি সিঁড়ি ভেঙে চারুকলার পেছনের দালানের তৃতীয় তলায় দুরুদুরু বুকে হাজির হলাম। এবং ক্লাসের কাছে যেতেই জানালা দিয়ে লক্ষ করলাম কানায় কানায় পূর্ণ ক্লাসরুম। অনেকেই জাস্ট দাঁড়িয়ে আছে। যিনি লেকচার দিচ্ছেন তাঁর নামের সাথে পরিচিত ছিলাম আমি কিন্তু চেহারা দেখে প্রথমে চিনিনি। আমি বিনীত ভঙ্গিতে ক্লাসে ঢুকলাম তারপর পেছনের এক অন্ধকারে নিজেকে লুকিয়ে ফেললাম। এত এত গুণীদের ভিড়ে আমি আবার কে? সেই বক্তৃতারত শিক্ষকের নাম সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। তিনি নন্দনতত্ত্ব পড়াচ্ছেন। ততদিনে ভাষাশহিদ গ্রন্থমালার ছোট পুস্তিকা ‘নন্দনতত্ত্ব’ আমার পড়া। বুঝি না-বুঝি। সেই মুখরিত শ্রেণিকক্ষ এক অভিজ্ঞতা বটে। ছাত্রদের প্রশ্ন, তাঁর উত্তর সব মিলিয়ে অদ্ভুত এক গমগমে দুপুর ছিল সেটা। এরপর আমি চারুকলায় দীর্ঘ একটা সময় কাটিয়েছি। অনার্স মাস্টার্স করতে যা সময় লাগে তার চেয়েও বেশি। বলতে গেলে নিজেকে খুঁজে ফিরেছি, নিজেকে নানাভাবে আবিষ্কারও করেছি। আমি আর কখনো থিওরিক্লাসে সেই উত্তেজনা দেখিনি। নন্দনতত্ত্ব এরপরেও অনেকেই আমাদের পড়িয়েছেন, সেসব আমিও বিস্মৃত আজ। থিওরিক্লাসে সৈয়দ আজিজুল হক ছাড়া আর কারো পঠনপদ্ধতি ভালো লাগত না। ছাত্ররা হাই তুলত। কারণ খুব বোরিং ছিল সেসব পাঠপ্রক্রিয়া। ফলে, সৈয়দ মনজুরুল স্যারের গেস্ট হিসেবে এসে সেই যে বক্তৃতা দিয়ে গেলেন তা আমি পুরো ছাত্রজীবনেই মিস করেছি। তার নন্দনতত্ত্ব বোঝা বা পাঠপদ্ধতি সেসব নিয়ে আরেকদিন কথা হবে। আজ এই গুণী শিক্ষক, শিক্ষাবিদ, বহুমুখী প্রতিভার মানুষটিকে তাঁর প্রয়াণে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাই। আমাদের একবারই কথা হয়েছিল বেঙ্গল শিল্পালয়ে তারুণ্য বিষয়ক একটি অনুষ্ঠানে। আমরা ছবিও তুলেছিলাম। কথা হয়েছিল সঞ্জীব চৌধুরী আর ভাটি অঞ্চলের গান নিয়ে। আমি জানতাম না তিনিও ভাটির মানুষ। আজ তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন।
বিদায় কাচভাঙা রাতের গল্পকার!
১০ অক্টোবর ২০২৫
শিবু কুমার শীল রচনারাশি
গানপারে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
- ভূমিকম্প হয়ে যাওয়ার পরে এক পুরানঢাকার বাসিন্দা || শিবু কুমার শীল - November 28, 2025
- টুকটাক সদালাপ ২৩ - October 16, 2025
- বিদায় কাচভাঙা রাতের গল্পকার || শিবু কুমার শীল - October 12, 2025

COMMENTS