বাংলা অ্যাকাডেমিতে লেখার ওয়ার্কশপে ক্লাস নিচ্ছিলাম; ক্লাস শেষে অংশগ্রহণকারীদের যখন আহ্বান করি কোনো প্রশ্ন থাকলে করতে, একজন উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘আপনি আপনার বক্তৃতায় রবীন্দ্রনাথ, বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ, এমনকি জসীম উদদীনের কথা বলেছেন, তাদের লেখা থেকে কোটেশন দিয়েছেন, আপনি বারবার বলেছেন রবীন্দ্রনাথের কথা, কিন্তু নজরুলের উল্লেখ করেননি। কেন?’
স্বীকার করব, কথাটা আমাকে হকচকিয়ে দেয়; সত্যিই আমি নজরুলের নাম করিনি, বা তাঁর লেখা থেকে উদ্ধৃতি দিইনি; আমার বক্তৃতার বিষয় যা ছিল তাতে নজরুল আসেন না বলেই নজরুলের কথা বলিনি, এই কথাটা জানিয়ে প্রশ্নকর্তাকে বলি, ‘আপনি জসীম উদদীনের কথা বলেছেন, ওই এমনকি কথাটা ওঁর নামের সঙ্গে যোগ করা ঠিক হয়নি আপনার, কারণ, জসীম উদদীন বাংলা ভাষার একজন বড় কবি, তাঁকে দীর্ঘদিন আমরা বড় অবহেলা করেছি, পল্লীকবি বলে মূলধারার বাইরে রাখতে চেয়েছি, রবীন্দ্রনাথের পর যে-দুজন কবি বাংলার গ্রাম ও নিসর্গকে কবিতায় নতুন চোখে দেখেছেন তারা হলেন জীবনানন্দ ও জসীম উদদীন। জসীম উদদীনের আরো একটি বড় কাজ — তিনি আমাদের কবিতায় উপাখ্যানকাব্য বা আমি যাকে বলি কথাকাব্য, সেই মাধ্যমটিকে ফিরে এনেছেন।’
প্রশ্নকর্তা বললেন, ‘দুঃখিত আমি, কবি জসীম উদদীনকে খাটো করে দেখেছি। কিন্তু আপনার না-হয় প্রয়োজন হয়নি বলে নজরুলের উল্লেখ করেননি, আজ দশদিন ধরে ক্লাস করছি, কেউই কেন নজরুলের নাম করেননি? এমনকি সাধারণভাবেও নজরুলের কবিতা বা গানের কোটেশন কেউ কেন দেন না?’
‘এ প্রশ্ন তাদেরই আপনি করবেন।’ এই বলে আমি সেদিনের ক্লাস শেষ করে দিই।
কিন্তু মনের মধ্যে কথাটা আমার থেকেই যায়; সত্যিই তো, সাহিত্য আলোচনার প্রসঙ্গ বাদই দিই, প্রতিদিনের জীবনযাপনে আমরা রবীন্দ্রনাথের গান ও কবিতাপঙক্তি অনুভব করি, জীবনানন্দও এসে যান, অথচ আমাদের ভাষার অমর কবিদের একজন — নজরুল সে-তুলনায় কত কম, এমনকি একেবারেই নয়, আমাদের কাছে আসেন, কত কম তিনি আমাদের প্রতিদিনের জীবনযাপনের সঙ্গী হন।
নজরুল একেবারেই আসেন না তা নয়, আসেন, তবে যেন তাঁকে বিশেষ প্রয়োজনে বিশেষ উদ্যোগী হয়েই আমাদের আনতে হয় — যেমন রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় বক্তৃতায়, কিংবা যেমন বাবরি মসজিদ ঘটনার পর নজরুলের হিন্দু-মুসলিম মিলনের কথাজ্ঞাপক কবিতার পঙক্তি পশ্চিমবঙ্গে। এ-রকমটাই কি তবে? নজরুলের তবে আমাদের জাতিজীবনের সঙ্কটকালেরই কবি? সমষ্টির ক্ষেত্র থেকে জাত ও কেবল সমষ্টির ক্ষেত্রেই প্রাসঙ্গিক এক কবি? ব্যক্তিগত অনুভূতির কবিতা বা গানে তিনি নন একা মানুষের ভোগ্য বা ব্যবহার্য, বরং একসঙ্গে একাধিকের? সমাবেশের?
আর, রবীন্দ্রনাথ একা মানুষের কবি, সমষ্টির কথা যখন তিনি বলেন তখনো তিনি একা মানুষের কাছেই আসেন। আমার বরাবরের ধারণা — শিল্পীর মূল কাজ সমষ্টির নয় ব্যক্তির করোটির ভেতরে; ব্যক্তির গূঢ়-গভীর যিনি ছুঁয়ে যান তিনিই বড় শিল্পী। ব্যক্তি যেহেতু সমষ্টির বাইরে নয়, পরিণামে তাই সমষ্টিকেও ছুঁয়ে যান সেই বড় শিল্পী; এবং তিনিই বারবার স্মৃত, উদ্ধৃত ও ব্যবহৃত।
তবু আমি স্থির হতে পারি না। ক্লাসের সেই প্রশ্নকর্তার কথার সূত্র ধরে আমি বাংলার মুসলিম সমাজে একদা প্রচলিত এক হাস্যকর ও বিস্ময়কর পুরনো কথাও বড় বিচলিত হয়ে স্মরণ করে উঠি যে, নজরুল মুসলিম বলেই তাঁকে তাঁর প্রাপ্য আসন দেয়া হয়নি, নইলে তিনি রবীন্দ্রনাথের চেয়ে কম বড় কবি নন।
মনে পড়ে যায়, চল্লিশের দশকে আমাদের কুড়িগ্রামের এক তরুণ মুসলিম আমাকে একদিন বলেছিলেন, ‘নজরুলের তেজটা দ্যাখ। ব্রিটিশের মুখের ওপর কেমন কথা বলেছেন বিদ্রোহী কবি — বল বীর, চির উন্নত মম শির, আর রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন — আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধূলির তলে ইংরেজের পা-চাটা কবি রবীন্দ্রনাথ, আর সেজন্যেই নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়েছে তাঁকে।’
রবীন্দ্রনাথ যে ওই রচনা ব্রিটিশের প্রতি নিবেদন হিসেবে লেখেননি, আর নজরুলও সর্বাংশে একজন রাজনৈতিক কবি হয়েও তাঁর ‘বিদ্রোহী’ কবিতার উদ্দিষ্ট যে ব্রিটিশরাজ ছিল না — এ সত্য বাংলার অনেক মুসলিমের কাছে সেদিনের পরিস্থিতিতে চোখে পড়েনি। আবার চল্লিশের দশকে এটাও বাংলার অধিকাংশ মুসলিমের কাছে অজানা হয়ে যাচ্ছিল যে, বাংলারই মুসলিম সমাজের ধর্মীয় নেতারা নজরুলকে একদিন দিয়েছিল ‘কাফের’ আখ্যা, হিংসাশ্রয়ী ফতোয়া তারা দিয়েছে নজরুলের বিরুদ্ধে; বরং তাই সেদিনের বাঙালি মুসলিম তরুণরা জানছে নজরুল হচ্ছেন ‘মুসলিম পুনর্জাগরণের’ — এবং তারই কূটসূত্র ধরে তিনি পাকিস্তান আন্দোলনের কবি! — এবং একই কূটসূত্রে রবীন্দ্রনাথের চেয়ে ‘আমাদের জন্যে’ সবচেয়ে ‘বড় কবি’ নজরুল।
মনে হয়, নজরুলের প্রতি ‘আমাদের’ এই মনোভাব এখনো আছে মনের ভেতরে কোথাও; আমরা তাই পদে পদে আবিষ্কার করে থাকি নজরুলের প্রতি ‘অনীহা ও অবহেলা’। আমি আরো একবার ভাবি, কবির তথা একজন শিল্পীর মূল্যায়ন করব আমরা কিভাবে? কেবল রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে, নাকি শিল্পের মানদণ্ডে? নাকি দুটোই মিলিয়ে নিয়ে?
মেলানোই আমি বিশ্বাস করি হয় কর্তব্য; কারণ রাজনীতি বা রাজনৈতিক প্রেরণা জীবনের বা মানবের — ব্যক্তির বা সমষ্টির — বাইরের কোনো ঘটনা নয়। শিল্পীর ‘রাজনীতি’ কখনো তাঁর জনগোষ্ঠী এবং সেইসঙ্গে সকল মানুষের — যাকে বলি মানব, সেই মানবের — বিরুদ্ধ অবস্থানের হতে পারে না।
.
.
গানপারটীকা
‘স্বাদিত রবীন্দ্রনাথ’ বইয়ের নামরচনা ‘স্বাদিত রবীন্দ্রনাথ : হৃৎকলমের টানে’ নামীয় রচনার ভিতরভাগে এই নিবন্ধটা আরও অনেক শিরোনামহীন ভিন্ন-অথচ-বিষয়ভাবনায়-একত্রীভূত নিবন্ধের একটা। গানপারে উৎকলনকালে সেই নিবন্ধটারে একটা নাম দিতে হয়েছে আমাদেরে, এছাড়া আর-কোনো রদবদল করা হয় নাই। কিছু মুদ্রণপ্রমাদ আর বানান মেরামত করা হয়েছে, একদমই অল্প যদিও। উল্লেখ্য, সৈয়দ হকের বিখ্যাত ও বহুল পাঠক-আদরণীয় কলামবই ‘হৃৎকলমের টানে’ থেকে যে-কয়টা রাবীন্দ্রিক অনুষঙ্গ-প্রসঙ্গ সম্বলিত ভুক্তি এথা ‘স্বাদিত রবীন্দ্রনাথ : হৃৎকলমের টানে’ লেখার ভুক্তি হিশেবে অ্যাকোমোডেইটেড হয়েছে। এই বইটা ঢাকা থেকে ২০১৩ সনে বেরিয়েছে। লেখাটায় নজরুলসৌত্রিক কিছু কথাবার্তা থাকায় এগারো-জ্যৈষ্ঠ কবির জন্মতিথি রিকালেক্টের পার্ট হিশেবে এইখানে পুনর্প্রকাশিত হলো।
… …
- ভোটবুথ, ভূতভোট, বজরঙবলি ও বেবুন - November 26, 2024
- ক্বারী আমীর উদ্দিন সান্নিধ্যে সেদিন || তারেক আমিন - November 20, 2024
- পোয়েট ও তার পার্টনার - October 19, 2024
COMMENTS