কাজী নজরুল ইসলাম নামটা শুনলেই বিরাট সেই শিশুটির কথা মনে আসে। সেই শিশুটি। মাইটি শিশুটি। মাদার ন্যাচার। আমরা সবাই তার লীলা দেখে বিমোহিত, বুঝতে না-পেরে ভীতও কখনো, অনুরাগের জায়গায় বিরাগও হয় মাঝেমধ্যে। এইসবই কিন্তু প্রকৃতিবিশ্রুত। প্রকৃতি নিয়া আমরা খেলছি, নাকি প্রকৃতিই আমাদের নিয়ে খেলছে, এ এক রহস্য, অমীমাংসিত রহস্য। সব রহস্যই যে মীমাংসা করে ফেলতে হবে, এমন কথা কে বলেছে? আর মীমাংসা যা হয়ে যায় তা তো আর রহস্য নামে ডাকা যায় না।
গান শুনছিলাম সেদিন। এইটা আজ আর লিখে জানাবার মতো খবর তো নয়। এখন আমরা না-চাইলেও সর্বক্ষণ শব্দের জঙ্গলে থাকি। নিজস্ব শব্দের মেশিনখানা পার্স বা পাউচে নিয়ে হাঁটিচলি। রিংটোন থেকে শুরু করে রংঢং সবকিছুই এখন শব্দজঙ্গল। শব্দমাত্রই ব্রহ্ম, ওঁ, ওঙ্কার, শব্দ অবহেলা করি না, পাপ হয়, আমি নিজেও প্রচুর শব্দ করি, যাকে বলে এক্সট্রোভার্ট, হড়বড় তড়বড়, সারাক্ষণ, ফলে আমার সঙ্গী ইন্ট্রোভার্ট, না-হয়ে উপায় নাই, ল্য অফ ন্যাচার, ব্যালেন্স রাখতে এইভাবে ন্যাচার বাকবাকুমের পাশে বসায় বাকহারা বাহাদুর, দেখনশোভা তার মন্দ নয় কেবল শব্দকঞ্জুস, যা-হোক, নসিব মন্দ নয়, আকেলমান্দ ক্যে লিয়ে ইশারা কাফি হ্যায়, ব্যালেন্সড কোম্প্যানি।
কি যেন বলছিলাম? হ্যাঁ, গান শুনছিলাম। সেদিন। ইউটিউবে র্যান্ডোম। দ্রুত-মধ্য-ধীর-ধুমধাড়াক্কা বাজতে বাজতে কেমনে কেমনে যেন হঠাৎ পরিচিত কথাগুলো কানে এল। বাজনাও পরিচিত। বহুদিনের। প্রিয়। নজরুলের। অনেকদিন শোনা হয় নাই। একসময় প্রায় নিয়মিত নজরুল শোনা হতো। শোনা হতো মানে, শুনতে হতো। প্রথমে বেশ বাধ্যই হতে হয়েছিল শুনতে, প্রেমেও পড়ে যাই এক-সময়। হ্যাবিট হয়ে গেলেই কি সেটা প্রেম? না হ্যাবিট আর প্রেম আলাদা? জানি না। আমি ভাইয়া জ্ঞানী না। গানী, মানে গান শুনি। চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে গাই একলা ক্ষণে ভূতের ভয়ে। আমার গাওয়ায় ভূত কাছে ঘেঁষে না।
নাচশিল্পের শিক্ষার্থী হবার সুবাদে ছোটবেলা থেকে নজরুলের গানের সঙ্গে স্টেপিং প্র্যাক্টিস করতে হয়েছে। একা একা। নৃত্যশিখনবৃত্তে। সেই-সময় নজরুলের কিছু কমন গান শুনে এর সুরজাল সম্পর্কে কান ক্রিয়েট হয়। এবং নৃত্যকলানুশীলক হিশেবে সেই কবে থেকে যে-কোনো ধরনের অগামগা গান শুনেও সঙ্গে সঙ্গে সেটার নৃত্যরূপায়ণ-সম্ভাবনা আন্দাজের চেষ্টা করতাম, মনে মনে কোরিয়োগ্র্যাফটা করে নিতাম নিজের জন্য। অভ্যাসটা আজও রয়ে গেছে।
এইভাবে রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলের অনেক গান শুনেছি শুধু সেগুলোর নৃত্যকল্প মনশ্চক্ষে রচনার লোভে। এই ব্যাপারটা আমার মনে হয় নাচের শিক্ষার্থী মাত্রেই জীবনভর অভ্যাস হয়ে যায়। নাচকলা পার্ফোর্ম ছেড়ে দিলেও কতিপয় হ্যাবিট-অভ্যাস রয়ে যায়। অ্যানিওয়ে। কেবল নৃত্যচিন্তা মাথায় রেখেই গান শুনেছি বললে তো নৃত্যবুদ্ধিজীবিত্ব হবে সেটা, আমি তা নই, আমি সাধারণ গানশ্রোতা, সাধারণ নৃত্যভোক্তা, আর-দশের মতো। ফলে বিচিত্র গান শুনি। কিছু প্রিয় গান শুনি ফিরে ফিরে। ‘খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে’ তেমনই একটা।
কাজী নজরুল ইসলামের এই গানটা, ‘খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে’ গানটা, আমার খুব প্রিয়। বেসুরা সুর তুলে আমি এই গানটা খুব মন ভরে গাইতাম এক-সময়। এখনও সুরপাখনা কানে উড়ে এসে লাগলে নস্ট্যালজিক হই। ভীষণ ভালো লাগে। সেদিনও শুনতে শুনতে আন্দোলিত হচ্ছিলাম।
খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে
বিরাট শিশু আনমনে।
প্রলয় সৃষ্টি তব পুতুল খেলা
নিরজনে প্রভু নিরজনে।।
শূন্যে মহা আকাশে
তুমি মগ্ন লীলা বিলাসে
ভাঙিছ গড়িছ নিতি ক্ষণে ক্ষণে
নিরজনে প্রভু নিরজনে।।
তারকা রবি শশী
খেলনা তব হে উদাসী
পড়িয়া আছে রাঙা
পায়ের কাছে রাশি রাশি।।
নিত্য তুমি হে উদার
সুখে-দুখে অবিকার।
হাসিছ খেলিছ তুমি আপন সনে
নিরজনে প্রভু নিরজনে।।
কেবল সুর নয়, তাল কিংবা লয় নয়, এই গানের লিরিকটাও লক্ষণীয়। রবীন্দ্রনাথে যেমন পূজাপর্ব, ঋতুপর্ব ইত্যাদি আছে, কম্পার্টমেন্ট একেকটা, নজরুলগীতিকায় তেমন নেই। নজরুলের গানগুলোতে এইভাবে পর্ববিন্যাস থাকলে কেমন হতো বলতে পারি না। তবে না-থাকায় খারাপ হয় নাই। বিভিন্ন শ্রোতার কাছে একেকটা গান একেকভাবে ব্যঞ্জিত হবার সুযোগটা এখানে অবারিত। এই বিশ্বসংসার নিয়ে খেয়ালের বশে খেলা করা শিশুটি এখানে যেমন প্রভু ভাবতে পারি আমরা, কবি নিজে হয়তো-বা তা ভেবেই লিখেছেন রচনাটা, আবার খোদ কবিকেও এইখানে এই বিরাট শিশু ভাবা অতিকল্পনা হয় না। আর সেই কবিটির নাম যদি হয় নজরুল, লক্ষ করলে দেখা যাবে যে এই গানের কেন্দ্রচরিত্র প্রভুর বৈশিষ্ট্যগুলোর প্রায় সবই নজরুলেরও স্বভাবভুক্ত বৈশিষ্ট্য। মানুষ তো আসলে নিজেকেই লেখে, নিজেকেই আঁকে, নিজেকেই গায়। বাকি যা-কিছু সবই প্রতীক-রূপক ইত্যাদি উপাদান ছাড়া আর-কি।
… …
- আনমনে সেই বিরাট শিশু || পূজা শর্মা - May 30, 2018
COMMENTS